একই সময়ে একজন নারীর কয়েকজন স্বামী থাকা নারীর স্বার্থের জন্য ধ্বংসাত্মক
সুখের নীড়-৪২ (একই সময়ে একাধিক বা বহু স্বামী কেন ধ্বংসাত্মক?)
গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি ইসলাম-পূর্ব যুগে আরব দেশ ও অন্য অনেক সমাজে বহু স্ত্রী রাখার প্রথা প্রচলিত ছিল। আরবের মূর্তি পূজারিরা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তখন তাদের প্রত্যেক পুরুষের দশ জনেরও বেশি স্ত্রী ছিল।
তাই ইসলাম পুরুষদের একাধিক বা কয়েকজন স্ত্রী রাখার প্রথা প্রথম চালু করেছে- এ দাবি সত্য নয়। তবে ইসলাম এই প্রথাকে বাতিলও করেনি। ইসলাম সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রয়োজন বা বিশেষ জরুরি অবস্থার আলোকে পুরুষদের স্ত্রীর সংখ্যাকে বিপুল মাত্রায় বাড়তে না দিয়ে বরং নির্দিষ্ট সংখ্যায় সীমিত করেছে যা নারী-পুরুষের যৌন জীবনকে করে ভারসাম্যপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রিত। ইসলাম মানুষের ফিতরাত বা প্রকৃতি-বিরোধী কোনো কাজের অনুমতি দেয় না। তাই ইসলামের প্রত্যেক বিধানেরই রয়েছে যুক্তি ও বাস্তবতা।
আসলে ইসলাম কেবল ইন্দ্রিয় বিলাসিতার জন্য একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিধান দেয়নি। বরং সামাজিক অনিবার্যতার কারণে বা ন্যায়বিচারের শর্তে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দিয়েছে।
বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হল নতুন প্রজন্ম উপহার দেয়া বা বংশ বিস্তার যা সবারই স্বাভাবিক অধিকার ও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানবীয় পূর্ণতা অর্জনের খোদায়ি রীতি। কিন্তু অনেক সময় এমনও হয় যে স্ত্রী বন্ধ্যা হওয়ার কারণে পুরুষকে অন্য এক স্ত্রী বিয়ে করতে হয়। কখনও যুদ্ধ বা অন্য কোনো কারণে সমাজে পুরুষের সংখ্যা কমে গেলে এবং যুবতী ও কম বয়স্ক বিধবা নারীর সংখ্যা বেড়ে গেলে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মহানবীর (সা.) যুগে অনেক মুসলমান নানা জিহাদে শহীদ হওয়ায় তাদের বিধবা স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণের দিকসহ নানা দিকের বিবেচনায় পুরুষদের জন্য একাধিক স্ত্রী গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছিল। আবু সুফিয়ানের কন্যা উম্মে হাবিবা তার স্বামীর সঙ্গে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। কিন্তু উম্মে হাবিবা সেখানে বিধবা হন। সেখানকার কোনো খ্রিস্টান পুরুষের সঙ্গে বিয়ে করার ইচ্ছা তার ছিল না। আবার মক্কায় মুশরিক বাবার কাছে ফিরে আসার ইচ্ছাও তার ছিল না। ফলে মহানবী (সা) খ্রিস্টান সম্রাট নাজ্জাশির কাছে দূত পাঠিয়ে উম্মে হাবিবাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। এই বিয়ের ফলে উম্মে হাবিবা ঐ উভয়-সংকট থেকে মুক্ত হন।
ইসলামী ইরানে কেউ দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে বিষয়টি আদালতে জানাতে হয় এ সম্পর্কিত যুক্তি ও প্রমাণগুলো তুলে ধরে। আদালত বিষয়টি তার প্রথম স্ত্রীকে জানায় এবং প্রয়োজনে ওই স্ত্রীকে আদালতে হাজির হতে বলে। আদালত তদন্ত করে দেখে যদি বুঝতে পারে যে ওই ব্যক্তি ন্যায়বিচারকামী ও দ্বিতীয় স্ত্রী রাখার মত আর্থিক সামর্থ্য তার রয়েছে তাহলে ওই ব্যক্তিকে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দেয়। কিন্তু আদালত যদি বুঝতে পারে যে ওই পুরুষ ন্যায়বিচারকামী নয় ও তার আর্থিক সামর্থ্যও নেই এবং তার স্ত্রীও দাম্পত্য জীবন অব্যাহত রাখতে আগ্রহী সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির দ্বিতীয় বিয়ের আবেদন আদালত প্রত্যাখ্যান করে। ইরানের সংবিধানের ৫৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী কাজি-অফিসগুলো আদালতের অনুমতি ছাড়া কোনো পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ে রেজিস্টেশনের অনুমতি দেয় না। এ ধরনের অবৈধ কাজ ধরা পড়লে কাজি অফিসের প্রধানকে শাস্তি দেয়া হয় এবং তাকে ওই পেশা থেকে বঞ্চিত ও ওই পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়।
