আজ পর্যন্ত কোনো মহামানব গোটা বিশ্বে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হননি
শেষ ত্রাণকর্তা- ৩ (সভ্যতার পূর্ণতার যুক্তি)
গত দুই পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছি মানুষের সহজাত প্রকৃতিই ন্যায়বিচারকামী এবং তারা ব্যক্তি ও সমাজ-জীবনে পূর্ণতাকামী হওয়ায় বিশ্বব্যাপী প্রকৃত স্বাধীনতা, শান্তি ও সাম্য-ভিত্তিক সমাজ দেখতে চায়।
অন্য কথায় তারা জুলুম, অন্যায়, বলদর্পিতা, দারিদ্র, বঞ্চনা, দুর্নীতি ও বৈষম্য-মুক্ত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার কর্তৃত্ব দেখতে চায়। আর এইসব লক্ষ্য কেবল একজন অসাধারণ মহামানব বা ত্রাণকর্তার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব বলেই তারা এমন এক ত্রাণকর্তার আগমনের অপেক্ষা করছে। শেষ ত্রাণকর্তার আগমনের আশা বা প্রত্যাশার আরও এক যুক্তি হল মানবীয় গুণগুলোর পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে সভ্যতার পূর্ণতায়ন। জ্ঞান, সচেতনতা ও বুদ্ধিবৃত্তির পরিপূর্ণ বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করাও কেবল কেবল একজন অসাধারণ মহামানব বা ত্রাণকর্তার মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব যেই ত্রাণকর্তা হবেন সমস্ত মানবীয় গুণের অধিকারী এবং যার প্রজ্ঞা ও সচেতনতা হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। আত্মিক ও বস্তুগত সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের পূর্ণতা অর্জনও শেষ-ত্রাণকর্তার ধারণার সঙ্গে সম্পর্কিত।
আজ পর্যন্ত কোনো মহামানব ও ঐশী মহামানব গোটা পৃথিবী থেকে দারিদ্র, বঞ্চনা, বৈষম্য এবং জুলুম ও নির্যাতন আর বলদর্পিতার অবসান ঘটাতে পারেননি পরিপূর্ণভাবে বা প্রত্যাশিত মাত্রায়। আজও প্রত্যাশিত বিশ্ব-শান্তি ও বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই সর্বশেষ সংস্কারক তথা শেষ ত্রাণকর্তার মাধ্যমে সভ্যতার এই পরিপূর্ণ পর্যায় অর্জিত হবে বলে অনেকেই আশাবাদী।
সৃষ্টি-জগতের সবকিছুই নিখুঁত নিয়ম ও ব্যবস্থাপনা মেনে চলে। প্রকৃতির রাজ্যে, তারকালোকে ও পশু-পাখির জগতে, উদ্ভিদের জগতে ও মানবদেহের মধ্যেও আমরা খোদা-প্রদত্ত নিখুঁত নিয়ম ও শৃঙ্খলার কর্তৃত্ব দেখতে পাই। সৌরজগতের শৃঙ্খলা ও নিয়মের সামান্যতম ব্যতিক্রম ঘটলে বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যেত। মানুষের শরীরের কোষগুলো ও রক্ত-প্রবাহের সিস্টেমসহ সব সিস্টেমই বিশেষ নিয়ম মেনে চলে। এইসব নিয়মের ওপর আঘাত হানা হলে শরীর খারাপ হয়ে পড়ে এবং এসব ক্ষেত্রে অনিয়ম মানুষের মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রাকৃতিক ও ঐশী ব্যবস্থাপনার সবখানেই রয়েছে নিখুঁত নিয়ম, সমন্বয় ও ঐকতান। কিন্তু মানুষ তার কাজ-কর্ম ও আচরণের বিষয়ে স্বাধীনতার অধিকারী বলে সঠিক কিংবা ভুল পথের যে কোনো একটি বেছে নিতে পারে। মানুষ তার বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে স্রস্টার প্রতিনিধি বা খলিফা হওয়ার মত সর্বোচ্চ পর্যায়েও যেমন পৌঁছতে পারে তেমনি বিবেকের বিরোধী পথে চলে পশুর চেয়েও নিম্ন স্তরে পৌঁছে যেতে পারে। মানুষের ইতিহাসে তাদের উন্নতি ও অধঃপতন –দুইই দেখা যায়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষ অসাধারণ উন্নতি করা সত্ত্বেও এবং মানব-কল্যাণের অনেক যন্ত্র আবিষ্কার