আগস্ট ২২, ২০২৩ ১৫:০৪ Asia/Dhaka

মুসলিম বিশ্বের গর্ব, সেরা দার্শনিক ও চিন্তাবিদ 'অমর মনীষী আল ফারাবি'র জীবন ইতিহাস এবং জ্ঞানবিজ্ঞানে তার নানা কর্মকাণ্ড ও অবদান নিয়ে আমাদের সাপ্তাহিক আলোচনা অনুষ্ঠানের গত পর্বের আলোচনা অনুষ্ঠানে আমরা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে আল-ফারাবির দামেস্ক ত্যাগ করে মিশর যাত্রার কথা উল্লেখ করেছিলাম।

ফারাবি মিশরে কিভাবে বা কোন অবস্থায় ছিলেন সে সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না, তবে এটা নিশ্চিত যে তিনি এই সময়কালে বই লেখা এবং বৈজ্ঞানিক বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ৩৩৮ হিজরিতে দামেস্কের শাসন ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে এবং হামেদানিয়ানরা ক্ষমতায় আসে। এরপর ফারাবি আবারো মিশর ত্যাগ করে দামেস্কে ফিরে আসেন এবং জীবনের শেষ এক বছর পর্যন্ত তিনি দামেস্কেই থেকে যান। এ সময় তিনি দামেস্কের পণ্ডিতশাসক হিসেবে পরিচিত সাইফুদ্দৌলার পূর্ণ সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। এরপর ৩৩৯ হিজরিতে ৮০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

ইরানের অন্য মনীষীদের মতো ফারাবিও গণিত, সমাজবিজ্ঞান, সঙ্গীত, চিকিৎসা, যুক্তিবিদ্যা এবং দর্শনের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। ফারাবির বেশিরভাগ রচনা ছিল যুক্তিবিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান, বিশ্বকোষ রচনা ও দর্শনের ক্ষেত্রে। ফারাবির ঝোঁক ছিল নিউ-প্ল্যাটোনিস্ট শিক্ষাকেন্দ্রের দিকে যাদের বেশিরভাগ প্রচেষ্টাই ছিল একেশ্বরবাদী ধর্মতত্ত্বের সাথে অ্যারিস্টটল ও প্লেটোর চিন্তার সমন্বয় ঘটানো।

ইসলামি দর্শনে, ফারাবিকে একজন শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফারাবিকে দ্বিতীয় শিক্ষকের উপাধি দেয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল এরিস্টটলের গ্রন্থ ও গবেষণাকর্মের ওপর তার ব্যাখ্যামূলক মূল্যবান রচনা সামগ্রী। এ কারণে তিনি পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এমনকি তার রচনা ও গবেষণাকর্ম এতোটাই সুনাম কুড়িয়েছিল যে মধ্যযুগে তার কিছু গ্রন্থ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। ফারাবি জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার যুগে ছিলেন অনন্য। বলা যায় তার সমকক্ষ কেউ ছিল না।  তিনি তার সময়ের সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে বই লিখেছেন। যেমন, রসায়ন, গণিত, ভাষা, সামরিক বিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, আইনশাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, সংগীত এবং সিভিল সায়েন্স বা নাগরিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ফারাবির রচিত গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যায়। ফারাবি তার জীবদ্দশায় একটি নতুন ও পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। অথচ প্রথম ইসলামি দার্শনিকের মর্যাদা পাওয়া আল-কিন্দি যিনি তাঁর পরে অন্যান্য চিন্তাবিদদের জন্য এ ক্ষেত্রে পথ প্রশস্ত করেছিলেন, তিনি ফারাবির মতো দার্শনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি। বিখ্যাত চিকিৎসক ও দার্শনিক ইবনে রুশদসহ অন্যান্য মুসলিম ও আরব পন্ডিতরা ফারাবির জ্ঞান গরিমায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন এবং তাকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। শেইখুর রাইস আবু আলী সিনা নিজেকে ফারাবির বিদ্যালয়ের ছাত্র বলে মনে করতেন এবং তাকে  নিজের শিক্ষকের মর্যাদায় ভূষিত করেন। ইবনে সিনা বলেছিলেন, ফারাবির ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থগুলো পড়ার কারণেই তিনি অ্যারিস্টটলের দর্শনশাস্ত্রের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন।

Image Caption

ফারাবি হিজরি তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে বসবাস করতেন। সে যুগে সামানিয়ান রাজবংশ ইরানের উপর শাসন করছিল। সে সময় এখনকার তুলনায় অনেক বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছিল ইরানের ভৌগোলিক অবস্থান।

