কুরআনের আলো
সূরা তাহরিম: ৬-৮ (পর্ব-২)
আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা তাহরিমের ৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। কাজেই আজ আমরা এই সূরার ৬ থেকে ৮ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির শুনব। প্রথমেই ৬ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই আগুন থেকে রক্ষা কর, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর। [যে আগুনে] নিয়োজিত আছে নির্মম, কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ, যারা অমান্য করে না তা, যা আল্লাহ তাদেরকে আদেশ করেন এবং তারা যা করতে আদেশপ্রাপ্ত হয় তা-ই করে।”
এই সূরার প্রথম কয়েকটি আয়াতে পারিবারিক কিছু বিষয়ে আল্লাহর হুকুম-আহকাম বর্ণিত হয়েছে। এরপর এই আয়াতের পরিবারের সদস্যদের প্রতি মানুষের কর্তব্য স্থির করে দিয়ে বলা হচ্ছে: ঈমানদার ব্যক্তিরা শুধু নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর চিন্তা করেন না বরং তারা পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারেও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন হন এবং তাদেরকে গুনাহের কাজ থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। পরস্পরের প্রতি এবং বিশেষ করে সন্তানদের প্রতি স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব রয়েছে। পরিবার ও ঘরের পরিবেশ যেকোনো দূষণ থেকে পবিত্র রাখা তাদের দায়িত্ব। পরিবারের সদস্যদের নৈতিক অধোঃপতন ঘটাতে পারে এমন ইসলামবিরোধী সংস্কৃতি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে না দেওয়া তাদের কর্তব্য। পিতা-মাতার উচিত সন্তানদের সামনে ভালো কাজ ও মন্দ কাজের স্বরূপ তুলে ধরে যথাসম্ভব তাদেরকে নেক কাজে উৎসাহ প্রদান এবং গুনাহের কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা।
অন্য কথায়, সন্তানদের জন্য ভালো পোশাক ও ভালো খাবারের ব্যবস্থা করা যেমন পিতামাতার কর্তব্য তেমনি তাদের ধর্মীয় প্রতিপালন এবং আত্মিক চাহিদা পূরণেরও দায়িত্ব পিতামাতাকে পালন করতে হবে। পিতামাতা যদি সন্তানদের চিন্তার খোরাক সঠিকভাবে মেটাতে না পারেন তাহলে তাদের বিপথগামী হয়ে যাওয়ার দায়ও পিতামাতাকে নিতে হবে। এই আয়াতে জাহান্নামের আগুন সম্পর্কে বলা হচ্ছে: জাহান্নামের ইন্ধন বা জ্বালানী হবে এর অধিবাসীদেরই দেহ। তাদের গুনাহগুলো জাহান্নামের আগুনকে বহুগুণে প্রজ্বলিত হতে সাহায্য করবে। তাদের পাশে থাকবে গলিত পাথর যা আগুনের উত্তাপে গলে গেছে। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় যে গলিত লাভা বের হয় এই গলিত পাথর হবে অনেকটা সেরকম।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- মানুষের নফস বা অন্তর অবাধ্য ও খারাপ কাজের প্রতি লালায়িত। এই নফস মানুষকে গুনাহের প্রতি ধাবিত করে। এ কারণে যেকোনো পরিস্থিতিতে নফসের চাহিদার ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে যাতে সে আমাদেরকে ধোঁকা দিতে না পারে।
২- পরকাল ও জাহান্নামের আগুনের প্রতি বিশ্বাস মানুষের নফসকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
৩- মানুষকে আগে নিজেকে সংশোধন করতে হবে, এরপর পরিবারের সদস্যদেরকে এবং তারপর সমাজ সংশোধনের দিকে মনযোগী হতে হবে।
৪- সন্তানদের ধর্মীয় প্রতিপালনের দায়িত্ব পিতামাতাকে পালন করতে হবে।
এবারে এই সূরার ৭ ও ৮ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
“[তারা কাফেরদের উদ্দেশ করে বলবে:] হে অবিশ্বাসীগণ! আজ তোমরা ক্ষমা প্রার্থনার চেষ্টা করো না। তোমরা যা করতে, তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেওয়া হচ্ছে।”
