অক্টোবর ১৫, ২০২৩ ১৪:৪৬ Asia/Dhaka
  • প্রাচীন ইরানি গল্প: ঘুমন্তের মুখে সাপ আর অশ্বারোহীর কৌশল

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজ আমরা শুনবো ইরানের প্রাচীন একটি গল্প। গল্পটি নেওয়া হয়েছে মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি'র বিখ্যাত গ্রন্থ মাসনাবি থেকে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন গল্পটি অবশ্যই রূপক মানে ঘটনার বাস্তবতার চেয়ে প্রতীয়মান অর্থটাই মুখ্য। গল্প শুনে ভাবতে হবে এবং অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে। এবারে চলুন গল্প শুরু করা যাক।

একজন বিজ্ঞ লোক ঘোড়ায় চড়ে রওনা হলো তার পথে। দূর থেকে সে দেখতে পেলো একটা লোক গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মুখটা হা করে খোলা আর একটা সাপ তার মুখের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছে। এই বিপদ দেখে বিজ্ঞ লোকটি আরও দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে তার কাছে যাবার চেষ্টা করলো। কারণটা হলো যদি দ্রুত ঘুমন্ত লোকটির কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারে তাহলে চেষ্টা করার একটা অবকাশ তৈরি হবে যাতে সাপটা তার মুখের ভেতর দিয়ে পেটে ঢুকে যেতে না পারে। কিন্তু না, দু:খজনকভাবে ঘোড়সওয়ার যখন ঘুমন্ত লোকটির কাছে গিয়ে পৌঁছলো ততক্ষণে সাপটি তার মুখের ভেতর দিয়ে গলায় ঢুকে পেটে চলে গেল। কিছুই আর করার সুযোগ থাকলো না। 

বিজ্ঞ লোকটি ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে নেমে এলো। চারদিক তাকিয়ে একটা লাঠি খুঁজে পেলো এবং ওই লাঠি দিয়ে ঘুমন্ত লোকটাকে পেটাতে শুরু করে দিলো। তার হাতে-পায়ে, উরুতে, শরীরে ব্যাপক পেটাতে লাগলো। মারাত্মক পিটুনি খেয়ে ঘুমন্ত লোকটির ঘুম ভেঙে গেল এবং ভয়ে সে কোনোরকমে উঠে দৌড়াতে শুরু করলো। সে বুঝে উঠতে পারছিলো না তাকে কে এবং কেন এভাবে নির্দয়ভাবে পেটালো। দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত হয়ে গেল লোকটি। একদিকে ক্লান্ত-শ্রান্ত অপরদিকে পেটানোর ব্যথায় পা আর চলছিল না তার। পাশেই ছিল একটা আপেল গাছ। ওই আপেল গাছটার নীচে ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল সে। 

মাটিতে পড়েও পার পেল না সে। ঘোড় সওয়ার বিজ্ঞ লোকটি সেখানেও উপস্থিত হলো। আপেল গাছটার নীচে বেশ কিছু আপেল পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞ লোকটি মার খাওয়া লোকটিকে বললো সেই নষ্ট আপেলগুলো তাড়াতাড়ি খেতে। ওই আপেল কি খাওয়া যায়! লোকটা আপেলগুলোর দিকে তাকাতেই বিজ্ঞ ভদ্রলোক আদেশ দিলো: দ্রুত খেয়ে শেষ করো আপেলগুলো। ভয়ে ভয়ে এবার সে নষ্ট আপেল খেলো। সেগুলো খেয়ে তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। সে এবার প্রতিবাদ করে বললো: কে তুমি? কেন আমার সঙ্গে এরকম খারাপ আচরণ করছো? মারছো, পঁচা আপেল খেতে বাধ্য করছো? কী করেছি আমি তোমার সাথে?

