অক্টোবর ৩০, ২০২৩ ২০:৪৯ Asia/Dhaka

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি হামলা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বের সবার দৃষ্টি এখন সেদিকে। এরইমধ্যে গাজায় ইসরাইলি সেনাদের হামলায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে যার মধ্যে বেশিরভাগই শিশু ও নারী। সেখানে খাদ্য, ওষধু ও পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এরইমধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব যুদ্ধ বন্ধের আহবান জানালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিরোধীতা করেছে।

তো এ বিষয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড.ইমতিয়াজ আহমেদের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বললেন, গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি হামলা সুস্পষ্ট জেনোসাইড- গণহত্যা ও যুদ্ধপরাধ। আজ কিংবা কাল নেতানিয়াহুসহ যারা এই যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে ও বিচার হবে।

ড. ইমতিয়াজ বললেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা যারা ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এটি তারা কতদিন ধরে রাখতে পারবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। হামাস এর চেয়েও বড় হামলা চালাতে পারে ইসরাইলে। ইসরাইলিরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এমনকি অনেকে ইসরাইল ছেড়ে চলে গেছে। অনেক দেশ তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়েছে।

বিশিষ্ট এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আরও বলেন, পশ্চিমাদের সর্বশেষ কলোনিয়াল স্টেট ইসরাইল রাষ্ট্রটি টিকে থাকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে দুই রাষ্ট্র সমাধানের সুত্রই কেবল এই সংকট কাটতে পারে। আর এটি নির্ভর করছে পুরোটাই আমেরিকার ওপর।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের নির্বিচার হামলা অব্যাহত রয়েছে, হাসপাতালে হামলায় বহু মানুষ মারা গেল নির্মমভাবে। এখন স্থল ও বিমান হামলা চালাচ্ছে তারা। তো গাজা পরিস্থিতি নিয়ে আপনি কি বলবেন।

গাজায় চলছে গণহত্যা

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: গাজা পরিস্থিতি নিয়ে কয়েকটি বিষয়ের উপর আমি গুরুত্ব দেব। তারমধ্যে অন্যতমটি হচ্ছে ফিলিস্তিনের গাজায় রীতিমতো গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইলি সেনারা। জেনোসাইডের যে সংজ্ঞা তার পুরোটাই এই যুদ্ধে দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ ইসরাইল গাজাতে যা করছে সেটি গণহত্যা (জেনোসাইড)। আর এটি শুধু আমরা বলছি বললে ভুল হবে। পশ্চিমা দেশ থেকে শুরু করে অষ্ট্রেলিয়ার গ্রিন পার্টি এবং আমেরিকার সাধারণ মানুষ একথা বলছে। শুধু তাই নয়- একাধিক ইহুদি লেখকও বলছেন এটি জেনোসাইড; Crime against humanity.

রেডিও তেহরান: জনাব, বলা হচ্ছে গাজায় গণহত্যা চলছে, যুদ্ধপরাধ করছে ইসরাইল..

গাজা যুদ্ধ

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: জ্বি গণহত্যা বা জেনোসাইডের সংজ্ঞার মধ্যেই আন্তর্জাতিকভাবে লিপিবদ্ধ আছে এটি যুদ্ধপরাধ। আর গাজা যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের সাথে জড়িত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুসহ অন্যদের আজ না  হয় কাল তাদের বিচারের আওতায় আসতে হবে। যারা বলছে গাজাকে নিশ্চিহ্ন করে দেব, সেখানে যাদের হত্যা করা হচ্ছে তারা প্রাণীমাত্র (Animal) এসব কথাও কিন্তু গণহত্যার অপরাধের শামিল। তো আজ না হয় কাল এ বিষয়ের উপর মামলা হবে; মামলা না হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। এই গাজায় ইসরাইলি হামলাকে বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন স্কলার বলছে এটি জেনোসাইড। এটি যে শুধু মুসলিম বিশ্ব থেকে বলা হচ্ছে সেটা না। পৃথিবী জুড়ে একাধিক স্কলার একে গণহত্যা বলছে।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ, এই ইসরাইল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে এবঙ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা তাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এটা কি তারা ধরে রাখতে পারবে বা কতদিনই বা ধরে পারবে বলে আপনার মনে হয়?

