জানুয়ারি ২১, ২০২৪ ২০:০৮ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। রংধনুর আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি নাসির মাহমুদ এবং আমি আকতার জাহান।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, প্রতিবেশীই হচ্ছে মানুষের সবচে' নিকটজন, যিনি তার খবরাখবর সম্পর্কে অন্যদের তুলনায় বেশি জানেন। তাই ইসলাম ধর্মে প্রতিবেশীর অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে এবং তার অধিকারকে খুব বড় করে দেখা হয়েছে।

তো বন্ধুরা, প্রতিবেশীর গুরুত্ব ও মর্যাদা, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য  নিয়ে আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। এতে থাকবে প্রতিবেশীকে নিয়ে তিনটি ঐতিহাসিক ও সত্য ঘটনা এবং একটি গান আর একটি কবিতা। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন সহকর্মী আশরাফুর রহমান।

বন্ধুরা, আমরা আগেই বলেছি যে, বাড়ির আশপাশে যারা বসবাস করে তাদেরকে প্রতিবেশী বলা হয়। তবে এ নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, নিজের বাড়ির চতুর্দিকে চল্লিশ ঘর পর্যন্ত হচ্ছে প্রতিবেশীর সীমানা। আবার কেউ বলেন, যে তোমার সাথে ফজর পড়ল সেই তোমার প্রতিবেশী। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মতামত হচ্ছে, নিজের বাড়ির পাশে যার বাড়ি সেই আসল প্রতিবেশী। সে হিসাবে নিজ বাড়ির সাথে লাগানো বা কাছাকাছি প্রতিবেশীর প্রতি, দুরের প্রতিবেশীর চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে প্রতিবেশীর প্রতি কেন এত গুরুত্ব দিতে হবে? এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে কী বলা হয়েছে, সে সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করা যাক।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা আন নিসার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন,  ''তোমরা সবাই আল্লাহর ইবাদত কর। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার কর। নিকটাত্মীয়, এতিম- মিসকিনদের সাথে সদ্ব্যবহার করো। আত্মীয়-সম্পর্কীয় প্রতিবেশী, আত্মীয়তাবিহীন প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সহচর, তোমাদের মালিকানাধীন বাদী ও গোলামদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো। "

অন্যদিকে রাসুলখোদা বলেছেন, "জিবরাঈল আলাইহিস সালাম আমাকে প্রতিবেশী সম্পর্কে এতো বেশী অসিয়ত করছিলেন যে, এক পর্যায়ে আমার ধারণা হয়েছিল যে, আল্লাহতাআলা মনে হয় প্রতিবেশীকে উত্তরাধিকারী করে দেবেন।" 

বন্ধুরা, প্রতিবেশীর ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসের বক্তব্যের পর এবার আমরা প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরব।

প্রথমত: কথা ও কাজের মাধ্যমে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া যাবে না। অর্থাৎ তাকে অভিশাপ দেওয়া, গালি দেওয়া, তার গীবত করা, তার বাড়ির সামনে আবর্জনা ফেলা, তাকে বিরক্ত করা, ছেলে-মেয়েদেরকে তার ঘরের জিনিস নষ্ট করতে উদ্বুদ্ধ করা বা বাধা না দেওয়া- এসব করা যাবে না। মহানবী (সা.) এ সম্পর্কে বলেছেন, "যে আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়।" তিনি আরো বলেছেন, "সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার প্রতিবেশী তার কষ্ট থেকে মুক্ত নয়।"

প্রতিবেশীর প্রতি অন্য কর্তব্যগুলো হলো: প্রয়োজনে সাহায্য করা, কোনো জিনিস ব্যবহার করতে চাইলে তা দেয়া। প্রতিবেশীকে উপহার দেওয়া, তার বাড়িতে খাবার পাঠানো ইত্যাদি।

রাসূল (সা.) এ ব্যাপারে বলেছেন, "তোমরা প্রতিবেশীদের ঘরে উপহার পাঠাও। তরকারী পাঠাও। তরকারী কম হলে তাতে বেশি করে পানি দেবে এবং তোমার প্রতিবেশীকে তা থেকে কিছু দেবে।" তিনি আরো বলেছেন, "তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের প্রতিবেশীর কাছে উত্তম।" অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে, "সে ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট ভরে খায়, অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।"