মধ্যএশিয়া, ট্রান্স-আরব এবং আফগানিস্তানের একটি বড় অংশ ইরান ও খোরাসানের অংশ ছিল। বিশাল এই এলাকার বাসিন্দারা সবাই ছিল মুসলিম এবং ফারাবির জীবদ্দশায় তারা প্রধানত সুন্নি মুসলমান ছিল যাদের বেশিরভাগই ছিল হানাফী ও শাফেয়ী মাজহাবের অনুসারী। ফারাবির চিন্তা-বিশ্বাস ও লেখনির মাধ্যমে পাওয়া তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ফারাবি ছিলেন শিয়া মুসলিম। যদিও খুব কম সংখ্যক মানুষই তাকে ভিন্ন মাজহাবের অনুসারী বলে মনে করতো। যেমন, আল্লামা শেখ আগা বোজোর্গ তেহরানি বলেছেন, যে কেউ ফারাবি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করবে, সে বুঝতে পারবে যে ফারাবি এমন এক বিশ্বাসের অধিকারী ছিলেন যেখানে তিনি আহলে বাইতের ইমামগণকে নিষ্পাপ মনে করতেন। 

আবার কিছু গবেষক ফারাবিকে তার কিছু গ্রন্থের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে তাকে শিয়া বলে মনে করেন।  আবার কেউ কেউ এক ধাপ এগিয়ে এও বলেছেন, অ্যারিস্টটলীয় এবং নিউপ্লেটোনিক দর্শনের মিশ্রণে ফারাবির নিজস্ব শিক্ষা ও চিন্তাদর্শনে যে ইসলামিক রঙ লক্ষ্য করা গেছে তাতে শিয়া ইসনা আশআরি তথা ১২ ইমামের প্রতি বিশ্বাসের ছাপ ফুটেছে। ফরাসি প্রাচ্যবিদ হেনরি লাওস্ট বলেছেন, ফারাবি তৎকালীন মদিনার নেতা ফাজালে সম্পর্কে যে বৈশিষ্ট্যগুলোর বর্ণনা করেছেন সেই একই বৈশিষ্ট্য বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)এর উত্তরাধিকারী হিসেবে হযরত আলী (আ.)এর ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যায়।  আবদুল্লাহ নোমেহ একজন লেবানিজ শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, মদিনার প্রধানের জন্য যেসব শর্ত, সীমাবদ্ধতা ও গুণাবলীর বর্ণনা ফারাবি করেছিলেন তা বিশ্বনবী (সা.) ও শিয়া ইমামদের থেকেই এসেছে। তিনি শাসকদের সাথে মহান সৃষ্টিকর্তার আধ্যাত্মিক যোগাযোগকে একজন শাসকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত বলে বর্ণনা করেন যা থেকে শিয়া দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি তার অনুরাগের বিষয়টি ফুটে উঠে।

ফারাবি সম্পর্কে বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. জাফর আল ইয়াসিন বলেছেন, তিনি ধর্মীয় নেতা বা নগরের প্রধানকে প্রকৃতিগত সৎস্বভাবের অধিকারী হওয়ার পরামর্শ দিতেন তা কারো পছন্দ হোক বা না হোক। অবশ্য ফারাবির শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি কেবল মদিনার শাসককে উপদেশ দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না একই সাথে তার এরফানি, অতিপ্রাকৃতিক বিজ্ঞান, নৃতাত্ত্বিক এবং আইনশাস্ত্রেও শিয়া দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠে। শিয়া মাজহাবের রীতি অনুযায়ী আল ফারাবির আচরণ ও কর্মপন্থা ওই যুগের প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে মূল্যায়ন করতে হবে। কেননা ফারাবির যুগে শিয়া মাজহাবের অনুসারীরা প্রকাশ্যে নিজেদেরকে তুলে ধরতে পারতেন না। এ কারণে সে সময় ইমাম মাহদি (আ.)এর ঘনিষ্ঠ তিন সহযোগী বা প্রতিনিধি গোপনে ধর্মীয় কাজ করতেন। ওই  তিনজন সহযোগীর একজন হোসেন বিন রুহ নওবাখত ছিলেন ইরানি নওবাখত পরিবারের  সন্তান। তিনি ইমাম মাহদির প্রতিনিধি হলেও তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর সাথে সহযোগিতা বজায় রাখতেন। তিনি সরকারের ছত্রছায়ায় থাকতেন যাতে তার উদ্দেশ্য বা পরিচিতি সম্পর্কে কেউ বুঝতে না পারে। ওই সময় কিছু শিয়াদের সাথে আল-ফারাবির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা যোগাযোগ ছিল।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন  

ট্যাগ