কুরআনের আলো
সূরা আল-মুনাফিকুন: ১-৬ (পর্ব-১)
আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা জুমার আলোচনা শেষ করেছি। কাজেই আজ আমরা এর পরের সূরা অর্থাৎ সূরা মুনাফিকুনের সংক্ষিপ্ত তাফসির শুরু করব। মদীনায় নাজিল হওয়া এই সূরায়ও ১১টি আয়াত রয়েছে। নিফাক বা কপটতা এবং মুনাফিকদের পরিচয় তুলে ধরা হচ্ছে এই সূরার মূল প্রতিপাদ্য। প্রথমেই সূরাটির ১ ও ২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
تَّخَذُوۡۤا اَیۡمَانَهُمۡ جُنَّۃً فَصَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ اِنَّهُمۡ سَآءَ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ (১)اِذَا جَآءَکَ الۡمُنٰفِقُوۡنَ قَالُوۡا نَشۡهَدُ اِنَّکَ لَرَسُوۡلُ اللّٰهِ ۘ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ اِنَّکَ لَرَسُوۡلُهٗ ؕ وَ اللّٰهُ یَشۡهَدُ اِنَّ (২)الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَکٰذِبُوۡنَ
“যখন মুনাফিকরা আপনার কাছে আসে তখন তারা বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল। আর আল্লাহ জানেন যে, আপনি নিশ্চয় তাঁর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।” (৬৩:১)
“তারা তাদের শপথগুলোকে ঢালরূপে ব্যবহার করে, ফলে তারা আল্লাহর পথ থেকে [মানুষকে] নিবৃত্ত করে। তারা যা করত, নিশ্চয় তা কতই না মন্দ!” (৬৩:২)
হুজুরে পাক (সা.) যতদিন মক্কায় ছিলেন ততদিন তাঁর প্রতি ঈমান আনয়নকারী মুমিনদের কপালে মুশরিকদের অত্যাচার, নির্যাতন ও লাঞ্ছনা এবং বেশ কিছু সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার গঞ্জনা ছাড়া আর কিছু জোটেনি। সেখানে মুমিনরা তাদের ঈমানের দাবির ব্যাপারে সত্যনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল ও অন্যান্য মুমিনরা মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার পর যখন তারা শক্তিশালী হয়ে উঠলেন তখন কিছু মানুষ অন্তরে ঈমান না এনে বরং সামাজিক অবস্থান রক্ষা করা ও মুসলমানদের কাছ থেকে সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য শুধুমাত্র মুখে ঈমানদার ও মুসলমানিত্বের দাবি করত। এরকম মুনাফিকের সংখ্যা সমাজে দিন দিন বাড়তে থাকে। এ কারণে মদীনায় নাজিল হওয়ার সুরাগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা বেশি দেখা যায়।
মুনাফিকরা তাদের অশুভ লক্ষ্য চরিতার্থ করার জন্য ইসলামের পবিত্র বিষয়গুলোর অপব্যবহার করত। যেমন, একবার তারা মদীনায় একটি মসজিদ নির্মাণ করে সেটি উদ্বোধন করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)কে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মসজিদটিকে ‘মসজিদে জিরার’ বা ‘ক্ষতিকর মসজিদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাঁর রাসূলকে জানিয়ে দেন যে, এই মসজিদ মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও মতপার্থক্য সৃষ্টির কারণ হবে। সূরা মুনাফিকুনের প্রথম আয়াতেও বলা হচ্ছে: মুনাফিকরা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে নিজেদেরকে মুমিন হিসেব জাহির করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর নামে শপথ করে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- নিফাক হচ্ছে একটি ব্যবহারিক মিথ্যা যেখানে ব্যক্তি অন্তরে কাফির কিন্তু মুখে ঈমানের দাবি করে এবং সমাজে ঈমানদারের মতো আচার-আচরণ করে।
২- মিষ্টি কথায় লোক ভোলোনো এবং মোসাহেবি মুনাফিকদের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ কারণে কেউ যদি মুখে অত্যন্ত সুন্দর সুন্দর কথা বলে ঈমানদার হওয়ার দাবি করে তাহলে তার কথার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করা যাবে না। সব সময় আমাদেরকে মোসাহেব প্রকৃতির লোকজনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
