আগস্ট ১৭, ২০২৩ ২৩:৪৩ Asia/Dhaka

শ্রোতা ভাইবোনেরা, গত পর্বের আলোচনায় আমরা হযরত ফাতিমার সাদামাটা ও অল্পে-তুষ্ট জীবন সম্পর্কে কথা বলেছিলাম। এ পর্বে আমরা সর্বকালের সেরা এই মহামানবীর ইবাদাত, লজ্জাশীলতা ও চারিত্রিক পবিত্রতার বিষয়ে কথা বলব। 

হযরত ফাতিমা যখন ইবাদতে মশগুল থাকতেন তখন তাঁর নুর ছড়িয়ে পড়ত আকাশের ফেরেশতাদের কাছ পর্যন্ত। এ অবস্থায় মনে হত যেন আকাশের এক তারকা জ্বলজ্বল হয়ে আলো ছড়াচ্ছে। বলা হয় এ জন্যই তাঁর অন্যতম প্রধান উপাধি ছিল জাহরা বা  জ্যোতির্ময়। হযরত ফাতিমা মহান আল্লাহ হযরত ফাতিমার ইবাদতের একনিষ্ঠতা ও একাগ্রতা নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলতেন: দেখ কিভাবে ফাতিমা আমার ভয়ে কাঁপছে এবং কেমন একাগ্র নিবেদিত প্রাণ নিয়ে আমার ইবাদাত করছে! 

হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন : “নবী (সা.)-এর উম্মতের মধ্যে হযরত ফাতেমার ন্যায় ইবাদতকারী পৃথিবীতে আর আসেনি। তিনি নামাজ ও ইবাদতে এত বেশি দণ্ডায়মান থাকতেন যে, ফলে তাঁর পদযুগল ফুলে গিয়েছিল।”

ইমাম হাসান (আ.) বলেন : “এক বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রে আমার মাকে ইবাদতে দণ্ডায়মান দেখতে পেলাম। তিনি সুবহে সাদেক পর্যন্ত নামাজ ও মুনাজাতরত ছিলেন। আমি শুনতে পেলাম যে,তিনি মু’মিন ভাই-বোনদের জন্যে তাদের নাম ধরে দোয়া করলেন কিন্তু নিজের জন্যে কোন দোয়াই করলেন না। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম,মা! আপনি যেভাবে অন্যের জন্যে দোয়া করলেন সেভাবে কেন নিজের জন্যে দোয়া করলেন না? উত্তরে তিনি বলেন : হে বৎস! প্রথমে প্রতিবেশীদের জন্যে তারপর নিজেদের জন্যে।” –আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক অনন্য পন্থা তিনি এভাবে শিখিয়ে গেছেন নিজের সন্তানকে। 

রাসূল (সা.) বলেন : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,তুমি আমার দেহের অংশ

হযরত ফাতিমার দানশীলতাও ছিল প্রবাদতুল্য। একবার হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.) অসুস্থ হয়ে পড়লে হযরত আলী (আ.) মানত করেন যে তাঁরা সুস্থ হলে তিন দিন রোজা রাখবেন।  একই মানত করেন হযরত ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা) ও তাঁর সন্তান হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.) এবং পরিচারিকা ফিজ্জা। ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.) সুস্থ হলে তারা মানত বা প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য রোজা রাখেন। ইফতারের জন্য কিছুই ছিল না ঘরে। হযরত আলী (আ.) এক রাত ধরে শ্রমিকের কাজ করে সামান্য অর্থ সংগ্রহ করে আটা কিনে আনেন ও  এক তৃতীয়াংশ আটা দিয়ে ৫টি রুটি বানানো হয়। কিন্তু ইফতারির সময় একজন নিঃস্ব বা হত-দরিদ্র ব্যক্তি এসে খাবার চাইলে ৫ জনই তাঁদের ৫টি রুটি  দিয়ে দেন ওই নিঃস্ব ব্যক্তিকে। তাঁরা শুধু পানি পান করে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত কাটান এবং পরদিনও রোজা রাখেন। হযরত ফাতিমা (সা.) পরের দিনের ইফতারের জন্য এক তৃতীয়াংশ আটা দিয়ে আরও ৫টি রুটি বানান। এই দিন ইফতারের সময় আসে এক ইয়াতিম। সবাই তাঁদের রুটিগুলো ওই ইয়াতিমকে দিয়ে দেন এবং কেবল পানি পান করে রাত কাটান।  তৃতীয় দিনেও ঘটে একই ধরনের ঘটনা। এবার এসেছিল মুক্তিপ্রাপ্ত  অমুসলিম এক বন্দী। তাকে রুটিগুলো দিয়ে দেয়ায়  ঘরের সব আটা শেষ হয়ে যায়।

