অক্টোবর ১০, ২০২৩ ১৫:২৩ Asia/Dhaka

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: 'পাহাড়কে প্রয়োজন নেই পাহাড়ের,মানুষকে প্রয়োজন মানুষের'। এই প্রবাদের পেছনে একটি গল্প আছে। গল্পটি এরকম:

পাহাড়ের ঢালে দুটি গ্রাম ছিল। একটি গ্রাম উপত্যকায় মানে কিছুটা উপরে অপরটি সমতলে মানে বেশ নীচুতে। গ্রাম দুটি তাই উঁচু গ্রাম আর নীচু গ্রাম নামে পরিচিত ছিল। উঁচু গ্রামের পাথরের বুক চিরে পানি চুঁইয়ে ফোয়ারার মতো তৈরি হতে হতে ঝরনা প্রবাহ তৈরি হয়েছিল। সেই ঝরনার পানি উঁচু গ্রামের ভেতর দিয়ে নীচু গ্রামেও যেত।

উঁচু গ্রামের লোকেরা ওই ঝরনার পানি নিজেরাও খেত, গোসল করতো এবং তাদের কৃষিকাজ, বাগ-বাগিচার চাহিদাও মেটাতো। পানি এতোবেশি ছিল যে দুই গ্রামের মানুষ নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর নীচের সমতল ভূমির দিকে খাল কেটে প্রবাহিত করে দিত। একদিন উঁচু গ্রামের প্রধানের মাথায় একটা শয়তানি চিন্তার উদ্রেক হলো। সে মনে মনে ভাবলো: নীচু গ্রামের ঘরবাড়ি, কৃষিজমিগুলোকে কী করে বিনামূল্যে দখল করা যায়! সে জানতো ঝরনার পানি যদি নীচু গ্রামে না যায় তাহলে ওই গ্রামের লোকজন, কৃষক, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সকলেই হয়তো তৃষ্ণায় মারা যাবে অথবা গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। সুতরাং তাদের জমিজমা পড়ে থাকবে আর সে ধীরে ধীরে সেগুলোকে দখল করবে। এই শয়তানি চিন্তা থেকে সে তার গ্রামের লোকজনকে একদিন জড়ো করলো। 

লোকজনকে জড়ো করে গ্রাম-প্রধান বললো: এই ঝরনার পানির উৎস যে পাহাড় সেটি আমাদের গ্রামে অবস্থিত। তার মানে এই পানি আমাদের। নীচু গ্রামের মানুষেরা বছরের পর বছর ধরে এই পানি ব্যবহার করে এসেছে। কোনোদিন একটু ধন্যবাদও দেয় নি। তা নিয়ে কথা নেই। কিন্তু এখন থেকে আমরা তাদেরকে আর আমাদের পানি ব্যবহার করতে দেবো না। আল্লাহ চাইলে তাদের গ্রামেও এরকম একটা ঝরনা তৈরি হতো। উঁচু গ্রামের লোকজন গ্রাম-প্রধানের কথা শুনলো কিন্তু তার উদ্দেশ্যটা বুঝে উঠতে পারলো না। তাই কেউ বললো না যে ঝরনার পানির তো অভাব নেই, নীচু গ্রামের লোকজন আগের মতো্ পানি ব্যবহার করলে ক্ষতি কী? গ্রাম প্রধানের কথায় উঁচু গ্রামের বাসিন্দারা বেলচা-কোদাল নিয়ে একটা খাল কেটে ঝরনার পানি ভিন্নদিকে প্রবাহিত করে দিলো। নীচু গ্রামের লোকজন আর পানি পেল না। তারা যখন দেখলো যে তাদের খালের পানি শুকিয়ে গেছে, খাবার পানি নেই জমিচাষের পানি নেই। তাদের গ্রাম-প্রধানকে তারা জানালো।

গ্রাম-প্রধান ক'জনকে সঙ্গে নিয়ে খালের পাড় ধরে উঁচু গ্রামে গিয়ে সেখানকার গ্রাম-প্রধানের মুখোমুখি হলো। কথা বললো এবং অনুনয়-বিনয় করেও কোনো লাভ হলো না-নীচু গ্রামকে পানি দিতে রাজি হলো না। উল্টো বরং অহংকারের সঙ্গে বললো: ব্যাপারটা কী জানো! উঁচু গ্রাম পাহাড়ের উপরে এবং নীচু গ্রাম থেকে উন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ। দুটোই যদিও গ্রাম তারপরও একরকম নয়। অনেকটা যেমন এক পাহাড় আরেক পাহাড়ের সঙ্গে মেলে না। আসলে উঁচু গ্রামের সঙ্গে নীচু গ্রামের তুলনাই হয় না। নীচু গ্রাম-প্রধান এবার মুখ খুললো। বললো: আপনার কথাটা ঠিক নয়। আমাদের গ্রামটা গ্রাম পাহাড় নয়। তবু ধরে নিলাম পাহাড়ই। আর পাহাড়ের মিল নাও হতে পারে কিন্তু মানুষে মানুষে ঠিকই মিল হয়ে যায়। সুতরাং পানি আগের মতোই দুই গ্রামেরই বাসিন্দাদের হাসিখুশির জন্য ছেড়ে দিন। ওই পানি দুই গ্রামের মানুষের মধ্যকার বন্ধুত্বের উৎস হয়ে থাকুক। 


