ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩ ১৬:৪৯ Asia/Dhaka
  • সূরা আত-তাগাবুন: ১৩-১৮ (পর্ব-৩)

আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা তাগ্বাবুনের ১২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ১৩ থেকে ১৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই ১৩ ও ১৪ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

“আল্লাহ্‌ [একমাত্র মাবুদ], তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই; আর মুমিনগণ যেন শুধুমাত্র আল্লাহর উপরই তাওয়াক্কুল [বা ভরসা] করে।”

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের স্ত্রী-স্বামী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু [এবং তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে]; অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক থেকো। আর যদি তোমরা তাদের [অত্যাচার ও মানসিক পীড়ন] মার্জনা কর, তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা কর এবং তাদেরকে ক্ষমা কর, তবে [জেনে রেখো] নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”

গত আসরের শেষ আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর আজকের এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: কখনও কখনও স্ত্রী বা স্বামী কিংবা সন্তানেরা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা তাদের দুনিয়াবি আরাম-আয়েশ ঠিক রাখার জন্য তাদের পিতা বা পরিবারের কর্তাকে জিহাদে যেতে কিংবা হিজরত করতে বাধা দেয়। অথবা তারা দরিদ্র ব্যক্তিদেরকে দান করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে আল্লাহর নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করতে হবে।

তবে এখানে মনে রাখতে হবে, পরিবারের সদস্যরা বাধা দিচ্ছে বলে তাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করা যাবে না বরং তারা যদি অনুতপ্ত হয় তাহলে তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে হবে। আল্লাহ বলছেন, তাঁর ক্ষমা পেতে হলে নিজেকেও ক্ষমা করার অনুশীলন করতে হবে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- প্রকৃত ঈমানের চিহ্ন হচ্ছে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা নির্ভর করা। মুমিন ব্যক্তিদেরকে তাদের প্রতিটি কাজে আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে হবে।

২- পারিবারিক বন্ধন যেন আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। পরিবারের প্রতিটি সদস্য আল্লাহর সৃষ্টি ও তাঁর বান্দা। তাদের সবাইকে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলতে হবে।

৩- মানুষকে আল্লাহ যেসব উপকরণ দ্বারা পরীক্ষা করেন তার অন্যতম হচ্ছে পরিবার ও সন্তান-সন্ততি। পরিবারের সদস্যদের চাহিদা অনেক। এসব চাহিদা ততক্ষণ পর্যন্ত মেটাতে হবে যতক্ষণ তা আল্লাহর নির্দেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়।

এবারে এই সূরার ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

“তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো পরীক্ষা বিশেষ; আর আল্লাহ, তাঁরই কাছে রয়েছে মহা পুরস্কার।”

“সুতরাং তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, [তাঁর বক্তব্য] শ্রবণ কর, [তাঁর] আনুগত্য কর এবং ব্যয় [বা দান] কর যা তোমাদের নিজেদের জন্যই কল্যাণকর; আর যারা অন্তরের কার্পণ্য হতে মুক্ত; তারাই তো সফলকাম।”

মানুষকে আল্লাহ তায়ালা যা কিছু দান করেছেন তার সবই তার জন্য পরীক্ষা। তিনি আমাদেরকে যেসব ধন-সম্পদ দান করেছেন তার সব স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য নয়। এই সম্পদে রয়েছে দরিদ্র ও অসহায় জনগোষ্ঠীর অধিকার। এই অধিকার প্রদান করতে গেলে যদি পরিবারের সদস্যদের বাধা আসে তাতে কর্ণপাত করা যাবে না।

পার্থিব জীবনে মানুষের চাহিদার শেষ নেই। এসব চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে মানুষের মধ্যে ধন-সম্পদ সঞ্চয় করার প্রবণতা তৈরি হয় এবং এক সময় তাকে কার্পণ্যে পেয়ে বসে। ফলে সে দান-খয়রাত করতে চায় না।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ যদি আল্লাহর নির্দেশের প্রতি লক্ষ্য করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে এবং কৃপণতা বাড়তেই থাকে তাহলে এক সময় সে খোদাদ্রোহিতার দিকে ধাবিত হবে এবং আল্লাহ না করুক, ধর্মীয় বন্ধন থেকে বেরিয়ে যাবে। এ কারণে এই দুই আয়াতে মানুষকে তার সামনে থাকা সমূহ বিপদ থেকে সতর্ক করে বলা হচ্ছে: আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করে কার্পণ্য পরিহার করো এবং তোমার সম্পদে দরিদ্রদের যে অধিকার আছে তা দিয়ে দাও। তাহলেই তুমি সফলকাম হতে পারবে।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- সম্পদ ও সন্তানদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা মানুষকে ধর্ম থেকে বিচ্যুত ও পথভ্রষ্ট করে দিতে পারে।

