কুরআনের আলো
সূরা আর-রহমান : আয়াত ১০-১৮ (পর্ব-২)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা সূরা আর-রহমানের ৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তাফসির শুনেছি। আজ আমরা এই সূরার ১০ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমেই ১০ থেকে ১৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
وَالْأَرْضَ وَضَعَهَا لِلْأَنَامِ (10) فِيهَا فَاكِهَةٌ وَالنَّخْلُ ذَاتُ الْأَكْمَامِ (11) وَالْحَبُّ ذُو الْعَصْفِ وَالرَّيْحَانُ (12) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (13)
“আর তিনি জমিনকে স্থাপন করেছেন জমিনের অধিবাসীদের জন্য।” (৫৫:১০)
“এতে রয়েছে [সবরকম] ফলমূল ও খেজুর [গাছ] যার ফল আবরণযুক্ত।”(৫৫:১১)
“আর আছে খোসা বিশিষ্ট দানা ও সুগন্ধী লতাগুল্ম।”(৫৫:১২)
“সুতরাং [হে মানুষ ও জ্বিন সম্প্রদায়] তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?”(৫৫:১৩)
মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালা যেসব অনুগ্রহ করেছেন সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে ভূপৃষ্ঠকে মানুষের বসবাস ও টিকে থাকার উপযোগী করে গড়ে তোলা। পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা বলেন, এই পৃথিবীতে অতীতে এমন অনেক প্রাণী বসবাস করত যেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক প্রাণী বর্তমান যুগেও বিলুপ্ত হওয়ার পথে রয়েছে। কিন্তু মানব জাতির বংশধারা সব সময়ই উৎকর্ষের দিকে ধাবমান ছিল এবং তার টিকে থাকার জন্য সব উপকরণ এই পৃথিবীতে বিদ্যমান রয়েছে।
পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকার অন্যতম উপকরণ হলো গাছপালা ও লতাগুল্ম যা নানা ধরনের শস্য ও খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে মানুষের সেবায় নিয়োজিত। মানুষের প্রতিটি শারিরীক চাহিদা এসব লতাগুল্ম মিটিয়ে থাকে। এমনকি মানুষের জন্য যত খাবার আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তার প্রত্যেকটিকে হজম করার মতো পরিপাকতন্ত্র আল্লাহ মানুষের দেহে স্থাপন করে দিয়েছেন। যেসব প্রাণীর গোশত মানুষ ভক্ষণ করে সেসব প্রাণীও এসব লতাগুল্ম থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে।
এই চার আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতগুলো সঠিকভাবে চিনতে পারলে আল্লাহর প্রজ্ঞা, ক্ষমতা ও রহমত সম্পর্কে জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে তাঁর সামনে বান্দা নম্র ও বিনয়ী আচরণ করে।
২- মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে ফল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর ফলের মধ্যে খোরমায় রয়েছে প্রচুর খাদ্য গুণ। এ কারণে এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে খোরমার নাম উল্লেখ করেছেন।
৩- মানুষের চিত্তে আনন্দ দেয়ার জন্য বহু লতাগুল্ম ও ফুলকে আল্লাহ তায়ালা সুগন্ধী করে সৃষ্টি করেছেন। এটিও তাঁর নেয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
এবারে সূরা আর-রহমানের ১৪ থেকে ১৬ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ صَلْصَالٍ كَالْفَخَّارِ (14) وَخَلَقَ الْجَانَّ مِنْ مَارِجٍ مِنْ نَارٍ (15) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (16)
“মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন শুষ্ক ঠনঠনে মাটি থেকে যা পোড়া মাটির মতো।” (৫৫:১৪)
“এবং জ্বিনকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নিশিখা থেকে।”(৫৫:১৫)
“সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?”(৫৫:১৬)
এই আয়াতগুলোতে মানুষ ও জ্বিন সৃষ্টির কথা উল্লেখ করেছেন আল্লাহ তায়ালা। পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ ও জ্বিন জাতিরই চিন্তা করার ক্ষমতা ও বোধশক্তি রয়েছে। এখানে বলা হচ্ছে: সৃষ্টির সেরা মানব জাতিকে আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যহীন জিনিস অর্থাৎ মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই মাটিতে পানি মেশানো হলে তা প্রথমে কাদা এবং পরে শক্ত ইটের আকার ধারণ করে। কাজেই আল্লাহ তায়ালা মাটি দিয়ে তৈরি দেহের কারণে মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেননি বরং মানুষ সেরা হতে পেরেছে তারা রুহ বা আত্মার কারণে যা তিনি মাটির তৈরি দেহের মধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন।