বিজ্ঞ লোকটি অসুস্থ লোকের কথায় কানই দিলো না। কার কাজের কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে চীৎকার করে বললো: বাকি আপেলগুলো খাও আর দৌড়াও! কোনো কথা বলো না! পঁচা আপেল খেয়ে এমনিতেই লোকটার বুক ব্যথা, পেট ব্যথা করছিল। তাছাড়া মার খাওয়ার কারণেও সারা শরীর জখম হয়ে ব্যথা করছিল বেচারার। দৌড়ানো দূরে থাক হাঁটতেও পারছিল না সে। বারবার পড়ে যাচ্ছিলো মাটিতে। মার খাওয়ার ভয়ে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছিল। এভাবে পড়তে পড়তে, উঠতে উঠতে দৌঁড়ানোর চেষ্টা করছিল লোকটি। অবশেষে তার বমির ভাব হলো এবং ব্যাপক বমি করে দিলো। পেটের ভেতর যা কিছু গিয়েছিল সব বেরিয়ে এলো বমির সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই যে সাপটি তার পেটে ঢুকে পড়েছিল সেই সাপটিও বেরিয়ে এলো।

ওই সাপের ওপর চোখ পড়তেই মার খাওয়া লোকটি ঘোড়-সওয়ার বিজ্ঞ লোকের আচরণের হেতু বুঝতে পারলো। ধীরে ধীরে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো: অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি তো আমার জন্য রহমতের ফেরেশতা হয়ে এসেছেন। আপনি আমাকে নতুন জীবন পেতে সাহায্য করেছেন। আপনি আসলে আমার মায়ের মতো মমতার আধার। মা যেরকম তার সন্তানকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন নিশ্চিন্তে করে যায় আপনিও সে কাজটিই করেছেন। কিন্তু আমি এক বোকা সন্তানের মতো আপনার হাত থেকে বাঁচার জন্য দৌড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। অনেকটা সেই গাধার মতো।

সাপ খাওয়া লোকটা নিজেকে গাধার সঙ্গে তুলনা করে বলছিল: বোকা গাধা প্রান্তরে তার মনিবের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে বেড়ায়। অথচ গাধার মালিক তাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যায়, তবু খুঁজে বেড়ায়। কেন? কারণ হলো তাকে বিপদের হাত বাঁচিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এভাবে প্রান্তরে ছুটে বেড়ালে বাঘ, নেকড়ে, হায়নারা তাকে মেরে খেয়ে ফেলতে পারে। এই আশঙ্কায় গাধার মনিব গাধাকে খুঁজতে খুঁজতে দিক-বিদিক ছুটে বেড়ায়। এই ছুটে বেড়ানোর পেছনে গাধার মনিবের কোনো স্বার্থ নেই বরং স্বার্থ যা কিছু আছে তা গাধার নিজের। কেননা এটা তার জীবন-মরণের প্রশ্ন। কিন্তু দু:খজনক বিষয়টি হলো গাধা তার স্বার্থটা বোঝে না।

মার খাওয়া লোকটি আরও বললো: আপনিও আমার জন্য নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে আমার উপকার করেছেন। আপনি কেন এই আচরণ করেছেন তার রহস্যও আমাকে বলেন নি। আমাকে পেটানো কিংবা পঁচা আপেল খাওয়ানোর কারণ যদি আগে বলতেন তাহলে আমি ভয় পেয়ে যেতাম। এমনকি আতঙ্কে হয়তো স্ট্রোক করে মরেই যেতাম। ঘোড়-সওয়ার লোকটি বললোন: হ্যাঁ! আমি যদি বিন্দুমাত্রও বলতাম কীরকম সাপ তোমার পেটে ঢুকেছে তাহলে তৎক্ষণাৎ তুমি মারা পড়তে। সেজন্য তোমাকে বাঁচাতে যা কিছু করা উচিত ছিল বলে মনে করেছি তাই করেছি। পেট থেকে সাপটাকে বের করতেও যা করা প্রয়োজন মনে করেছি, তাই করেছি। যাই হোক! আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই যে শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছি।#

পার্সটুডে/এনএম/১৫/১১২

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