একজন মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের অনেক অধিকার রয়েছে। সেসব অধিকার কিন্তু আমরা প্রথমেই প্রতিবেশীর ব্যাপারে আদায় করতে পারি। তাহলে ইসলামের নির্দেশ যেমন মানা হবে তেমনি প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কও বৃদ্ধি পাবে। এসব অধিকার বা কর্তব্যের কয়েকটি হলো, প্রতিবেশীকে সালাম দেওয়া, তার সালামের উত্তর দেয়া, কেউ অসুস্থ হলে তার সেবা-সুশ্রুষা করা, বিভিন্ন উপলক্ষে তাকে দাওয়াত দেয়া এবং তার দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করা; প্রতিবেশী ঋণ চাইলে তাকে ঋণ দেয়া, তার প্রয়োজনে তাকে সাহায্য সহযোগিতা করার ব্যাপারেও ইসলামে তাগিদ দেয়া হয়েছে।  

বন্ধুরা, প্রতিবেশীর দুঃখ-কষ্টে যেমন সহমর্মিতা দেখাতে হবে তেমনি তার ভালো কোনো সংবাদ যেমন-সন্তান জন্ম নিলে, তার সন্তান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, কারো বিয়ে হলে এবং এ জাতীয় উপলক্ষে তাকে মোবারকবাদ জানানো এবং বরকতের দোয়া করতে হবে। মোটকথা প্রতিবেশীর বিপদে আপদে, সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়াতে হবে; সবসময় তাদের খোঁজখবর নিতে হবে। অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে এ সম্পর্কেই রয়েছে একটি গান। 'প্রতিবেশীর খবর নিও' শিরোনামের গানটি লিখেছেন, নূরুজ্জামান শাহ সুর করেছেন আব্দুস সালাম আর গেয়েছে শিশুশিল্পী সারামনি।

সারামনির সুরেলা কণ্ঠে গানটি শুনলে। বন্ধুরা, তোমরা যদি নবী পরিবারের দিকে তাকাও তাহলে দেখতে পাবে যে, তাঁরা নিজের পরিবারের চেয়ে প্রতিবেশীদের প্রতি বেশী লক্ষ্য রাখতেন, তাদের মঙ্গলের জন্য আল্লাহর দরবারে দেয়া করবেন। অনুষ্ঠানের এ সম্পর্কে এবারে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা শোনাচ্ছি।

"প্রতিদিন শেষ রাতে ছেলেটির ঘুম ভেঙে যায়। অবাক হয়ে লক্ষ্য করে মা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছেন। ছেলেটিও অভ্যাসবশত বিছানা থেকে উঠে ওজু করে মায়ের পাশে নামাজে দাঁড়ায়। মায়ের সাথে নামাজ পড়ার সময় সে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে। মা নামাজ শেষে মোনাজাত করছেন, কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন প্রতিবেশীদের মঙ্গলের জন্য,তাদের গোনাহ মাফের জন্য। কিন্তু নিজেদের জন্য কিছুই প্রার্থনা করছেন না!

এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর ছেলেটি তার কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারলো না। সে মাকে জিজ্ঞেস করলো, "মা, মোনাজাতের সময় তুমি কেবল পাড়া-প্রতিবেশীর মঙ্গল কামনা করো। তোমার নিজের জন্য বা আমাদের কারও জন্য তো দোয়া করো না! এর কারণ কি"?

স্নেহময়ী মা এবার ছেলেকে আদর করে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, বাছা আমার! আমি কেন ওরকম করি? তুমি জেনে রেখো, প্রতিবেশীর হক আগে। প্রতিবেশীর মঙ্গল কামনা করলে, তাদের খোঁজখবর নিলে আল্লাহ তায়ালা খুব খুশী হন। তাই আমি তাদের জন্য দোয়া করি। তবে তোমাদের জন্যও দোয়া করি। তবে প্রতিবেশীর অধিকার আগে, এটা মনে রাখবে-কেমন ?