জ্বিন হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার আরেক সৃষ্টি যার কথা পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা জ্বিন জাতির নামে অবতীর্ণ করা হয়েছে। এই আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী জ্বিনকে আগুন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ইবলিস শয়তান এই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেই নিজেকে প্রথম মানব আদম থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবি করে আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল; যদিও মাটির চেয়ে আগুনের শ্রেষ্ঠ হওয়ার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। এছাড়া, নিজেদের সৃষ্টি কিংবা বিনাশে মানুষ বা জ্বিন কারো হাত নেই। কাজেই মানুষ ও জ্বিনকে তাদের প্রতিপালকের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে এজন্য যে, তিনি তাদের অস্তিত্ব সৃষ্টি করেছেন এবং সুন্দরভাবে তাদের জীবনযাপনের জন্য অসংখ্য নেয়ামত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বেশিরভাগ মানুষ ও জ্বিন আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- মাটি, পানি কিংবা আগুনের প্রাণ নেই। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এই প্রাণহীন জড় বস্তু থেকে বোধশক্তিসম্পন্ন প্রাণি সৃষ্টি করেছেন।
২- মানুষ ও জ্বিন উভয়কে এই ভূপৃষ্ঠে থাকা উপকরণ দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে।
৩- আমরা যাকে দেখতে কিংবা অনুভব করতে পারি না তাকে যেন অস্বীকার না করি। জ্বিনকে আমরা দেখতে না পেলেও এই পৃথিবীতেই তাদের অস্তিত্ব আছে এবং তারাও আল্লাহরই সৃষ্টি।
৪- আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকারকারীদের আল্লাহ তায়ালা ভর্ৎসনা করেছেন এবং এই ভর্ৎসনার আওতায় মানুষ ও জ্বিন উভয়ই রয়েছে।
এবারে এই সূরার ১৭ ও ১৮ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
رَبُّ الْمَشْرِقَيْنِ وَرَبُّ الْمَغْرِبَيْنِ (17) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ (18)
“তিনি দুই পূর্ব ও দুই পশ্চিমের রব।” (৫৫:১৭)
“সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের প্রতিপালকের কোন্ কোন্ নিয়ামতকে অস্বীকার করবে?”(৫৫:১৮)
এই দুই আয়াতে আবার নিজ অক্ষের ওপর পৃথিবীর ঘুর্নয়নের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী ও সূর্য সৃষ্টি করে এই দু’টিকে এমনভাবে স্থাপন করেছেন যেন সূর্য ঠিক এক অবস্থানে থেকে পৃথিবীতে আলো ও তাপ বিকীরণ করতে না পারে বরং দিনের বিভিন্ন সময়ে এবং বছরের বিভিন্ন ঋতুতে এই আলো ও তাপের তারতম্য থাকে। গ্রীষ্মকালে সূর্য থাকে ঠিক মাথার উপর এবং এ সময় সূর্যের তাপও থাকে সর্বোচ্চ পরিমানে। অন্যদিকে শীতকালে সূর্য অনেকটা হেলে পড়ে এবং ভূপৃষ্ঠের ওপর সবচেয়ে কম তাপ বিকীরণ করে। সূর্যের এই আচরণের কারণে পৃথিবীতে ঋতুর পরিবর্তন হয়। সূর্যের এই দুই অবস্থানকে দুই পূর্ব ও দুই পশ্চিম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বছরের প্রতিটি দিনই সূর্য আকাশের আলাদা আলাদা অবস্থান থেকে উদিত ও অস্তমিত হয়। এ কারণে এক বছরে যতগুলো দিন ও রাত আছে ততগুলো পূর্ব ও ততগুলো পশ্চিমের সৃষ্টি হয়। ঠিক এ কারণেই এই আয়াতে দুই পূর্ব ও দুই পশ্চিমের কথা বলা হলেও সূরা মাআরিজের ৪০ নম্বর আয়াতে পূর্বসমূহ ও পশ্চিমসমূহের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ অসংখ্য পূর্ব ও অসংখ্য পশ্চিম রয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে এই আয়াত বর্ণিত দুই পূর্ব ও দুই পশ্চিমের মাঝখানে অবস্থিত।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- পবিত্র কুরআন মানুষকে আসমান ও এর ভেতরে অবস্থিত নক্ষত্রসমূহ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে উৎসাহিত করেছে। সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রসহ আসমানে অবস্থিত নেয়ামতসমূহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করলে মানুষ আল্লাহর প্রতি অধিকতর কৃতজ্ঞ হতে পারবে।
২- বছরের বিভিন্ন সময়ে দিন-রাত্রির সময় পরিবর্তনের পাশাপাশি শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। আল্লাহ তায়ালা মানুষসহ অন্যান্য প্রাণির জীবনধারণের জন্য সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী এই পরিবর্তনগুলো ঘটিয়ে থাকেন।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/১৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।