মামদানির নির্বাচিত হবার অর্থ কি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতি মার্কিন জনগণের মোহভঙ্গ?
-
নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে জয়লাভের পর জোহরান মামদানির ভাষণ
পার্সটুডে-ওয়াশিংটন পোস্ট সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে মামদানিকে তার সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে অভিযোগ তুলে সমালোচনা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে না সমাজতন্ত্র বা না পুঁজিবাদ-কোনটিই মানুষকে নিরাময় করতে পারে না।
ওয়াশিংটন পোস্টের সাম্প্রতিক সম্পাদকীয়টি ছিল 'জোহরান মামদানী মুখোশ খুলে ফেলেন'-এই শিরোনামে বাহ্যত নিউইয়র্কে 'শহুরে সমাজতন্ত্রের' বিপদ সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পরোক্ষভাবে ওই নিবন্ধটিতে ছিল আমেরিকার পুঁজিবাদের হৃদয়ে প্রোথিত একটি সংকটের অনিচ্ছাকৃত স্বীকারোক্তি। প্রকৃতপক্ষে, সংবাদপত্রের লেখকরা উদ্বেগের সাথে যা উল্লেখ করেছেন তা হলো-শ্রেণীগত ক্ষোভ, ন্যায়বিচারের দাবিতে স্লোগান এবং বাজারের প্রতি অবিশ্বাস- এগুলো কোনও নয়া বিপদ উত্থানের লক্ষণ নয় বরং 'বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোর বহু বছরের ব্যর্থতার' সরাসরি ফল। পার্সটুডে, এই প্রবন্ধটি উদ্ধৃত করে, মার্কিন সমাজের সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো নিরীক্ষা করেছে যা নিউ ইয়র্কবাসীদের সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
১. আবাসন সংকট; মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাথার ওপর ভেঙে পড়া ছাদ
ওয়াশিংটন পোস্ট মামদানির 'ভাড়া স্থগিত' করার প্রতিশ্রুতির সমালোচনা করে উদ্বেগের সুরে লিখেছে "উচ্চ ভাড়া সরকারের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের ফল, এর অভাব নয়।" তবে নিউইয়র্কের রাস্তাগুলোর বাস্তবতা দেখাই যথেষ্ট: লক্ষ লক্ষ ভাড়াটে এমন একটি শহরে বাস করে যেখানে বাড়িগুলো ব্যবসার পণ্য হয়ে উঠেছে। বিনিয়োগ সংস্থাগুলো দাম বাড়ানোর জন্য ভবনগুলো কেনে, পরিবারের বসবাসের জন্য নয়।
এমন পরিস্থিতিতে, যখন একজন রাজনীতিবিদ 'মাথার উপর ছাদের অধিকার" সম্পর্কে কথা বলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার কণ্ঠস্বর লক্ষ লক্ষ ভোট আকর্ষণ করবে। নিউইয়র্কের মতো শহরে পুঁজিবাদ ঘর তৈরির পরিবর্তে গৃহস্থালিকে মূলধন সঞ্চয়ের হাতিয়ারে পরিণত করেছে।
২. অর্থনৈতিক বৈষম্য; মার্কিনীদের স্বপ্ন এবং প্রতিদিনের দুঃস্বপ্ন
প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে মামদানি একজন "শ্রেণী শত্রু" তৈরি করেছেন এবং জনগণকে দুটি দলে বিভক্ত করেছেন: নিপীড়ক এবং নিপীড়িত।
কিন্তু বাস্তবতা হল এই বিভাজনটি তার রাজনীতিতে প্রবেশের বহু বছর আগেই স্বয়ং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই তৈরি করেছিল। আমেরিকায় কর্পোরেট নির্বাহী এবং শ্রমিকদের মধ্যে আয়ের ব্যবধান ৩০০ গুণেরও বেশি বলে জানা গেছে; এমনকি গার্ডিয়ান, ২০২২ সালের জুনে এক নিবন্ধের শিরোনামে পার্থক্যটি ৬৭০ গুণ বলে উল্লেখ করেছে। যদিও শ্রমিক শ্রেণীর প্রকৃত মজুরি কয়েক দশক ধরে বৃদ্ধি পায় নি।
মানুষ যখন এই অবিচার সম্পর্কে কথা বলে, তখন তারা এটিকে "জনপ্রিয়তা" বলে, কিন্তু বাস্তবে এটি এমন লোকদের কান্না যারা দেখে যে "আমেরিকার স্বপ্ন কেবল সুবিধাভোগী শ্রেণীর জন্যই বেঁচে আছে।"
৩. শিক্ষা; স্বার্থ এবং রাজনীতির শিকার
