মহান আল্লাহর রিজ্ওয়ান নামের প্রভাবের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ইমাম হুসাইন-আ
আসমাউল হুসনা-৯২ ( রিজ্ওয়ান নামের তাৎপর্য)
মহান আল্লাহ'র আসমায়ুল হুসনার তালিকাভুক্ত আরেকটি নাম রিয্ওয়ান বা রিদ্ওয়ান। رِضْوَان –এর অর্থ সন্তুষ্ট। মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির সব বিষয়ে সন্তুষ্ট ও অস্তিত্বের কোনো অংশই আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে না।
কারণ মহান আল্লাহই সব অস্তিত্বের স্রষ্টা ও তিনি নিজের ইচ্ছায় সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। সুরা তওবার ৭২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি সব কিছুর চেয়ে শ্রেয়। অবশ্য রিজ্ওয়ানের সমগোত্রীয় শব্দ রেজা বা সন্তুষ্টি মানুষের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, পবিত্র কুরআনে সুরা মায়েদার ১১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, মহান আল্লাহ সত্যবাদীদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।
ভালোবাসা বা প্রেমের মত সন্তুষ্টিও কোনো এক তরফা ব্যাপার নয়, বরং দুই পক্ষের সম্পর্কের বন্ধন। বান্দাহ অন্তরের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে যে তা আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্য ও ইচ্ছায় সন্তুষ্ট কিনা। মানুষ যদি আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট না হয় আল্লাহও তার ওপর সন্তুষ্ট নন।
মহান নবী-রাসুল, ইমাম এবং আল্লাহর ওলিগণ সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন তাঁরা খোদায়ি পরীক্ষার ভীষণ প্রতিকূলতাগুলো বা অত্যন্ত কঠিন সংকটেও ধৈর্য ধরে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি ও প্রেমময় আন্তরিকতা বজায় রাখেন । সুরা ফাজ্র্-এর ২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি তোমার পালনকর্তার কাছে ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।
মুমিন মানুষের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি বেহেশতি নেয়ামত ও সুখের চেয়েও বেশি মূল্যবান। আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি মানুষের ঈমানের পূর্ণতার বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা যে কোনো বিপদ ও পরীক্ষা এ ধরনের ঈমানে কোনো ফাটল ধরাতে পারে না। এমন মুমিন সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রভুত্ব ও নির্দেশের কাছে মাথা নুইয়ে দেন সন্তুষ্টচিত্তে ও প্রশান্ত প্রেমময় চিত্তে। কেবল নিজের বিষয়ে নন অন্যদের বিষয়ে ও বিশ্ব জগতের সব বিষয়ে মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনাকে এই শ্রেণীর মুমিন মেনে নেন আন্তরিক ও নিবেদিত চিত্তে।
খাজা নাসিরউদ্দিন তুসি তার 'আখলাকে নাসিরি' নামক বইয়ে লিখেছেন: এক মহান ধার্মিক ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হল যে আল্লাহর প্রতি সর্বাবস্থায় সন্তুষ্টির মাকাম বা অবস্থার প্রভাবকে নিজের মধ্যে কেমন দেখলেন? তিনি বললেন, এর চেয়ে বড় কোনো পর্যায়ে এখনও পৌঁছাতে পারিনি, তবে যদি আমার সত্ত্বা ও দেহকে দোযখের ওপর পুল বা সেতু বানিয়ে দেয়া হয় ও সৃষ্টিকুলের সব মানুষকে ওই পুল দিয়ে বেহেশতে পাঠানো হয় এবং কেবল আমাকেই দোযখী করা হয় তাহলেও আমার মনে কখনও এ চিন্তা আসবে না যে হায়! কেনো কেবল আমারই এমন দুর্ভাগ্য হল এবং অন্যরা এত সৌভাগ্যের অধিকারী হল?!!
