সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ ছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগেই
নারী: মানব-ফুল-৩৬ (নারীর শিক্ষা ও সামাজিক তৎপরতা)
ইসলাম নারী ও পুরুষকে মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদা দেয়। তাই সামাজিক ও রাজনৈতিক তৎপরতায়ও নারীর অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দিয়েছে পবিত্র এই ধর্ম।
মহানবী (সা) মুসলমানদের নেতা হিসেবে প্রথম যে ঘটনায় তাঁদের বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ আদায় করেছিলেন সেখানে নারীরও অংশগ্রহণ ছিল। নারীদের বাইয়াত আদায়ের ওই ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে বাইয়ুাতুননিসা নামে খ্যাত। পবিত্র কুরআনে সুরা মুমতাহিনার ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
হে নবী, ইমানদার নারীরা যখন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবী করবে না এবং ভাল কাজে আপনার অবাধ্যতা করবে না, তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করুন এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়ালু।
ইরানের ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (র)'র দৃষ্টিতে ইসলাম ধর্ম ও রাজনীতি পরস্পর অবিচ্ছিন্ন। তাই রাজনীতিতেও এ ধর্মের উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব থাকা জরুরি। তাই রাজনীতির অঙ্গনেও নারীর সক্রিয় উপস্থিতি থাকা উচিত বলে তিনি মনে করতেন। শাহের স্বৈরতান্ত্রিক ও পাশ্চাত্যের প্রতি দাসত্বসুলভ শাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ইরানি নারী সমাজের ভূমিকার প্রশংসা করে ইমাম খোমেনি ইসলামী রাষ্ট্রকে সুপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাতেন। তিনি বলতেন, রাজনৈতিক বিষয় কেবল বিশেষ কোনো শ্রেণীর হাতে সীমাবদ্ধ নয়... নারীরও তাতে ভূমিকা রাখা উচিত এবং সমাজ রক্ষার জন্য তাদেরকেও পুরুষের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক তৎপরতায় অংশ নিতে হবে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগেও দেখা যায় মুসলমানদের যে দলটি মক্কা থেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিল সেই দলে এবং মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকারী মুসলমানদের দলেও নারী উপস্থিত ছিলেন। এর মাধ্যমে মক্কার জালিম ও তাগুতি শাসকদের প্রতি নারীদের বিরোধিতা প্রকাশ পেয়েছে।
এ ছাড়াও মহানবীর (সা) যুগে নারী সমাজ তাদের প্রতিনিধি পাঠাতেন সর্বকালের সেরা এই মহামানবের কাছে যাতে তারা নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে সেসবের উত্তর জানতে পারেন এবং তাদের ইচ্ছাগুলো তুলে ধরতে পারেন। এ ছাড়াও সে যুগে মুসলিম নারীরা মহানবীর ইমামতিতে অনুষ্ঠিত জুমার নামাজের জামায়াত, ঈদের ও দৈনন্দিন নামাজের জামায়াতেও অংশ নিতেন। মহানবীর (সা) স্ত্রীগণ নারীদের জন্য শিক্ষামূলক নানা ক্লাসে শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতেন। এ জন্যই বিভিন্ন হাদিসের বর্ণনা পাওয়া যায় রাসূলের স্ত্রীগণের সূত্র বা নামের উল্লেখসহ।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিম নারী সমাজ জিহাদের ময়দানে ও রণক্ষেত্রের পেছনের সারির নানা কাজেও অংশ নিতেন। যেমন, তারা যোদ্ধাদের জন্য খাবার ও পানি পৌঁছে দেয়ার কাজে, ওষুধ তৈরি ও তা বণ্টনের কাজে, যোদ্ধাদের অস্ত্র ও নানা সামগ্রী পাহারা দেয়াসহ সেসব তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং অস্ত্র-শস্ত্র মেরামতের কাজেও ভূমিকা রাখতেন। জিহাদে অংশ নেয়া নারীদের জন্য ফরজ না হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম নারীরা সামরিক তৎপরতা চালাতে যুদ্ধ-ক্ষেত্রে যেতেন। নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা (সা.আ) তাঁর স্বল্প পরিসর জীবনে যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই সামাজিক তৎপরতায় অংশ নিয়েছেন। তিনি ইসলামী শিক্ষা তুলে ধরা ও প্রশিক্ষণের কাজেও অংশ নিয়েছেন যাতে মুসলিম নারীরা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখতে পারেন। হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আলাইহা) স্বেচ্ছাসেবী বা সহায়ক কর্মী হিসেবে কোনো কোনো জিহাদের ময়দানেও উপস্থিত ছিলেন। যেমন, উহদের যুদ্ধের সময় তিনি স্বেচ্ছাসেবিকার ভূমিকা পালন করেছিলেন।
হযরত ফাতিমা জাহরা (সা. আ) মহানবীর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলীর নেতৃত্বের অধিকার বিষয়ে মসজিদে বক্তব্য রেখেছিলেন এবং এ বিষয়ে রাসূলের উপদেশগুলো স্মরণ করিয়ে দিতে মুহাজির ও আনসারদের ঘরে ঘরে গিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। হযরত ফাতিমা নিজের ঘরকে বনি হাশিমের মুজাহিদদের সংঘবদ্ধ হওয়ার স্থান হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং ফাদাক নামক বাগানের আয় থেকে তাদের খরচ মিটিয়েছেন। আর এইসব কাজকেই হযরত ফাতিমার রাজনৈতিক ও সামাজিক তৎপরতা বলা যায়।
সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলিম নারীর অংশগ্রহণের আরেক বড় দৃষ্টান্ত ছিলেন ইমাম হুসাইনের বোন হযরত যাইনাব (সা.)। তিনি কুফাবাসী নারীদের আমন্ত্রণে তাদের জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন। কারবালার মহাবিপ্লব তথা আশুরার বিপ্লবের সুরক্ষা সম্ভব হত না হযরত যাইনাবের বিপ্লবী ভূমিকাগুলো পালন ছাড়া। বন্দি অবস্থায়ও শালীনতা ও খোদাভীতি বজায় রেখেই তিনি সাহসিকতাপূর্ণ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্য রেখে ইবনে জিয়াদ ও ইয়াজিদের ক্ষমতার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। আর এ থেকেই তাঁর বিদ্যা-বুদ্ধি ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা ফুটে ওঠে।
আমাদের আজকের এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে ইসলাম সামাজিক সুরক্ষার তাগিদে রাজনৈতিক ও সামাজিক তৎপরতায় নারীর অংশগ্রহণকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে। অন্যদিকে পাশ্চাত্যে নারীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা হয় বা ব্যবহার করা হয় পণ্য হিসেবে মানুষ হিসেবে নয়। মোট কথা সুসন্তান গড়ে তোলাসহ সমাজ ও সভ্যতার বিনির্মাণে নারীর ভূমিকা পালন ও দায়িত্বকে অসাধারণ এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/০৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।