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই এই মহিয়সী মা ও তাঁর ছেলেটির পরিচয় জানতে চাচ্ছ! হ্যাঁ বলছি, এই মহিয়সী মা ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কন্যা হযরত ফাতিমা (সা. আ.) এবং যে ছেলেটির কথা বলা হলো তিনি হলেন ইমাম হাসান (আ.)। হযরত ফাতিমারই আদরের সন্তান।

বন্ধুরা, তোমরা লক্ষ্য করেছো যে, ইসলামে প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যের ব্যাপারে তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও অনেকেই প্রতিবেশীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, তাদেরকে অযথা কষ্ট দেয়। এ সম্পর্কেই এখন একটি ঘটনা শোনাচ্ছি:

একবার একজন আনসার সাহাবী মদীনায় একটি নতুন বাড়ি কিনে সেখানে বসবাস করতে লাগলেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি টের পেলেন যে, তার প্রতিবেশী লোকটি সুবিধার নয়। তাই তিনি রাসূলুল্লাহ'র কাছে হাজির হয়ে বললেন, "হে আল্লাহর রাসূল! আমি কিছুদিন আগে একটি বাড়ি কিনে সেখানে বসবাস শুরু করেছি। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, আমার প্রতিবেশী শুধু একজন অভদ্র লোকই নয়, সে অত্যন্ত ঝগড়াটে। আমি বারবার চেষ্টা করেও তার অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পাচ্ছি না। "

সব শুনে মহানবী- হযরত আলী, সালমান, আবু যর ও মেকদাদের মতো চারজন বিশিষ্ট সাহাবীকে বললেন, তোমরা মসজিদে গিয়ে নারী-পুরুষ সকলের মধ্যে উচ্চস্বরে ঘোষণা করবে যে, যে ব্যক্তির ঝগড়াটে চরিত্রের কারণে তার প্রতিবেশী কষ্ট পাবে, সে ঈমানদার নয়।

রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী পর পর তিনবার এ ঘোষণাটি দেয়া হলো। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর পবিত্র হাত চারদিকে ঘুরিয়ে বললেন, "চারদিকের চল্লিশ ঘরের লোক প্রতিবেশী হিসেবে গণ্য হবে। "

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেনীর নাম শুনেছো। তিনি যখন ফ্রান্সে নির্বাসনে ছিলেন তখন তাঁর কাছে লোকজনের যাওয়া-আসা লেগেই থাকত। এতে পাড়া-প্রতিবেশীদের কষ্ট হতো। এ বিষয়টি নিয়ে ইমাম চিন্তিত ছিলেন এবং সুযোগ খুঁজছিলেন কিভাবে প্রতিবেশীদের হক আদায় করা যায়। একদিন সুযোগ এসে গেল। হযরত  ঈসা (আ.)-এর জন্মদিনে ইমাম তাঁর খ্রিস্টান প্রতিবেশীদের জন্য উপহার সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে বললেন।

কথা অনুযায়ী কয়েক বাক্স মিষ্টি ও চকলেট আনা হলো। ইমাম এগুলো দেখার পর কিছু ফুলও আনতে বললেন। কেননা, তিনি লক্ষ্য করছিলেন যে, তাঁর প্রতিবেশীরা ফুল পছন্দ করে। তাছাড়া, তিনি প্রতিবেশীদের নিকট শুভেচ্ছা-উপহার পৌঁছানোর সময় তাঁর পক্ষ থেকে তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার নির্দেশও দিলেন।

এ ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান যা-ই হোক না প্রতিবেশীর একটাই পরিচয় তারা প্রতিবেশী। তাদের কষ্ট দেয়া যাবে না, তাদের সবাইকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।

বন্ধুরা, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে কয়েকটি ঘটনা শুনলে। এ ঘটনাগুলো শোনা তখনই স্বার্থক হবে যখন তোমরা প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণ করবে, তাদের দুঃখে দুঃখী হবে এবং তাদের সুখে সুখী হবে।

তো বন্ধুরা, এবার রয়েছে প্রতিবেশীর হক নিয়ে একটি আবৃত্তি। কবি আতিফ আবু বকরের লেখা কবিতাটি আবৃত্তি করেছে ছোট্টবন্ধু তহেরা জাহান তাফরিহা।

তাফরিহার চমৎকার উচ্চারণে কবিতাটি শুনলে। তো বন্ধুরা, তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো এবং নিয়মিত প্রতিবেশীর খোঁজখবর রেখো এ কামনায় গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর। কথা হবে আবারো আাগমী আসরে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