আগস্ট ০৭, ২০২৩ ১৭:২৯ Asia/Dhaka

ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা 'শান্তির গ্যাস পাইপ লাইন' নামে পরিচিত। এই পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৫০ কোটি ঘনমিটার গ্যাস ভারত উপমহাদেশে রপ্তানি করা সম্ভব। কিন্তু নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে এই প্রকল্প আজো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। গত অনুষ্ঠানে আমরা 'শান্তির গ্যাস পাইপ লাইনের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছি। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ও চীন-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়নে বিরাজমান চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করবো।

চীন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিভিন্ন অঙ্গনে উন্নতির ধারা অব্যাহত রেখেছে এবং নয়া পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান আজ সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে, পরাশক্তি হিসেবে যখন চীনের উত্থান ঘটছে ঠিক তখন আরেক পরাশক্তি আমেরিকার শক্তি  ও প্রভাব ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এরপর দ্বিতীয় কৌশলগত অঞ্চল হিসেবে পূর্বএশিয়া আমেরিকা ও চীনের  প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় সমর্থক সংখ্যা বাড়ানো ও নিজের প্রভাব ধরে রাখার জন্য আমেরিকা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে শুরু করে পারস্য উপসাগর ও ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা জুড়ে শক্তিশালী জোট গঠনের চেষ্টা করছে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে আমেরিকা যা কিনা 'আব্রাহাম' প্রকল্প নামে পরিচিত। এই প্রকল্পের আওতায় ভূমধ্যসাগর ও দক্ষিণ পারস্য উপসাগরীয় এলাকা থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে আমেরিকার।

গঠনের মাধ্যমে মালাক্কা প্রণালী পেরিয়ে চীনের দক্ষিণ-পূর্ব সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় পৌঁছানো এবং এভাবে চীনকে  চারদিকে ঘিরে ফেলা।

এদিকে, আমেরিকার এই পরিকল্পনা মোকাবেলায়  চীন স্থলভাগে বৃহত্তর 'ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট' প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিয়েছে। সেইসাথে সাগর এলাকায়ও বিশাল বাণিজ্য বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছে যাতে সমুদ্র ও স্থলভাগে আমেরিকার অবরোধের সম্মুখীন হতে না হয়। এই বিশাল প্রকল্পের একটি অংশ হল চীন ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি যাকিনা পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে এবং পারস্য উপসাগরীয় এলাকার জ্বালানি খাতে চীনের ভূমিকা বাড়াতে পারে এবং এভাবে পশ্চিম এশিয়ায় আমেরিকার সাথে প্রতিযোগিতায় চীন তার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে। কিন্তু, আমেরিকা কোনোভাবেই চায় না চীন তার অবস্থানকে শক্তিশালী করুক।

আমেরিকার বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক মহল এ ব্যাপারে একমত যে বিশ্ব রাজনীতিতে চীন হচ্ছে তাদের একনম্বর ও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু চীনের কর্মকর্তারা মনে করেন বেইজিংএর ব্যাপারে এটা মার্কিনীদের অনুমান নির্ভর ও ভ্রান্ত ধারণা। কারণ চীনের উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণভাবে তাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য স্বার্থ রক্ষা করা।

যেমন চীন পারস্য উপসাগর ও কাস্পিয়ান সাগরীয় এলাকার তেল ও গ্যাস প্রাপ্তির ক্ষেত্রে একাধিক বিকল্প রুটের চিন্তাভাবনা করছে যাতে কোনো কারণে একটি পথ বন্ধ হয়ে গেলেও জ্বালানি সরবরাহের অন্য রুট খোলা থাকে। ঠিক এ কারণেই চীন ইরানের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক চুক্তি করেছে যা কিনা  আমেরিকার জন্য বিরাট মাথাব্যথার কারণ  হয়ে  দাঁড়িয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীন পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তাতে অনেক বাধা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। 

উদাহরণ স্বরূপ, এ অঞ্চলের অনেক দেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের তৎপরতার কথা উল্লেখ করা যায়, যারা কিনা আমেরিকা ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে। পাকিস্তানের উগ্র আইএস জঙ্গি এবং তেহরিক-ই-তালেবান গোষ্ঠীর মতো চরমপন্থি ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোকে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা হচ্ছে। আমেরিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করে চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়া। চীনের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য আমেরিকা এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে। এ কারণে জঙ্গিদের ব্যবহার করে চীনের সিং কিয়াং প্রদেশ এবং পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা আমেরিকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে, মধ্যএশিয়া হয়ে পশ্চিম এশিয়া ও রাশিয়া পর্যন্ত যে  সিল্করোডের পরিকল্পনা রয়েছে তাও চ্যালেঞ্জবিহীন নয়। সেখানেও মার্কিন সমর্থনপুষ্ট জঙ্গি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপদ্রব রয়েছে। এ ছাড়া, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বৈরি সম্পর্কও আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। কাশ্মির নিয়ে এ দুই দেশের মধ্যকার বিতর্কের বিষয়টি বাদ দিয়ে বলা যায় আফগানিস্তানকে কেন্দ্র কেন্দ্র করেও তাদের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। পাকিস্তান কোনোভাবেই চায় না আফগানিস্তানের ব্যাপারে ভারত নাক গলাক। কারণ ভারত আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করলে পাকিস্তান পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়তে পারে বলে ইসলামাবাদের আশঙ্কা। কিন্তু ভারত চায় আফগানিস্তানে পাকিস্তান বিরোধী সরকারের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার মাধ্যমে ইসলামাবাদকে চাপে ফেলতে। তাই এ বিষয়টি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ। পাকিস্তানের আরেকটি অভিযোগ, ভারত পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে তৎপর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে যদিও ভারত তা অস্বীকার করছে। অন্যদিকে পাকিস্তানও কাশ্মিরের জিহাদি গ্রুপকে সমর্থন দিচ্ছে। এসব গোলযোগে আমেরিকা উস্কানি দিচ্ছে যা কিনা চীন-পাকিস্তানের প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বড় হুমকি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বৈরি সম্পর্কের কারণে চীন-পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডোর আরো বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে।

কারণ এই করিডোর আফগানিস্তানের ওয়াখান প্রণালী এবং ভারত ও পাকিস্তানের বিতর্কিত কাশ্মিরের কারাকোরাম সড়ক অতিক্রম করবে। যদিও কারাকোরাম অঞ্চল পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের ওপর দিয়ে গেছে কিন্তু ভারত গোটা কাশ্মীরকে তাদের এলাকা বলে দাবি করে। ভারত মনে করে চীন-পাকিস্তানের এ করিডোর কেবল অর্থনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই বরং অর্থনীতির বাইরেও তাদের ভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে।

কাশ্মির ছাড়াও আফগানিস্তান ও মধ্যএশিয়ার দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার নিয়েও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা রয়েছে। পাকিস্তান চাইছে তালেবান সরকারের মাধ্যমে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে মধ্যএশিয়ায় নিজের বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে। অন্যদিকে ভারতও ইরানের চবাহার সমুদ্র বন্দরে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে এবং দিল্লি, তেহরান ও কাবুলের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে মধ্যএশিয়ার বাজার ধরার চেষ্টা করছে।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