৩- যারা কথায় কথায় কসম কাটে তাদের থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে। এ ধরনের মানুষ মুনাফিক হয় এবং তারা কখনও কখনও দৃশ্যত সত্যি কথাও বলে।
৪- মুনাফিকরা যেকোনো উপায়ে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসার থামিয়ে দিতে চায়। তারা মসজিদ নির্মাণ করে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করে মুসলিম শিবিরকে দুর্বল করে দেয় এবং মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার জন্য মানুষকে দ্বীনের কাজে সাহায্য করতে নিষেধ করে।
এবারে সূরা মুনাফিকুনের ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
وَ اِذَا رَاَیۡتَهُمۡ تُعۡجِبُکَ اَجۡسَامُهُمۡ ؕ وَ اِنۡ یَّقُوۡلُوۡا تَسۡمَعۡ لِقَوۡلِهِمۡ ؕ کَاَنَّهُمۡ خُشُبٌ مُّسَنَّدَۃٌ ؕ یَحۡسَبُوۡنَ کُلَّ صَیۡحَۃٍ عَلَیۡهِمۡ ؕ هُمُ الۡعَدُوُّ فَاحۡذَرۡهُمۡ ؕ قٰتَلَهُمُ اللّٰهُ ۫ اَنّٰی یُؤۡفَکُوۡنَ (৩)ذٰلِکَ (৪)بِاَنَّهُمۡ اٰمَنُوۡا ثُمَّ کَفَرُوۡا فَطُبِعَ عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ فَهُمۡ لَا یَفۡقَهُوۡنَ
“এটা এ জন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কাফের হয়েছে; ফলে তাদের অন্তর মোহর করে দেয়া হয়েছে, পরিণামে তারা বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।” (৬৩:৩)
“আপনি যখন তাদের দিকে তাকান, তখন [তাদের সৌন্দর্য, লাবণ্য ও সজীবতার কারণে] তাদের দেহাকৃতি আপনাকে মুগ্ধ করে এবং তারা যখন কথা বলে, তখন [ভাষার বিশুদ্ধতা এবং বাকপটুতার কারণে] আপিন সাগ্রহে তা শ্রবণ করেন; [কিন্তু ভেতরে ভেতরে] তারা যেন দেওয়ালে ঠেকানো কাঠের [শুকনো ও অন্তঃসারশূন্য] খুঁটি, তারা [প্রচণ্ড ভয়ের কারণে] যে কোন শোরগোলকে নিজেদের বিরুদ্ধে মনে করে। তারাই শত্রু । অতএব তাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখুন! আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! তারা কীভাবে সত্য থেকে বিচ্যুত হয়?”(৬৩:৪)
এই দুই আয়াতে মুনাফিকদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: বাইরে তারা অত্যন্ত পরিপাটি ও কেতাদুরস্ত এবং তাদের বক্তব্য অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। যেকোনো শ্রোতা তাদের বক্তব্যে আকর্ষিত হয়। কিন্তু তাদের অন্তরে রয়েছে কুফর ও শিরক। তারা ঈমানি চেতনা থেকে বহু দূরে রয়েছে এবং তারা আল্লাহর হেদায়েতের নূর থেকে বঞ্চিত।
তারা প্রাণহীন মরদেহের সমতূল্য যাদের বাহ্যিক বেশভুষা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু তাদের ভেতরটা মস্তিষ্কবিহীন ও শূন্য এবং তারা অতি ভীরু প্রকৃতির মানুষ। তারা প্রাণের ভয়ে অপরের বক্তব্যকে নিজেদের জন্য ক্ষতিকর মনে করে এবং এজন্য তার বিরোধিতা করে। মুনাফিকরা চায় মানুষ যেন শুধু তাদের কথাবার্তা শোনে ও তা মেনে নেয়।
মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের এই আদেশ দেন যে, তারা যেন মুনাফিকদের বাহ্যিক বেশভুষা ও মনোমুগ্ধকর বক্তব্যে আকর্ষিত না হন এবং একথা জেনে রাখেন যে, মুখে বন্ধুত্বের বুলি আওড়ালেও তারা অন্তরে মুমিনদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে। পার্থিব জীবনে তারা মুমিনদের বদদোয়া প্রাপ্ত এবং পরকালে আল্লাহ তায়ালার কঠিন শাস্তি পাবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১- যে ব্যক্তি সত্য উপলব্ধি করা সত্ত্বেও তার প্রতি ঈমান আনে না তার অন্তরে তালা লাগানো রয়েছে এবং সে সত্য গ্রহণ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছে।
