সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩ ১৬:০৯ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি গল্প। গল্পটি এরকম:

সিন্দাবাদ নামে এক বাদশার কথা অনেকেই শুনে থাকবেন। এই সিন্দাবাদের একটা পোষা ঈগল ছিল। পোষা না বলে বরং শিকারী বলাই ভালো। বাদশা ঈগলটাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। ঈগলও ঠিক তাই। একজন আরেকজনের কাছ থেকে আলাদা হবার চিন্তাই করতো না। বাদশা সিন্দাবাদের আদেশে স্বর্ণ দিয়ে ছোট্ট একটা বাটি তৈরি করা হলো। ঐ বাটিতে পানি ভরে ঈগলের গলায় ঝুলিয়ে রাখা হতো যেন ঈগলের পানির পিপাসা লাগলেই সেখান থেকে পানি খেতে পারে।

একদিন বাদশা সিন্দাবাদ তার মন্ত্রী এবং গোলামদের নিয়ে শিকার করতে গেল। যথারীতি ঈগলটাও ছিল বাদশার সাথে। যাই হোক শিকার করতে গিয়ে যে ফাঁদ বা জাল পেতেছিল বাদশা, ঐ জালে একটা হরিণ আটকা পড়লো। বাদশার সাথে সহযোগিতা করার জন্যে যারা এসেছিল তারা হরিণটির চারপাশে বৃত্ত তৈরি করে দাঁড়ালো যাতে কোনোভাবেই জাল কেটে হরিণটা বের হয়ে যেতে না পারে। কিন্তু হরিণটা ঠিকই জাল ছিঁড়ে ফেললো এবং পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলো। বাদশা তখন চীৎকার মেরে বললোঃ খবরদার হরিণটা যে কোনোভাবেই পালাতে না পারে। যদি হরিণ পালিয়ে যায়, তাহলে যার সামনে দিয়ে পালাবে তাকে হত্যা করা হবে। 

মজার ঘটনা হলো-বাদশার কথা শেষ হতে না হতেই স্বয়ং বাদশার মাথার উপর দিয়েই লাফ দিয়ে হরিণটা পালিয়ে গেল। সিন্দাবাদের গোলামেরা চুপ মেরে গেল। তারা কোনো কথা না বলেই মন্ত্রীর দিকে তাকাতে লাগলো। মন্ত্রী আস্তে আস্তে বাদশা সিন্দাবাদের কানে কানে গিয়ে বললোঃ ‘হরিণ তো আপনার মাথার ওপর দিয়ে পালিয়ে গেছে হুজুর! এখন কী করবো’। বাদশা মন্ত্রীর কথার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলো। সাথে সাথে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হলো। চীৎকার করে বললো: 'আমি হরিণের সন্ধানে ছুটলাম। যতক্ষণ না তাকে পাকড়াও করতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত ফিরছি না’। এই বলে বাদশা ঘোড়া ছুটালো পালিয়ে যাওয়া হরিণের খোঁজে।

তাঁর যে শিকারী ঈগলটা ছিল কাঁধে বসা, সে তার বিশাল পাখা মেলে দ্রুত আগে আগে উড়ে যেতে লাগলো। উড়তে উড়তে হরিণটার নাগাল পেলো এবং তার তীক্ষ্ণধার নখর দিয়ে হরিণের চোখে আঘাত হানলো। হরিণের চোখ নষ্ট হয়ে গেল। ফলে আর পালাতে পারলো না। ততক্ষণে সিন্দাবাদও এসে পৌঁছে গেল। সিন্দাবাদ হরিণটাকে ধরে জবাই করে মাথাটা কেটে ফেললো আর মাথাহীন হরিণটাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিয়ে কিছুপথ গিয়ে একটা গাছের নিচে খানিক বিশ্রাম নিলো। কিছুক্ষণ পর দেখলো ঐ গাছটির ওপরের শাখা থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। সিন্দাবাদ এমনিতেই ক্লান্ত ছিল তদুপরি তৃষ্ণাও লেগেছিল ভীষণরকম। সেজন্যে পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে দেখে খুশি হয়ে গেল। এই খুশি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি। কেন?