আল্লাহর প্রতি যিনি সর্বাবস্থায় সন্তুষ্ট তিনি দরিদ্র হোন বা ধনী হোন, সুন্দর চেহারার অধিকারী হন বা কুৎসিত চেহারার অধিকারী হোন, দীর্ঘদেহী হন বা বামুন হন, কালো হন বা ফর্সা হন, সন্তানের অধিকারী হন বা নিঃসন্তান হন, সুস্থ বা অসুস্থ শরীরের অধিকারী হন তিনি কখনও এসবের জন্য দুঃখিত হবেন না এবং আল্লাহর প্রতি অভিমানী হবেন না। ধর্মীয় দায়িত্ব পালনেও এর প্রভাব দেখা যায়।–
এ বিষয়টিও মনে রাখা দরকার মানুষের কোনো কোনো ঘাটতি বা অভাব তার নিজেরই অলসতা, অকর্মণ্যতা ও অবহেলার ফসল। অন্যদের অধিকার লঙ্ঘনের কারণেও কোনো কোনো অভাব বা বঞ্চনা নেমে আসে। তাই এসব অভাবকে মহান আল্লাহর নির্ধারিত ভাগ্য বলে মনে করা মোটেই ঠিক নয়। কেউ কারো কোনো অধিকার লঙ্ঘন করলে বা কারো ওপর জুলুম করলে তাতে বাধা দেয়া উচিত ও তার অধিকার আদায়ে সহায়তা দেয়া উচিত। অন্য কথায় জুলুম মেনে নেয়া আর আল্লাহর নির্ধারিত ইচ্ছা বা সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া এক কথা নয়। আপনি যদি জুলুমের শিকার হন তাহলে অবশ্যই জুলুমের মোকাবেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার বা আত্মরক্ষার অধিকার আপনার রয়েছে।
কেউ যদি কোনো রোগে আক্রান্ত হন তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে মনে করে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকলে চলবে না। এক্ষেত্রে তার উচিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া। একইভাবে কেউ যদি অর্থ সংকটের শিকার হন তাহলে তাকে জীবন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য পরিশ্রম করতে হবে। কারণ মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল বেকার ও অলস লোকদের অপছন্দ করেন। দারিদ্র ও অভাবকে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া ভাগ্য বলে মনে করা ঠিক নয়।
কেবল সুখের সময় আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া ও দুঃখের সময় আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়া মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। মহানবীর (সা) আহলে বাইতের সদস্য ইমাম রেজা (আ) সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন বলেই রেজা নামে খ্যাত হয়েছেন। তিনি বলেছেন: মহান আল্লাহর প্রতি সুদৃষ্টি রাখা উচিত। কেউ আল্লাহর প্রতি সু-মনোভাব রাখলে আল্লাহ তার সুন্দর অনুমানেরই সঙ্গী হন। কেউ যদি অল্প হালাল রুজিতে সুখী হন তাহলে আল্লাহ তার অল্প কাজ বা ইবাদতেই সন্তুষ্ট হন ও তার বোঝা হয় হাল্কা এবং তার পরিবারকে নেয়ামত দান করেন। এ ছাড়াও অল্পে তুষ্টির কারণে আল্লাহ তাকে দান করেন বিচক্ষণতা এবং তাকে দুনিয়াতে সুস্থ রেখে পরকালীন বেহেশতে পৌঁছান।
মহান আল্লাহর রিজ্ওয়ান নামের রঙে রঙ্গিন হওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন ইমাম হুসাইন-আ.। তিনি তাঁর যুগের জালিম শাসক ইয়াযিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং এই পথে নিজের প্রায় সব প্রিয়জনকে কুরবানি করেন। এই সংগ্রামে তিনি যে নজিরবিহীন ত্যাগ ও ধৈর্য দেখিয়েছেন তা ইতিহাসে তাঁকে অমর করে রেখেছে। জীবনের শেষ মুহূর্তে শত্রুর হাতে নির্মমভাবে জবাই হওয়ার প্রাক্কালে মারাত্মকভাবে আহত, মহা-ক্লান্ত, মহা-শ্রান্ত, দারুণ পিপাসার্ত, ক্ষুধার্ত ও স্বজন-প্রিয়জনদের হারানোর বেদনার নজিরবিহীন কষ্টের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও ইমাম মহান আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির কথা উল্লেখ করে প্রশান্ত চিত্তে বলেছিলেন: হে আমার ইলাহ বা প্রভু! আপনি আমার কাছে যা চান সে বিষয়ে আমি সন্তুষ্ট এবং আপনার নির্দেশের কাছে আমি আত্ম-সমর্পিত! হে বিচার-প্রার্থীদের ফরিয়াদে সাড়া দানকারী আশ্রয়দাতা বা গিয়াস। আপনি ছাড়া অন্য কোনো মা'বুদ বা উপাস্য নেই। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/২১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।