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: দেখুন, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা যারা ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এটি তারা কতদিন ধরে রাখতে পারবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তারা যে কাঠামোর কথা বলে-গণতন্ত্র, মানবাধিকার সেটা গাজায় একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে।  আমার মনে হয় গাজায় এই হত্যার বিষয়টি এখনই থামানো দরকার। আমরা আরব লীগের সভায় সৌদি আরবের যে অবস্থান বা ভাষা তা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাদের বোডি ল্যাংগুয়েজে পরিবর্তন এসেছে ফিলিস্তিন ইস্যুতে। তারা বড় আকারে এই সংকটের সমাধান চাচ্ছে। সিরিয়াও সেখানে ছিল।  এতদিন মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশ আমেরিকার কথাবার্তায় ওঠাবসা করছিল তাদের অবস্থানের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা বোধহয় আর সেটা ধরে রাখতে পারছে না। এখন কীভাবে বিষয়টিকে সামনে এনে সমাধানে যাওয়া যায় সেটাই দেখার বিষয়।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ, হামাস কেন আগে ইসরাইলে হামলা চালাল-এই প্রশ্ন তুলছে পশ্চিমারা। আপনি কি বলবেন?

গাজায় ইসরািল বিমান হামলা

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: দেখুন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যেকোনো নাগরিক কিংবা শিশুর ওপর যখন আক্রমণ হয় সেটি নিন্দনীয় আর একথা সবাই বলছি। কিন্তু দেখা দরকার কেন হামস ইসরাইলে হামলাটি চালাল? অর্থাৎ এই পর্যায়ে কেন তারা হামলা চালাল। অনেকে একথাও বলছে ইসরাইলি গোয়েন্দারা বিষয়টি বুঝতে পারেনি যে হামাস এভাবে হামলা চালাবে। তারা জানত হামলা হবে এবং ছোট খাট হামলা তো হচ্ছিলো কিন্তু এত বড় হামলা হামাস চালাবে সেটি ইসরাইলের কাছে একটি বড় ধাক্কা। তবে ফিলিস্তিনের কাছে এই যুদ্ধ ছিল প্রতিদিনের; প্রতিটি মুহূর্তের। পাল্টা হামাসের পক্ষ থেকে ছোট খাট রকেট ছোড়ার বিষয়টি ইসরাইলিরা নর্মাল হিসেবে নিচ্ছিল। কিন্তু এত বড় আকারে যে হবে সেটি তারা ভাবতেও পারেনি। তবে হামাসের এই হামলার মাধ্যমে এটাও পরিস্কার যে ভবিষ্যতে এই ধরনের কাঠামো যদি ইসরাইল বা পশ্চিমা দেশ রাখতে চায় তাহলে এরচেয়েও বড় হামলা হবার সম্ভাবনা আছে। আর এ কারণে মূল ইসরাইলের জনগণ এই প্রথমবার তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। বেশ কিছু ইসরাইলি নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে চলে গেছে ইসরাইল ছেড়ে। বেশ কিছু দেশ তাদের মানষদের সরিয়ে নিয়েছে। ৯০০ শ'র মতো বৃটিশ নাগরিক দেশে ফিরে গেছে। ভারতও তাদের জনগণকে সরিয়ে নিয়েছে। যার ওপর নির্ভর করে ইসরাইল রাষ্ট্রটি ছিল সেটি হচ্ছে কলোনিয়াল সেটেল্টমেন্ট।

রেডিও তেহরান: আপনি যে বললেন, ইসরাইল রাষ্ট্রটি হচ্ছে ইউরোপীয়ান শেষ কলোনিয়াল সেটেল্টমেন্ট- তো এই রাষ্ট্রটি কি টিকে থাকবে? বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যহত হবে কি না?

গাজা!