 এ অবস্থায় রাসূল (সা.) এসে দেখেন যে তাঁর প্রিয় দুই নাতি হযরত হাসান ও হুসাইন ক্ষুধার কষ্টে কাতর হয়ে কাঁপছেন। এ দৃশ্য দেখে রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে বললেন, তোমার অবস্থায় আমি খুবই দুঃখিত। তিনি ফাতিমা (সা.)’র কাছে গিয়ে দেখলেন দুর্বল হয়ে পড়া ফাতিমা (সা.)’র চোখ দুটি গর্তে নেমে গেছে। ফাতিমা (সা.)-কে কাছে টেনে নিয়ে তিনি বললেন: আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইছি! তোমারা তিন দিন ক্ষুধার্ত! এ সময় আবির্ভূত হন হযরত জিবরাইল (আ.)। তিনি সুরা দাহরের প্রথম থেকে ২২ নম্বর আয়াত পর্যন্ত পড়ে শোনান রাসূল (সা.)-কে। এভাবে মহানবীর আহলে বাইতের দানশীলতার প্রশংসায় পবিত্র কুরআনের সুরা দাহর বা ইনসানের ১৭ টি আয়াত নাজিল হয়।  ইমাম ফাখরে রাজি, আবুল ফারাজ জাওজি ও জালাল উদ্দিন সিয়ুতিসহ বেশ কয়েকজন বিখ্যাত সুন্নি মনীষী এই শা’নে নাজুলকে সমর্থন করেছেন।

এ সুরার ৮ ও নয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: ৮। তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।৯। তারা বলে: কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।

নারীকে পরপুরুষের সামনে নিজের সৌন্দর্য তুলে ধরতে নিষেধ করে পবিত্র ধর্ম ইসলাম। সমাজের নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণীর নিরাপত্তার জন্যই এ বিষয়টি জরুরি। হিজাব বা পর্দা করে চলার মাধ্যমে নারী তার প্রতিভাগুলোর বিকাশ ঘটিয়ে মানবীয় সৌভাগ্য ও পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হন। সুরা নুরের ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: ইমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে  এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদি, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ, ও বালক, যারা নারীদের গোপণ অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো আছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপণ সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। 

হযরত ফাতিমা যখন ইবাদত করতেন তখন তাঁর নুর ছড়িয়ে পড়ত আকাশের ফেরেশতাদের কাছ পর্যন্ত

নারীকে পরপুরুষের সামনে কোমল বা মিষ্টি স্বরে কিংবা প্রয়োজন ছাড়াই কোনো কথা বলতেও নিষেধ করা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। একই বিধান পুরুষের জন্যও প্রযোজ্য।  খোদা-সচেতন নারী লজ্জাশীলতা ও ইমান বা খোদার ভয়ের কারণে পরপুরুষের সামনে পর্দা করে চলেন। হযরত ফাতিমা ছিলেন এসব ব্যাপারেও সর্বোত্তম আদর্শ। ইসলাম লজ্জাশীলতাকে ইমানের অঙ্গ ও সকল কল্যাণের উৎস বলে ঘোষণা করেছে। যার লজ্জা নেই তার আসলে ধর্ম ও ঈমান বলতে কিছু নেই! লজ্জাশীলতার ভিত্তি হল ঈমান ও বিবেক বা জ্ঞান। আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) বলেছেন : “একদিন এক অন্ধ ব্যক্তি ফাতেমার গৃহে প্রবেশের জন্যে অনুমতি চাইলে তিনি ঐ অন্ধ ব্যক্তি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখলেন । রাসূল (সা.) বললেন : হে ফাতিমা! কেন তুমি এই ব্যক্তি থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখছ,সে তো অন্ধ,তোমাকে দেখছে না।? প্রতি উত্তরে ফাতিমা বলেন : যদিও ঐ অন্ধ লোকটি আমাকে দেখছেন না কিন্তু আমি তো তাকে দেখছি। এ অন্ধ ব্যক্তিটির নাসিকা গ্রন্থি তো কাজ করছে। তিনি তো ঘ্রাণ নিতে পারেন। এ কথা শুনে রাসূল (সা.) বলেন : আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,তুমি আমার দেহের অংশ।”

হযরত ফাতিমা (আ.)-কে প্রশ্ন করা হয়,“একজন নারীর জন্য সর্বোত্তম জিনিস কোনটি?” তিনি এর উত্তরে বলেন : “নারীদের জন্যে সর্বোত্তম জিনিস হল তারা যেন কোন পুরুষকে না দেখে আর পুরুষরাও যেন তাদেরকে দেখতে না পায়।” 

তদ্রূপ মহানবী (সা.) যখন তাঁর সাহাবীদের সামনে প্রশ্ন রাখেন যে,“একজন নারী কখন মহান আল্লাহর সবচেয়ে নৈকট্য লাভে সক্ষম হন?” তখন হযরত ফাতিমা বলেন : নারী যখন বাড়ীর সর্বাপেক্ষা গোপন অংশে অবস্থান গ্রহণ করে তখন তার প্রভুর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) হযরত ফাতেমার উত্তর শুনে বলেন : “ফাতিমা আমার শরীরের অংশ।”

হ্যাঁ,এটা সুস্পষ্ট যে যতক্ষণ পর্যন্ত একজন নারীর গৃহের বাইরে আসার কারণে কোন হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ সংঘটিত না হয় ততক্ষণ তার বহিরাগমনে কোন আপত্তি নেই। কখনো কোন কাজের জন্যে নারীর বহিরাগমনের দিকটা কল্যাণকর হয়ে থাকে আবার কখনো অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। কোন প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া একজন নারীর গৃহের বাইরে পর-পুরুষের দৃষ্টির সামনে নিজেকে উপস্থাপন করা অনুচিত। 

কোনো সমাজের নারীরা যদি লজ্জাশীল না হয় তাহলে তারা সম্মান ও ব্যক্তিত্ব হারায়। এ ধরনের সমাজে নারী হয়ে পড়ে কেবল দৈহিক ও যৌন আকর্ষণ সৃষ্টিকারী পণ্য।   #

পার্সটুডে/এমএএইচ/১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