ডিসেম্বর ১১, ২০২৩ ১৭:৫৯ Asia/Dhaka

আজকের যুগে রাজনীতি, নীতিশাস্ত্র, রহস্যবাদ, দর্শন, অর্থনীতি, শিল্প এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে ফারাবির মতামতকে উপেক্ষা করা যায় না।

বিজ্ঞানের ইতিহাস ও দর্শনের ইতিহাসে ফারাবির অবদান চিহ্নিত করা ও পরিচয় করা, সময়ের প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অবস্থান ও মতামতের সমালোচনা ও বিশ্লেষণ করা, দর্শনের প্রতি ঝোঁক-প্রবণতা ও সঠিকভাবে উপলব্ধির ক্ষেত্রে ফারাবির দর্শনের নীতিগুলো ব্যবহার করা প্রভৃতি এতটা গুরুত্বপূর্ণ যা রাজনৈতিক দর্শনে স্ট্রাউসের ছাত্ররা দেখিয়ে দিয়েছেন। তাই আজকের আধুনিক যুগে এসেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফারাবির চিন্তাদর্শন অধ্যয়ন করা আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আলোচনার এ পর্যায়ে এসে আমরা ফারাবী সম্পর্কে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের  স্থপতি মরহুম ইমাম খোমেনির দৃষ্টিভঙ্গি খুব সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করবো। তিনি ফারাবীকে দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ১৯৮৯ সালের প্রথম দিকে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা মিখাইল গর্বাচেভের কাছে লেখা এক চিঠিতে মরহুম ইমাম খোমেনি ফারাবি ও ইবনে সিনাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।  ইমাম খোমেনী গর্ভাচেভকে লিখেছিলেন, আপনি আদেশ দিতে পারেন যে আপনাদের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা পশ্চিমা দার্শনিকদের বই ছাড়াও আল-ফারাবী, বু-আলী সিনার 'মাশশ' দর্শন কর্মসমূহ সম্পর্কে গবেষণা করতে পারে যাতে করে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কার্যকারণ যার ওপর সকল জ্ঞান নির্ভরশীল, সেটা যুক্তির বিষয়-ইন্দ্রিয় অনুভূতির ব্যাপার নয়। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দির কর্ম 'ইশরাক' দর্শনের ব্যাপারেও তাদেরকে অবগত করানো যেতে পারে। তারা আপনার নিকট ব্যাখ্যা করতে পারবে যে, বস্তু ও অন্যান্য বস্তুগত সত্ত্বার অন্তরে আত্মা নামক এমন একটা নূরের প্রয়োজন যেটা ইন্দ্রিয় অনুভূতির উর্ধ্বে এবং নিজের সম্বন্ধে মনুষ্য সন্তানের অভিজ্ঞতালব্ধ সত্যের জ্ঞান ইন্দ্রিয় অনুভূতির বহির্ভূত বিষয়। 

ইমাম খোমেনি (র.) গর্ভাচেভকে লেখা চিঠিতে আরো বলেছেন, আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন বোধ করছি যে, আপনি পুনরায় একবার বস্তুবাদী ও খোদায়ী বিশ্ব দর্শনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। বস্তুবাদীরা তাদের বিশ্ব সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিতে ইন্দ্রিয় অনুভূতিকেই জ্ঞানের মানদণ্ড মনে করে এবং যেটা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভবযোগ্য নয়, সেটাকে বিজ্ঞানের আওতার বহির্ভূত বিষয় বলে ভাবে। বস্তুগত অস্তিত্বকেই তারা সত্ত্বা মনে করে এবং অবস্তুগত কোনো কিছুকে সত্ত্বাসম্পন্ন জ্ঞান করে না। এ অনিবার্য কারণেই মহামহিমান্বিত খোদা, ওহি, নবুয়ত ও পুনরুত্থান দিবসের অস্তিত্বসম্পন্ন অদৃশ্য দুনিয়াকে তারা কল্পকাহিনী বলে বিবেচনা করে। অপরপক্ষে, আধ্যাত্মিক বিশ্বদৃষ্টিতে ইন্দ্রিয় অনুভূতি ও বুদ্ধিমত্তা উভয়টি জ্ঞানের মানদণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। যা কিছু বোধগম্য সেটাই বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত-হোকনা তা অদৃশ্যমান। সুতরাং সত্ত্বার আত্মিক ও বস্তুগত উভয় দিক রয়েছে এবং অবস্তুগত জিনিসও অস্তিত্বমান। একইভাবে বলা যায় বস্তু মনের ওপর নির্ভরশীল, ইন্দ্রিয়জ্ঞান আজও জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল।