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: ঠিকই বলেছেন আপনি, ইসরাইল রাষ্ট্রটি ইউরোপিয়ানদের সর্বশেষ কলোনিয়াল সেটেল্টমেন্ট। কিন্তু এটি ব্যহত হবে। কারণ এই হামলা এইই শেষ নয়; ভবিষ্যতেও হবে। ফলে ইসরাইলিরা আগে যেটি ভাবত তাদের ভেতরের নিরাপত্তা আছে ফলে বাইরে কি হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু এখন সেই ধারনাটি পুরো পাল্টে গেছে। ফলে ভবিষ্যতে মাইগ্রেশন ফ্লো তারা আর রাখতে পারবে না। ফলে ইসরাইলের এই কাঠামো ধরে রাখাও অসম্ভব হয়ে উঠবে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে দুই রাষ্ট্র সমাধানের যে বিষয়টি আছে সেখানে যত তাড়াতাড়ি যেতে পারবে ততই এই ইস্যুর সমাধান হবে। আর নেতানিয়াহু কতদিন ক্ষমতায় থাকবে তা নিয়েও সন্দেহ আছে! আমার মনে হয় কাঠামোটাতে একটু পরিবর্তন হলেই নেতানিয়াহুকে বিদায় নিতেই হবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তার পরে যিনি আসবেন তিনি কতখানি দুই রাষ্ট্রের কাঠামোতে যাবেন!  তবে দুই রাষ্ট্র কাঠামো ছাড়া এর অন্য কোনো সমাধান নেই।

রেডিও তেহরান: সামগ্রিক বাস্তবতায় এই যুদ্ধ কি সমাধানের দিকে যাবে?

গাজার করুণ পরিস্থিতি

অধ্যাপক ড.ইমতিয়াজ আহমেদ: একটা সমাধান খুবই জরুরি। তবে আমার মনে হয় বড় আকারে এই ইস্যুর সমাধানটা একেবারেই আমেরিকার হাতে। আজকে আমেরিকা প্রতিদিন ইসরাইলকে দশ মিলিয়ন ডলার দেয় সেখানকার নিরাপত্তার জন্য। বছরে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। আমেরিকা যদি সেটা বন্ধ করে দেয় তাহলে কিন্তু ইসরাইলের পরিবর্তন হবে এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যেও পরিবর্তন হবে।  আর এটি এসম্ভব এখন এই কারণে যে পৃথিবী এখন আর এককেন্দ্রীক বলয়ের মধ্যে নেই। পৃথিবী এখন মাল্টিপোলার পৃথিবীর দিকে যাচ্ছে। যেখানে একাধিক দেশ ক্ষমতা রাখে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে সম্পর্ক সৃষ্টির। যেটি আমরা দেখেছি চীনের মাধ্যমে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক। এই বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্যে একটা মৌলিক পরিবর্তন আনতে বাধ্য। তবে হ্যা একথা সত্য যে আমেরিকা আর ইসরাইল এটাকে ভাঙার চেষ্টার করবে। কিন্তু বর্তমানে ইসরাইল-ফিলিস্তিন যে যুদ্ধ চলছে তারফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সেই চেষ্টা সফল হওয়া আর সম্ভব হবে না। বরং ইরান-সৌদি আরব সম্পর্কটা আরও বাড়বে। তারা ফিলিস্তিনিদের যে দাবি সেই দাবি পূরণের জন্য একাত্ম হবে। ফলে সেখানে এখনও সমাধানের পথ আছে। তবে সেটি যদি না করে সেক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলোর কাঠামো প্রশ্নবিদ্ধ তো হয়েই গেছে আরও প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং পরিবর্তন আসবে। তখন তাদের কাঠামোটা ধরে রাখাটাই মুশকিল হবে। আর সেই জায়গায় পশ্চিমা জনগণ এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ওপর আমরা ভরসা আছে। আমার মনে হয় তারাও চাইবে যেন সেই জায়গায় পরিস্থিতিটা না যায়। ফলে ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংকটের একটা সুষ্ঠু সমাধান বিশেষ করে দুই রাষ্ট্র পদ্ধতিতে গিয়ে এই সমস্যার সমাধান হয়তো সম্ভব।#

সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বের পুরোটাই তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৩০

ট্যাগ