অক্টোবর ০১, ২০২৩ ১৪:৫৫ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি গল্প। গল্পটি নেওয়া হয়েছে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমির বিখ্যাত গ্রন্থ মাসনাবি থেকে। রূপকধর্মী এই গল্পটি এরকম:

একটা শিকারী বাজপাখি একদিন তার পথ ভুলে গিয়ে একটা বিরান প্রান্তরে গিয়ে হাজির হয়। বাজপাখির কথা তো আপনারা নিশ্চয়ই জানেন। রাজা-বাদশারা তাদের শান-শওকত বৃদ্ধির জন্য এই বাজপাখি পালতো।

তো পাখিটি যেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো সেখানে বাস করতো পেঁচার দল। পেঁচারা তো শিকারী বাজপাখিকে দেখেই হতবাক হয়ে গেল। সবাই ভয়ও পেয়ে গেল এবং একত্রিত হয়ে বাজপাখিটিকে ঘিরে ধরলো। বাজপাখির ঠোঁট এবং নখর খুবই ধারালো। আবার তার পাখাও বেশ হালকা। হুট করেই উড়াল দিয়ে শত শত মাইল দূরে চলে যেতে পারে। সুতরাং পেঁচারা তাকে দেখে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই তারা পরস্পরে বলতে লাগলো: এই বাজপাখিটি নিশ্চয়ই আমাদের জায়গা দখল করতে এখানে এসেছে। আমাদেরকে আমাদের বাসা থেকে বিতাড়িত করতেই এসেছে সে। সুতরাং তারা সকলে মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিলো।

পেঁচারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো এই বিপদ থেকে বাঁচতে হলে বাজপাখির ওপর অতর্কিত হামলা করতে হবে। তারা দলবদ্ধভাবে তাই করলো এবং অকথ্য ভাষায় কুরুচিপূর্ণ কথা বললো। বাজপাখি তো এমনিতেই পেঁচাদের দেখতে পেয়ে বিরক্ত হচ্ছিলো এখন বাজে কথাবার্তা শুনে তার আরও খারাপ লাগলো। সে তাই চীৎকার করে বলে উঠলো: তোমাদের সঙ্গে কিংবা তোমাদের এই বিরান প্রান্তরে আমার কোনো কাজ নেই। আমি বাদশার প্রাসাদে বসবাস করি। তোমরা বিরক্ত হয়ো না, ভয় পেও না। আমি এখানে থাকতে আসি নি। আমি অবিলম্বে আমার বসবাসের জায়গা রাজপ্রাসাদে ফিরে যাবো। তোমাদের কাছে এই জায়গাটি অনেক বেশি মূল্যবান। কিন্তু আমার কাছে খুব একটা মূল্যবান নয়। অতএব তোমরা বিচলিত হয়ো না। আমি এখান থেকে চলে যাবো।

কিন্তু পেঁচারা বাজপাখির কথা মেনে নিতে পারলো না। তারা বললো: এটাও তোমার আরেকটা অপকৌশল। এই যে তুমি রাজপ্রাসাদের গল্প মারাচ্ছো এটাও আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে আমাদের জায়গা দখল করার ফন্দি। তা না হলে বাদশাহ কি বেকার নাকি যে একটা বাজপাখি পালবে, তাকে সহায়তা করবে! আহা! বাদশা কি এখন তোমার খোঁজে তার বাহিনী পাঠিয়েছে? কোনো বিবেকবান মানুষ এ ধরনের কথাবার্তা বিশ্বাস করবে না। তোমার সব কথাই মিথ্যা, বানোয়াট। তোমার কথা যে বিশ্বাস করবে সে গাধা ছাড়া আর কিছু নয়। তোমার মতো একটা হালকা পাতলা পাখিকে কেন বাদশাহ তার মাহফিলে জায়গা দেবে?