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর-বিশুদ্ধ তওবা; আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন [জান্নাতের] উদ্যানে, যার [গাছপালার] পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ লাঞ্ছিত করবেন না নবীকে এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে। তারা বলবে, হে আমাদের রব! আমাদের জন্য আমাদের নূরকে পূর্ণতা দান করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন, নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।”
আগের আয়াতে জাহান্নামের আজাব থেকে নিজের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের বাঁচানোর আহ্বান জানানোর পর এই দুই আয়াতের শুরুতে কাফিরদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: কাল কিয়ামতের ময়দানে কোনো ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা ওজর-আপত্তি গ্রহণযোগ্য হবে না। ক্ষমা প্রার্থনা ও তওবা করতে হবে পার্থিব জগতে। কিয়ামত হচ্ছে পার্থিব জগতের কৃতকর্মের প্রতিদান দিবস। মানুষের দেহ-মনে পাপকাজ শেকড় গেড়ে বসার পর যদি তওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে তা পবিত্র করা না হয় তাহলে পরকালে তার শাস্তি জাহান্নামের কঠিন আজাব। আগের আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে, জাহান্নামবাসী হবে সেখানকার আগুনের ইন্ধন অর্থাৎ তাদের দেহ থেকে আগুন নির্গত হবে। পরের আয়াতে আবার পার্থিব জগতে ফিরে এসে মুমিন বান্দাদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় আল্লাহর কাছে খাঁটি মনে তওবা করা।
মনে রাখতে হবে, তওবা হচ্ছে কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা এবং পরবর্তীতে আর পাপকাজ না করার দৃঢ় সংকল্প। অন্তরে গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার দৃঢ়সংকল্প না করে মুখে হাজার বার ইস্তিগফার পড়লেও লাভ হবে না। কারণ, এ ধরনের তওবার উদ্দেশ্য হয় লৌকিকতা বা মানুষকে দেখানো। তবে, দৃঢ়সংকল্প নিয়ে কেউ যদি তওবা করে গুনাহমুক্ত জীবনযাপন করতে পারে তবে আল্লাহ তায়ালা সেই গুনাহগুলো মোচন করে গুনাহকে নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দেন। আর এ ধরনের মানুষের ঠিকানা অসংখ্য নেয়ামতে পূর্ণ জান্নাত। তারা আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করেন।
পরের আয়াতে কিয়ামতের দিন নবী-রাসূল ও তাঁদের অনুসারী মুমিন বান্দাদের অবস্থা বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: যেদিন গুনাহগার বান্দারা অত্যন্ত লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে সেদিন মুমিন ব্যক্তিরা হবেন অত্যন্ত সম্মানিত। সেদিন তাদের দেহ থেকে ঈমানি নূরের বিচ্ছুরণ ঘটবে। সেই নূর তাদের সামনে ও ডানে ধাবিত হবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- কিয়ামতের দিন তওবা, অনুশোচনা কিংবা ক্ষমা প্রার্থনায় কাজ হবে না। যতদিন আমরা পার্থিব জগতে রয়েছি ততদিনই আল্লাহর ক্ষমা লাভের সুযোগ। আমরা যেকোনো সময় তওবা করে আল্লাহর রাস্তায় ফিরে আসতে পারি। আর তওবা করার উপযুক্ত সময় এখনই। কারণ, এরপর আর বেঁচে থাকব কিনা এবং তওবা করার সুযোগ পাব কিনা তা আমাদের জানা নেই।
২- পরকালীন জীবনে জাহান্নামবাসী যে শাস্তি ভোগ করবে তা দুনিয়াতেই তাদের কৃতকর্মের ফসল ছাড়া আর কিছু নয়।
৩- আমাদেরকে গুনাহমুক্ত জীবন যাপনের চেষ্টা করতে হবে এবং কখনও গুনাহের কাজ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে নিতে হবে যাতে ওই গুনাহ আমাদের দেহমনে শেকড় গেড়ে বসতে না পারে।
৪- মুমিন ব্যক্তি মাত্রই গুনাহমুক্ত মানুষ নয় এবং যেকোনো সময় একজন মুমিন ব্যক্তিরও পদস্খলন হয়ে যেতে পারে। এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু গুনাহ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুতপ্ত হওয়া ও তওবা করে নেওয়া মুমিনের কাজ। কাফির কখনও খারাপ কাজ করে অনুতপ্ত হয় না।
৫- মানুষের পার্থিব জগতের নেক কাজগুলো পরকালে নূর বা আলোর আকৃতিতে প্রকাশিত হবে।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গে দিলেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।#