ওয়াশিংটন পোস্ট 'মেধাবি ছাত্র' কর্মসূচি বাতিল করার মামদানির পরিকল্পনার সমালোচনা করে সতর্ক করেছে যে, তিনি 'শিশু এবং ইউনিয়নের মধ্যকার দ্বন্দ্বে ইউনিয়নের পক্ষ নিচ্ছেন।' কিন্তু আসল বিষয় এটা নয় যে স্কুলে কে জিতবে; আসল বিষয় হলো বিদ্যালয়গুলো তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে।" এমন একটি ব্যবস্থায় যেখানে পাড়া-মহল্লায় বৈষম্য শুরু হয়, দরিদ্র শিশুরা প্রথম দিন থেকেই ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে যায়। শিক্ষা যখন বিলাসিতার পণ্যে পরিণত হয়, তখন বিতর্ক আর মেধাবীদের নিয়ে নয় বরং 'কাদের অগ্রগতি এবং সামাজিক গতিশীলতার স্বপ্ন দেখার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে' তা নিয়ে।
৪. নিরাপত্তাহীনতা এবং গৃহহীনতা: স্বাধীনতার সুপ্ত মুখ
'সাবওয়েতে গৃহহীনদের পরিষেবা প্রদান'-এর ওপর মামদানির নীতির সম্ভাবনা নিয়ে ওই প্রবন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু এই উদ্বেগগুলো কি সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়? বিশ্বের আর্থিক রাজধানী নিউইয়র্কের পাতাল রেলে প্রতিরাতে হাজার হাজার গৃহহীন মানুষ ঘুমায়! যদি এই স্তরের সম্পদের অধিকারী একটি সমাজ তার দুর্বলতম সদস্যদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে না পারে, তাহলে অবশ্যই প্রশ্ন দাঁড়ায়- 'কোনটি আসলে বেশি বিপজ্জনক: মামদানির ধারণা নাকি পুঁজিবাদের বাস্তবতা?'
৫. বৈধতার সংকট; বাজারে বিশ্বাসের অবসান
এমনকি ওয়াশিংটন পোস্ট নিজেই স্বীকার করেছে যে মামদানী হলেন ১৯৬৯ সালের পর প্রথম মেয়র প্রার্থী যিনি দশ লক্ষেরও বেশি ভোট পেয়েছেন। এই পরিসংখ্যান নির্বাচনের চেয়েও বেশি কিছুর কথা বলে: 'বিদ্যমান ব্যবস্থার ব্যাপারে জনগণের গভীর ক্লান্তি'। যখন মিডিয়া জগতের অভিজাতরা তার বিজয়কে 'শ্রেণীযুদ্ধের লক্ষণ' বলে, তখন তারা আসলে রাজনীতির দৈনন্দিন জীবনে ফিরে আসার বিষয়ে ভয় পায়; মানুষ আবারও নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করে বসবে-কেন তাদের এমন একটি অর্থনৈতিক কাঠামো সহ্য করা উচিত যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠরা একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুর বেঁচে থাকার জন্য কাজ করে।
দুটি অচলাবস্থা, একটি অভিন্ন ব্যথা
ওয়াশিংটন পোস্ট, মুক্ত বাজারের রক্ষক হিসাবে, সমাজতন্ত্রকে বিপজ্জনক হিসাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করে, এবং মামদানি, তার আদর্শবাদী উচ্ছ্বাসের সাথে, পুঁজিবাদকে শত্রু হিসাবে দেখে। কিন্তু সম্ভবত সত্যটি এ দু'য়ের মাঝখানে কোথাও রয়েছে। পুঁজিবাদ, লাভ এবং প্রতিযোগিতার নির্মমতার সাথে, মানুষের মর্যাদা কেড়ে নিয়েছে; এবং সমাজতন্ত্র, রাষ্ট্র এবং বন্টনের ওপর তার মনোযোগ দিয়ে ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়েছে। উভয়ই, বিভিন্ন ফরমেটে মানুষকে বুঝতে অবহেলা করেছে। সম্ভবত সময় এসেছে 'মতবাদ' ত্যাগ করে নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করার:
যদি অর্থনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য 'আরও মানবিক জীবন' হয়, তাহলে আমরা যতই সামনে যাই কেন মানুষ ততই প্রান্তিক হয়ে যায়? এর উত্তর নিউইয়র্ক থেকে ওয়াল স্ট্রিট পর্যন্ত রাস্তাঘাটে স্পষ্ট, যেখানে পুঁজির আকাশচুম্বী ভবনের ছায়ায় থাকা মানুষ এখনও ঘুমানোর জন্য মাথার উপর ছাদ খুঁজছে।#
পার্সটুডে/এনএম/৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।