করা সত্ত্বেও তারা বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ করে রাসায়নিক ও পরমাণু বোমার মত মারণাস্ত্রসহ নানা ধ্বংসাত্মক অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যা করেছে লক্ষ-কোটি মানুষ। কলকারাখানার ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়ে তারা প্রাকৃতিক পরিবেশেরও করেছে ব্যাপক ক্ষতি। অতি-লোভী মানুষেরা পৃথিবীর খনিজ সম্পদগুলো এমনভাবে ব্যবহার করছে যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলো এর সুফল ও ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কোনো কোনা বলদর্পি সরকার বা জাতি অন্যদেরকে বঞ্চিত করছে তাদের স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও এমনকি অন্ন-বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের অধিকার থেকেও। ফিলিস্তিনে ইসরাইলি অপরাধযজ্ঞ ও প্রায় ৭৫ বছরের দখলদারিত্বই এর বড় দৃষ্টান্ত। আর এসবই হচ্ছে বিবেক ও মানবীয় প্রকৃতির বিরোধী কাজ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অপব্যবহার। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানও হয়ে পড়ছে এক ধরনের অভিশাপ এবং অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, দাও ফিরে সেই অরণ্য লও এ নগর-সভ্যতা! আসলে প্রাচীন যুগেও মানুষ এতটা অসভ্য ও নির্লজ্জ ছিল না যতটা এই আধুনিক যুগে তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্য, পানীয় ও বিদ্যুতসহ সবক্ষেত্রে অবরুদ্ধ গাজায় বেসামরিক নিরীহ ও নিরপরাধ নারী ও শিশুদের ওপর পাশ্চাত্যের প্রতিপালিত ও সর্বাত্মক মদদপুষ্ট দানবীয় সন্ত্রাসী ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীর সীমাহীন পৈশাচিক গণহত্যা এবং অপরাধযজ্ঞ প্রাচীন যুগের অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর সব নির্মমতাকেও হার মানিয়েছে।
এটা স্পষ্ট মানুষের রচিত নানা মতবাদ ও তন্ত্র-মন্ত্র তাদেরকে দিতে পারছে না মুক্তি। ফলে তারা এমন একজন ত্রাণকর্তার আগমনের আশা করছেন যিনি মানুষের মধ্যে ঘটাবেন জ্ঞান, বিবেক ও প্রজ্ঞার এমন সু-সমন্বয় যে এর ফলে মানুষ আর ভুল পথে চলবে না, বরং মানুষ চলবে কেবলই মুক্তি, সৌভাগ্য ও পূর্ণতার পথে। অন্য কথায় মানব সমাজেও একদিন ঘটবে ন্যায়নীতি ও প্রকৃত ঐশী ধর্মের পূর্ণ কর্তৃত্বায়ন যে মহান লক্ষ্যে তাদের সৃষ্টি করেছেন মহান আল্লাহ। ফলে মানুষ কেবল বৈষয়িক দিক থেকেই সুখী ও সমৃদ্ধ হবে না আধ্যাত্মিক বা আত্মিক দিক থেকেও হবে পরিপূর্ণ সুখী এবং এভাবেই সভ্যতা তার চরম উন্নতির শিখরে আহরণ করবে ইমাম মাহদির (আ.) যোগ্য নেতৃত্বের আওতায়। তখন কোনো মানুষ হবে না আর হীন প্রবৃত্তি, লোভ-লালসা, অহংকারী ক্ষমতা ও বলদর্পিতার দাস, বরং তারা হবে তখন মহান স্রস্টার প্রকৃত দাস ও প্রতিনিধি।
মানুষ ইহকাল ও পরকাল নিয়েই মানুষ। বৈরাগ্যবাদ বা কেবলই পারলৌকিকতার চর্চা বা কেবলই পার্থিব বৈষয়িকতার চর্চায় প্রকৃত মুক্তি নেই। নবী-রাসুলগণ মানুষকে আত্মিক, বৈষয়িক, পার্থিব ও পারলৌকিক –এই সব ক্ষেত্রেই মুক্তির দিশা দিতে চেয়েছেন। আর এইসবেরই পরিপূর্ণতা ঘটাবেন মানবজাতির শেষ ত্রাণকর্তা তথা ইমাম মাহদি (আ)। মহান আল্লাহ তাঁর পুনরাবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন। #
পার্সটুডে/ এমএএইচ/২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।