বাজপাখি তো পড়ে গেল মহা সমস্যায়। এইসব মূর্খ পেঁচাদের কে বোঝাবে, কেমনে বোঝাবে। কী করে সে এখন এই মূর্খদের জাল থেকে রেহাই পাবে? বাজপাখি খুব শান্তভাবে পেঁচাদের বললো: তোমার উত্তেজিত হয়ো না! তোমাদের কারণে যদি আমার একটি পালও ঝরে পড়ে তাহলে আমার মনিব তোমাদের বসবাসের জায়গা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বিরান করে দেবে। তোমরা তো পেঁচা। আমার সমগোত্রীয় কোনো বাজপাখিও যদি আমার ওপর কোনোভাবে অত্যাচার করে তাহলে বাদশাহ হাজারটা বাজপাখিকে মেরে প্রতিশোধ নেবে। বাদশাহ আমাকে এরকমই ভালোবাসে। যেখানেই যাই সেখানেই আসে সে। কারণ সে-ই আমাকে উড়তে বাধ্য করে। আমি আকাশের উর্ধ্বে উড়ে উড়ে দিগন্তের পর্দা ছিঁড়ে ফেলি। হোমার মতো লম্বা পাখিও আমাকে উড়তে দেখে অবাক হয়ে যায়। সুতরাং একটি পেঁচা কী করে আমার গৌরব ও মর্যাদার রহস্য খুঁজে বের করবে?

পেঁচার দল বাজপাখির কথা শুনছিলো। বাজ বলতে লাগলো: সেই পেঁচা ভাগ্যবান যে আমার আমার উড়াল নিয়ে এবং আমার সৌভাগ্যময় অবস্থান নিয়ে চিন্তা করবে। তোমরা যদি বুঝতে বাদশাহর সাথে যার সম্পর্ক এবং নৈকট্য রয়েছে সে যেখানেই যাক না কেন অপরিচিত নয়। হ্যাঁ, তোমরা ঠিক বলেছো-আমি রাজা নই। আমি কেবল তার প্রিয় শিকারী পাখি। তিনি  অনেক শক্তিমান এবং আমি অতি সামান্য। তবে রাজার ভালবাসার কারণে তাঁর মহানুভবতা এবং মর্যাদার ছিটেফোঁটা আমার ওপর ফেলেছে। সেই আলো এবং তাঁর করুণার ছায়ায় আমি সম্মানিত হয়েছি। তোমরাও এই অবস্থান এবং পদে পৌঁছাতে পারো। সবকিছু তোমাদের প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করে।

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! মাসনাবির গল্পকার মাওলানা রুমি এই গল্পের মধ্য দিয়ে আমাদের অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি ইঙ্গিতে বলেছেন যে পেঁচাদের মতো পাখিরাও যদি বাদশাহকে ভালোবাসতো, তার সেবায় আন্তরিকভাবে নিয়োজিত হতো তাহলেও তারাও বাজপাখির মতো সম্মান ও মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে। বাদশাহর সাহচর্যে মর্যাদা ও সম্মানজনক পদে উত্তীর্ণ হয়ে শাহবাজ হয়ে যাবে। তাদের সমস্ত দৈন্যতা, কদর্যতা এবং নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও রাজার দরবারে যাবার পথ তৈরি হবার সুবাদে তারা মর্যাদার সুউচ্চ আকাশে ওড়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে। এখানে যে বাদশাহর কথা বলা হলো সেই বাদশাহ আসলে মহান সৃষ্টিকর্তা। এই ভালোবাসা এবং সেবার অবিনশ্বর শক্তি পেঁচাকে বাজপাখি আর বাজপাখিকে শাহবাজে পরিণত করে।

পৃথিবীর সকল বিষয়, প্রতিটি উত্থান-পতন, প্রতিটি মর্যাদা ও অপমান, কোন কারণ ছাড়া হয় না। পৃথিবী একটা নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে চলে। তারাই ধন্য ও সৌভাগ্যবান যারা সঠিক পথে চলে এবং বিশ্বের নিয়ম-শৃঙ্ক্ষলা মেনে চলে। আর দুর্ভোগ তাদের যারা স্রষ্টার সৃষ্টিকূলের নিয়ম অমান্য করে বিশ্বের শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করে। মূল পথ  হলো প্রেম ও সেবার পথ।#

পার্সটুডে/এনএম/১/১০৬

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

 

ট্যাগ