২- তাকওয়া এবং খোদাভীতির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যেকোনো সময় এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর নির্দেশের বিপরীত কোনো কাজ করা যাবে না। গোনাহ যত ছোট হোক তা করা যাবে না এবং নেক কাজ যত ছোট  হোক তা ছাড়া যাবে না।

৩- মানুষের প্রকৃত সাফল্য নির্ভর করছে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বাস্তবায়নের ওপর। মন যা চায় তা আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীত হলে করা যাবে না।

৪- ধন-সম্পদের প্রতি আসক্তি মানুষকে কৃপণতার দিকে ঠেলে দেয়। পক্ষান্তরে ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করলে মানুষ সফলকাম হতে পারে।

এবারে সূরা তাগ্বাবুনের ১৭ ও ১৮ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

“যদি তোমরা আল্লাহকে ঋণ দান করো, উত্তম ঋণ, তবে তিনি তোমাদের জন্য তা বহু গুণ বৃদ্ধি করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ গুণগ্রাহী, পরম সহিষ্ণু।”

“তিনি গায়েব ও উপস্থিত যাবতীয় বিষয়ের জ্ঞানী, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই দুই আয়াতে কৃপণতার মতো মন্দ স্বভাব পরিহার করার উপায় বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: তোমরা একথা ভেবো না যে, যা কিছু তোমরা অসহায় মানুষদের দান করছো তা আল্লাহ জানেন না এবং এতে তোমাদের কোনো কল্যাণ নেই। বরং আল্লাহ প্রতিটি দানেরই হিসাব রাখছেন। এ দানকে আল্লাহ নিজের জন্য ঋণ গ্রহণের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, এই ঋণ বহুগুণে বৃদ্ধি করে দানকারী ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

তবে ইসলামে দান করার চেয়ে ঋণ দানের পুরষ্কার অনেক বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, ঋণ দিলে ঋণ গ্রহিতার মধ্যে ওই টাকা ফেরত দেয়ার একটি আগ্রহ তৈরি হয়। সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ঋণ শোধ করার চেষ্টা করে। এর ফলে তার জীবনে সফলতা আসে এবং সে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালায় তাতে সমাজেরও উন্নতি ও সমৃদ্ধি হয়।

কিন্তু  যে ব্যক্তি দানের টাকা গ্রহণ করে সে ওই টাকা খরচ করে ফেলে এবং সারাক্ষণ অন্যের দান-খয়রাতের ওপর জীবন চালাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজের বা সমাজের উন্নতিতে কোনো অবদান রাখার পরিবর্তে সে সমাজের বোঝা হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। তবে দান হোক কিংবা ঋণ হোক, উভয় ক্ষেত্রে যেহেতু গ্রহণকারী ব্যক্তি উপকৃত হয় তাই আল্লাহ দানকারী ব্যক্তিকে পরকালীন পুরস্কারের পাশাপাশি পার্থিব জীবনেও উন্নতি ও সমৃদ্ধি দান করেন এবং তার গুনাহ ক্ষমা করে দেন।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- মহান আল্লাহ অসহায় মানুষদের পক্ষে রয়েছেন।  তিনি তাদেরকে দান করা অর্থকে নিজের জন্য ঋণ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তা বহু গুণে বৃদ্ধি করে দানকারী ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দেন।

২- আমরা আল্লাহর সৃষ্টি এবং আমাদের যা কিছু আছে তা তাঁরই দান। কিন্তু তারপরও আমরা যে দান-খয়রাত করি সেজন্য আল্লাহ নিজে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

৩- মানুষকে ঋণ দান আল্লাহকে ঋণ দানের সমান। তাই যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করছে তার কাছ থেকে ধন্যবাদ পাওয়ার আশা করার প্রয়োজন নেই। কারণ, আল্লাহ নিজেই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন।

৪- গোপনে দান করা এমনকি যাকে দান করা হলো তাকেও বিষয়টি জানতে না দেওয়া হচ্ছে সবচেয়ে উত্তম দান। আল্লাহ বলেছেন, তিনি গোপন ও প্রকাশ্য সব বিষয়েই অবগত আছেন।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গে দিলেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/২৭

ট্যাগ