জি, আলোচনায় কোনো কাজ হলো না। অগত্যা নীচু গ্রামের লোকেরা দুই-তিন দিনের মতো পানিশূন্য অবস্থায় কষ্টে কাটালো। খাওয়ার পানির জন্য অনেক দূরে গিয়ে কিছুটা সংগ্রহ করতো। কিন্তু ওই অবস্থা চলতে থাকলে চাষের জমিজমা শুকিয়ে বিরান হয়ে যাবে আর পশুগুলো তৃষ্ণায় মারা যাবে। তারা তাই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিলো। এমন পরিস্থিতিতে তাদের গ্রাম-প্রধান সবাইকে ডেকে বললো: পানি ছাড়া আমরা বাঁচতে পারবো না। সুতরাং আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটা কাজ করবো। তাহলে এই সংকট থেকে মুক্তি পাবো। আমরা কয়েকটি কূপ খনন করে একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ স্থাপন করবো। তাহলে একটা খাল তৈরি হবে এবং নিশ্চিতই ওই খাল পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। পাহাড়ের হৃদয়টা পানিতে পূর্ণ। সেখান থেকেই উঁচু গ্রামের পানির ধারা তৈরি হয়েছে। কূপ খনন করলে আমরাও পানি পাবো। 

গ্রাম-প্রধানের কথায় সকলেই রাজি হলো এবং উৎসুক্যের সঙ্গে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিজ নিজ কাজ ফেলে রেখে সবাই কূপ খননের কাজে লেগে গেল। অল্প সময়ের মধ্যেই কূপ খনন হয়ে গেল এবং মাটির নীচ দিয়েই কূপগুলো একটার সঙ্গে একটার সংযোগ স্থাপন হলো। এভাবে বেশ লম্বা একটা খাল তৈরি হয়ে গেল। ওই খালে যে পরিমাণ পানি আসতে শুরু করলো তা উঁচু গ্রাম থেকে আসা পানির তুলনায় অনেক বেশি। নীচু গ্রামবাসীরা তাদের জমিজমায় পানি দিলো। তাদের পশুগুলোকে পানি খাওয়ালো। এভাবেই অল্প সময়ের মধ্যে নীচু গ্রামে আবার হাসি-খুশি ফিরে এলো। উঁচু গ্রামের লোকজন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। তাদের পানিভর্তি খাল আর ঝরনা শুকিয়ে গেছে। এক ফোঁটা পানিও সেখানে অবশিষ্ট নেই। সবাই গেল তাদের গ্রাম-প্রধানের কাছে। গ্রাম-প্রধান তদন্ত করে বুঝতে পারলো নীচু গ্রামের লোকজন খাল খনন করার কারণে মাটির নীচের পানি সেখানে চলে গেছে। এ কারণে উঁচু গ্রামের খালগুলো শুকিয়ে গেছে। এই কথা জানাজানি হবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামবাসীরা গ্রাম-প্রধানের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। সবাই বললো: তোমার কারণেই আজ আমাদের এই দুরবস্থা। তুমি দুই গ্রামের মানুষজনকে আগের মতো পানি ব্যবহারে উপকৃত হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছো বলে আজ এই অবস্থা। তাকে নিয়ে সবাই নীচু গ্রামে গেল ক্ষমা প্রার্থনা করতে। অহংকারী গ্রাম-প্রধান শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চাইলো। 

উঁচু গ্রাম-প্রধান বললো: তোমরা যে কূপ খনন করে খাল তৈরি করেছো সেই কারণে আমাদের ঝরনা আর খালের পানি শুকিয়ে গেছে। আমাদের প্রতি দয়া করুন। তোমাদের খাল থেকে কিছু পানি আমাদের গ্রামে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। নীচু গ্রাম-প্রধান হাসতে হাসতে বললো: পানি তো উঁচু থেকে নীচুতে যায়, নীচু থেকে উঁচুতে যায় না। আপনাদের অনুরোধ রাখা তাই সম্ভব না। দেখেন না-দুই পাহাড় পরস্পরের প্রয়োজন না থাকলেও মানুষের একে অপরের প্রয়োজন পড়ে। তারপর থেকে, যখনই কেউ বলতে চায় যে মানুষের একে অপরের প্রয়োজন। তাই একে অপরকে আঘাত করা উচিত নয়। তখনই এই প্রবাদটি ব্যবহার করে বলে: পাহাড়কে পাহাড়ের প্রয়োজন নেই কিন্তু মানুষকে মানুষের প্রয়োজন পড়ে।#

পার্সটুডে/এনএম/১০/১১১

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