ফরাসি ইতিহাসবিদ গুস্তাভ লি বোন ইসলামের বিয়ে সংক্রান্ত রীতি-নীতি-আইন ও পাশ্চাত্যে তথা ইউরোপ আমেরিকার মত দেশগুলোতে অমুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত অবাধ যৌনাচারের তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন, পাশ্চাত্যের আবহাওয়া বা পরিবেশের কারণে কোনো পুরুষের কয়েকজন স্ত্রীর দরকার হয় না। তা সত্ত্বেও সেখানে পুরুষদের কেবল এক স্ত্রী থাকার ধারণা শুধু আইনের বইয়েই সীমিত। পাশ্চাত্যে পুরুষরা প্রতি বছর বহু নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রাখেন। এই অবস্থার চেয়ে প্রাচ্যে একজন ব্যক্তির কয়েকজন বৈধ স্ত্রী থাকার প্রথাকে সব দিক থেকেই বেশি উন্নত ও সম্মানজনক প্রথা বলে মনে হয়।
ইসলাম কেনো বিশেষ অবস্থায় পুরুষকে কয়েকজন স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে তা নিয়ে কেউ কেউ প্রতিবাদ জানান। একবার প্রায় ৪০ জন নারী আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী(আ) র কাছে এসে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে হযরত আলী (আ) ওই নারীদের সবার হাতে পানি-ভর্তি একটি ছোট পাত্র দেয়ার নির্দেশ দেন। সবাই ওই পাত্রগুলো পাওয়ার পর তিনি ওই নারীদেরকে মজলিসের মাঝখানে থাকা একটি বড় পাত্রে তাদের হাতের পাত্রগুলোর পানি ঢেলে দিতে বললেন। এরপর আমিরুল মুমিনিন তাদেরকে আবারও সেখান থেকে নিজ নিজ পাত্রে পানি ভরতে বললেন, তবে এই শর্তও জুড়ে দিলেন যে আগের পাত্রে ঠিক যে পানি ছিল ঠিক সেই পানিই তুলতে হবে, মিশ্রিত বা পরিবর্তিত পানি তোলা যাবে না! তখন ওই নারীরা বললেন, এটা কিভাবে সম্ভব আগের পানি তো অন্য পানির সঙ্গে মিশে গেছে! এ অবস্থায় হযরত আলী (আ) বললেন, একজন নারীর যদি কয়েকজন স্বামী থাকে তখন কিছুকাল পরেই তারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সন্তানের মা হবেন, কিন্তু কিভাবে এটা নির্ধারিত হবে যে ওই সন্তানটির পিতা তার কোন্ স্বামী?! হযরত আলীর এই জবাব শুনে ওই নারীরা ইসলামী বিধানের যৌক্তিকতা মেনে নিতে বাধ্য হন।
আসলে একজন নারীর কয়েকজন স্বামী থাকার বিষয়টি নারীর স্বার্থের জন্য ধ্বংসাত্মক। কারণ কোনো নারী স্বামীকে কেবল ভোগের মাধ্যমে হিসেবে প্রত্যাশা করেন না, তারা স্বামীর হৃদয়ও জয় করতে চান। তারা চান যে স্বামী তাদের সহযোগী হোন ও তাদের জন্য ত্যাগী হোন এবং স্বামীরা যেন তাদের কষ্টার্জিত ফসল স্ত্রীদেরকে উপহার দিয়ে তাদের দুঃখ-অভিমান দুর করেন। অন্যদিকে স্বামীদের কাজকর্মের সর্বোত্তম প্রেরণা হলেন তাদের স্ত্রী ও সন্তানরা। এক নারীর কয়েক স্বামী থাকার বিষয়টি নারী ও পুরুষ কারো প্রকৃতির জন্যই আকর্ষণীয় নয়। যদি এ ধরনের প্রথা সমাজে চালু থাকতো তাহলে মানব প্রজন্মগুলো বংশধারার পরিচিতি বিলুপ্ত হত। এ ছাড়াও এক নারীর কয়েক স্বামী থাকার প্রথা পারিবারিক স্নেহ-মমতার বিলুপ্তি ঘটাতো এবং সন্তানের পরিচয় অস্পষ্ট থাকার কারণে তারা কারো স্নেহ পেত না। ফলে অপরিচিত সন্তান গ্রহণে সবার মধ্যে অনীহা দেখা দেয়ার পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাও বিপন্ন হয়ে গোটা মানবজাতিরই বিলুপ্তি ঘটত।
সুস্থ পরিবার সুস্থ সমাজ ও জাতি গঠনের পূর্বশর্ত। যেখানে পরিবার সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক দিক থেকে সুস্থ হবে না সেখানে সুস্থ সমাজ ও জাতিও গড়ে উঠবে না। পরিবারের ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য হালাল-রিজিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কুরআনে সুরা বাকারার ১৬৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: হে মানব মণ্ডলী, পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী ভক্ষণ কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। মহানবী (সা) বলেছেন, যে তার পরিবারের জন্য হালাল রুজি অর্জনে সচেষ্ট হবে সে যেন আল্লাহর পথে জিহাদ বা সংগ্রামরত মুজাহিদ। - ইসলাম প্রত্যেক মানুষকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিশ্রমী ও স্বনির্ভর হতে বলে। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে সুখের নীড়ের আজকের আলোচনা শেষ করছি। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/১৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।