ফারাবী সম্পর্কে অনেক গল্প কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। এসব গল্প কাহিনী যারা বর্ণনা করেছে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে ফারাবির লেখার প্রভাবও রয়েছে। ফলে সমাজ জীবনেও এসব বর্ণনার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এর আগের আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা ফারাবীর জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলী ও তৎকালীন সমাজের বর্ণনা তুলে ধরেছিলাম। যদিও তথ্য-সূত্রে মতভিন্নতা রয়েছে তবুও ফারাবির জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ফারাবির জীবনের এমন কিছু সন্দেহজনক ও অনুমাননির্ভর বিষয় রয়েছে যা পরবর্তীতে কল্পকাহিনী ও কিংবদন্তীর রঙ ধারণ করেছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা এ বিষয়ে কথা বলবো।

ফারাবি সম্পর্কে যেসব বিখ্যাত আখ্যান বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোকে এক ধরনের কিংবদন্তি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে বলা হয়ে থাকে, ভাষাজ্ঞানে ফারাবি ছিলেন খুবই দক্ষ এবং  তিনি সত্তরটিরও বেশি ভাষায় অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তবে, ৭০টি ভাষা জানার ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও এটা ঠিক যে, ফারাবীর রচনাসামগ্রী এবং বিভিন্ন আলোচনা থেকে বোঝা যায় তিনি বহু ভাষার সাথে পরিচিত ছিলেন।  

সেই সময় পূর্ব ভূখণ্ড থেকে অর্থাৎ খোরাসান অঞ্চল থেকে পশ্চিমের মুসলিম খেলাফত অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ফারাবির ভ্রমণকাহিনী থেকে জানা যায় যে তিনি বহু জাতিগোষ্ঠীর লোকের এবং বিভিন্ন ভাষার সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং এই ধরনের যোগাযোগের কারণে তিনি অনেক ভাষার সাথে পরিচিত ছিলেন। তবে তিনি বহু ভাষা রপ্ত করেছিলেন বলে যে কল্পকাহিনী প্রচলিত রয়েছে তা আসলে সঠিক না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেকারণে তিনি যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সত্তরটি ভাষাকে রপ্ত করেছিলেন বলে যেসব গল্প ও কিংবদন্তী তৈরি করা হয়েছে সেসবের প্রমাণ না ফারাবীর নিজের রচনার মধ্যে পাওয়া যায় আর না তাঁর সমসাময়িক লেখকদের কাজের মধ্যে পাওয়া যায়। ফারাবির ভাষাজ্ঞান এবং অনেক ভাষার উপর তার দক্ষতার কথা বলতে গিয়ে গ্রীক ভাষার সাথে তার পরিচিতির কথাও জানা যায়। ফার্সি ও বর্তমানে বিলুপ্ত সোগদিয়ান ভাষার সাথে ফারাবি ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন এবং কিছুটা গ্রীক ভাষার সাথেও ফারাবির পরিচয় ছিল যা তার লেখার মাধ্যমে জানা যায়।

উদাহরণস্বরূপ, কাবুলে সংরক্ষিত হাতে লেখা আরবি পাণ্ডুলিপিগুলোর একটিতে আমরা জানতে পারি যে, ফারাবি গ্রীক দেশে ভ্রমণ করেছিলেন এবং দর্শনের ওপর পড়াশোনা শেষ করার জন্য আট বছর তিনি গ্রীসে অবস্থান করেছিলেন। একই পাণ্ডুলিপিতে, একজন খ্যাতিমান মুসলিম ইতিহাসবিদ সালাহ উদ্দিন সাফাদির উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে, ফারাবি গ্রীক ভাষা থেকে দর্শন শিখেছিলেন এবং অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি এই ভাষাও জানতেন। আরেক খ্যাতিমান লেখক কাজভিনি তার বইতে বলেছেন, ফারাবি কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই অ্যারিস্টটলের রচনাগুলো গ্রিক থেকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এসব বিষয় থেকে গ্রীক উৎসগুলোর মাধ্যমে ফারাবির দর্শন শেখার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়। এমনকি প্লেটো ও অ্যারিস্টটলকে কাছাকাছি আনার জন্য তার প্রচেষ্টা সম্পর্কে কিছু সন্দেহ দূর করতে পারে। কিন্তু এসব বিষয় বাদ দিয়ে বলা যায়, ফারাবীর গ্রীক জ্ঞান তার রচনায় যেভাবে প্রতিফলিত হওয়া উচিত ছিল, দুর্ভাগ্যবশত তা আশানুরূপ প্রতিফলিত হয়নি। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