২- মুনাফিকরা হচ্ছে এমন শত্রু যারা মুমিনদের সঙ্গেই বসবাস করে। তারা অভ্যন্তরীণ শত্রু বলে প্রকাশ্য শত্রুর চেয়ে ভয়ঙ্কর। কারণ, তারা বাহ্যিকভাবে বন্ধুর বেশ ধরে আছে এবং তাদের চেনা কঠিন বলে তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়াও দুরুহ ব্যাপার।
৩- আমাদের পক্ষে মানুষের অন্তরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও মানুষের বাহ্যিক বেশভুষা ও আকর্ষণীয় কথাবার্তার ধোঁকায় পড়া আমাদের উচিত নয়। মানুষ দৈহিক গঠন ও চেহারা সুরতে যতই আকর্ষণীয় হোক কিংবা পোষাক আশাকে যতই ঈমানদারির পরিচয় দিক, আমল বা কর্মই হচ্ছে তাদের ঈমানদারির মূল মাপকাঠি।
এবারে সূরা মুনাফিকুনের ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
سَوَآءٌ عَلَیۡهِمۡ اَسۡتَغۡفَرۡتَ لَهُمۡ اَمۡ لَمۡ تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ ؕ لَنۡ یَّغۡفِرَ اللّٰهُ لَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡفٰسِقِیۡنَ (৫)وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُمۡ تَعَالَوۡا یَسۡتَغۡفِرۡ لَکُمۡ رَسُوۡلُ اللّٰهِ لَوَّوۡا رُءُوۡسَهُمۡ وَ رَاَیۡتَهُمۡ (৬)یَصُدُّوۡنَ وَ هُمۡ مُّسۡتَکۡبِرُوۡنَ
“আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা এসো, আল্লাহ্র রাসূল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা [অহংকার ও ভর্ৎসনাছলে] মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানায়। আর আপনি তাদেরকে দেখতে পাবেন, অহংকারবশত [মানুষকে সত্যের পথে অগ্রসর হওয়া থেকে] ফিরিয়ে রাখে। ”(৬৩:৫)
“আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন বা না করুন, উভয়ই তাদের জন্য সমান। আল্লাহ্ তাদেরকে কখনো ক্ষমা করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না।”(৬৩:৬)
ইতিহাসে এসেছে, মদীনার কিছু মুনাফিক মহানবী (সা.) ও তাঁর ঈমানদার সাহাবীদের সম্পর্কে কুৎসা রটনা করত। কিন্তু রাসূলের উপস্থিতিতে তারা সেসব কথা বেমালুম অস্বীকার করে বসত এবং সেসব বক্তব্যের জন্য আল্লাহর রাসূল ও মুমিনদের কাছে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের এ আচরণের কারণ ছিল অহংকার ও আত্মম্ভরিতা। তারা নিজেদেরকে অনেক সম্মানিত মানুষ মনে করত এবং বাকিদের নীচ ও হীন বলে ভাবত। যারা নিজেদের অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় না এবং গোনাহগার ভাবে না স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। এমনকি আল্লাহ বলছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ংও যদি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান তাহলেও কোনো কাজ হবে না। আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের মানুষদের ক্ষমা করবেন না।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আমাদের উচিত গোনাহগার ব্যক্তিদের পরকালীন মুক্তির জন্য এবং তাদেরকে তওবা করে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করা।
২- আমাদের উচিত রাসূলুল্লাহ (সা.)এর প্রতি তাওয়াসসুল করে এবং তাঁর পক্ষ থেকে আল্লাহর ক্ষমা লাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে নিজেদের জন্য আল্লাহর রহমতের দরজা উন্মুক্ত করা।
৩- অহংকার ও আত্মম্ভরিতা মুনাফিকের সুস্পষ্ট লক্ষণ। তারা নিজেদেরকে গোনাহগার মনে করে না বরং এটা ভাবে যে, তারাই সত্যের পথে রয়েছে।
৪- সত্যের বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে আল্লাহর হেদায়েত ও অফুরন্ত রহমত থেকে বঞ্চিত করে।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গে দিলেন হতাদের সাবই অনেক ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/এমএমআই/বাবুল আখতার/ ৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।