বাদশা পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে দেখে তার ঈগলের গলায় ঝুলানো সোনার বাটিটা খুলে নিয়ে পানির ফোঁটাগুলো জমালো। জমাতে জমাতে যখন বাটি ভরে গেল বাদশা তখন খাওয়ার জন্য মুখের কাছে নিতেই ঈগল দ্রুত তার পাখার আঘাতে বাটিভর্তি পানি ফেলে দিলো। সিন্দাবাদ ঈগলের দিকে তাকিয়ে সদয় কণ্ঠে বললোঃ বুঝতে পেরেছি তুমিও খুব তৃষ্ণার্ত, না..? এই বলে সিন্দাবাদ বাটিটা আবার পূর্ণ করলো। এবার বাদশা বাটিটাকে ঈগলের সামনে রেখে বললোঃ আগে তুই খা, আমি পরে খাবো। কিন্তু এবারও ঈগল একই কাজ করলো। পাখার ঝাপটায় বাটির পানি ফেলে দিল। সিন্দাবাদ এবার মনে মনে ভাবলো নিশ্চয়ই তুমি চাচ্ছো সবার আগে আমাদের ঘোড়ার তৃষ্ণা নিবারণ করি, তাই না? ঠিক আছে।

সিন্দাবাদ আবারো সোনার বাটিটা ঐ ফোঁটা ফোঁটা পানিতে পূর্ণ করলো। এবার পানিভর্তি বাটিটা নিয়ে রাখলো ঘোড়ার সামনে। ঘোড়া পানিতে মুখ দেওয়ার আগেই ঈগল আবারো তার পাখার ঝাপটায় বাটি ফেলে দিলো। পানি এবারো পড়ে গেল মাটিতে। পরপর তিনবার বাটিভর্তি করেছে সিন্দাবাদ। তিনবারই ঈগল পানিভর্তি বাটি ফেলে দেওয়ায় সিন্দাবাদের ভীষণ রাগ হলো। এবার সে ঈগলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চীৎকার করে উঠে তলোয়ার দিয়ে ঈগলের পাখায় মেরে বললোঃ এই শয়তান ঈগল! তুই না নিজে পানি খেলি, না আমাকে খেতে দিলি, না ঘোড়াকে। কী পেয়েছিস তুই, আমার কষ্ট হয় না বাটি ভর্তি করতে।

ঈগলের পাখা রক্তে ভিজে গেল। তবু তার চোখদুটো কেমন যেন উদ্বিগ্ন উদ্বিগ্ন দেখালো। সেই চোখে ঈগল সিন্দাবাদের দিকে তাকালো এবং ঘাড় ফিরিয়ে গাছের দিকে ইশারা করলো। বারবার এরকম ইশারা করায় সিন্দাবাদ সেদিকে তাকালো এবং গাছের শাখায় দৃষ্টি দিলো। গাছের শাখায় দৃষ্টি দিতেই সিন্দাবাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য দেখলো সে। ভয়ংকর এক বিশাল সাপ গাছের শাখাটিকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধরে আছে। আর তার মুখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা বিষ চুঁইয়ে পড়ছে নীচে। সাপটির দিকে তাকিয়ে এক ভয়ংকর আতঙ্কে শিউরে উঠলো সিন্দাবাদ। সাথে সাথে অনুতাপে চীৎকার করে উঠলোঃ আহ।! এ আমি কী করলাম।

অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে ঈগলটাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে তার রক্তাক্ত পাখায় চুমু খেয়ে বললোঃ তুই আমার জীবন বাঁচালি আর আমি তোকে কীরকম আঘাতটাই না করলাম। এই বলে ঈগলটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত গতিতে প্রাসাদে ফিরে গেল। ক্লান্ত শ্রান্ত সিন্দাবাদ প্রাসাদে পৌঁছে ঈগলটাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লো। ঈগল তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাসগুলো নিচ্ছিলো। সিন্দাবাদ অনুশোচনাপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো আর তার পাখাগুলোতে হাত বুলাতে লাগলো। অবশেষে সিন্দাবাদের হাতেই ঈগল মারা গেল। আর সিন্দাবাদ এক জীবনের অনুতাপ বুকে নিয়ে বেঁচে থাকলো। চোখ থেকে তার ঝরে পড়লো রক্তের মতো বিন্দু বিন্দু অশ্রুর ফোঁটা।#

পার্সটুডে/এনএম/২৭/১০৩
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