জুলাই ৩১, ২০১৬ ১৫:১৯ Asia/Dhaka

বলছিলাম যে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশটি কেবল ঐতিহাসিক নিদর্শনের জন্যেই বিখ্যাত নয় বরং এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। এ কারণে প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে ইরানের এই ভূখণ্ডটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে গৃহীত। এরিমাঝে আমরা আপনাদেরকে উঁচু টিলাময় অঞ্চল কান্দাভন পল্লীতেও নিয়ে গিয়েছি। আজ যাবো পূর্ব আজারবাইজানেরই সুন্দর প্রকৃতি রাজ্যের অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে।

পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। এখানে সংরক্ষিত একটি বিশাল এলাকা আছে। এলাকাটির নাম ‘আরাসবরন’। ইউনেস্কোতে এই এলাকাটি ইকো-ট্যুরিজম স্পটের অনন্য একটি এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। দেশের সীমা পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ইকো ট্যুরিজম স্পটের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবার ফলে স্বাভাবিকভাবেই আরাসবরনের পরিচিতিও বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি পেয়েছে। সে কারণে সারা বছর ধরেই দেশী বিদেশী পর্যটকদের ভীড়ে আরাসবরনের পরিবেশ থাকে কল-কোলাহল মুখরিত সতেজ ও প্রাণবন্ত। আশি হাজার হেক্টরেরও বেশি এলাকা জুড়ে আরাসবরন অবস্থিত। পূর্ব আজারবাইজানের উত্তর পশ্চিমে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর মাঝখানে পড়েছে এ এলাকাটি। আরাসবরনের পশ্চিমে রয়েছে ‘এইলগানেহ চয়ি’ আর পূর্বে রয়েছে ‘কালিবার চয়ি’। দক্ষিণ দিকটা অবশ্য ‘সয়িগারম’ চূড়ার সাথে গিয়ে লেগেছে।

ইকোলোজিক্যাল দৃষ্টিকোণ, সামাজিক কাঠামো, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এ এলাকাটি সমগ্র ইরানের মধ্যে একটি অনন্য অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত। আবহাওয়াগত অনন্য বৈশিষ্ট্য, গোত্রীয় ও জাতীয় বিভিন্ন ঐতিহ্যের দিক থেকেও পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে আরাসবরন সম্পূর্ণ আলাদা। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কিংবা শিকার করা বা মৃগয়ার মতো বৈশিষ্ট্যগুলোর চমৎকারিত্বের কথা বাদ দিলেও বিচিত্র উদ্ভিদ, বিরল প্রজাতির পশুপাখি, বিশাল বিস্তৃত নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য এতো আকর্ষণীয় যে, এ কারণেই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে এলাকাটিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং তার দু’বছর পর সংরক্ষিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

অসিয়বে খারা’বে

 

আরাসবরনে অঞ্চলে বিশ্বের দুর্লভ এবং বিরল পাখিগুলোর একটি পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে এই পাখিটিকে বলা হয় ‘কারে খুরুস’। কারে শব্দের অর্থ হলো কালো আর খুরুস মানে হলো মোরগ। তার মানে হলো কালো মোরগ। ইউনেস্কো তাই আরাসবরন সংরক্ষিত এলাকাটিকে বিশ্বের মূল্যবান প্রাকৃতিক অঞ্চল হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। কৃষিক্ষেত, নদীমালা, চারণভূমি, বন-জঙ্গল, প্রস্তরময় অঞ্চল ইত্যাদি সবকিছুরই সমাবেশ ঘটেছে আরাসবরনে। এর বাইরে চিতাবাঘ, নেকড়ে, খয়েরি ভালুক, বুনো শুকর, ছাগল প্রভৃতি জীবজন্তুর মতো মূল্যবান প্রাণীগুলোও এখানে বসবাস করে নির্বিঘ্নে। আরাসবরনের স্থানীয় পাখিগুলোর মাঝে ‘কারে খুরুসে কাফকযি’ বাংলায় এর অর্থ দাঁড়াবে ককেশাসীয় কালো মোরগ, তিতির জাতীয় পাখি, ফ্রাঙ্কোলিন জাতীয় তিতির, রঙিন ফিযেন্ট, বিচিত্র রকমের শিকারী পাখি, জলে বাস করে এমন বহু রকমের পাখি এবং স্থলে বসবাসকারী পাখির কথা উল্লেখ করা যায়। আরাসবরন সংরক্ষিত এলাকায় ২১৫ রকমের পাখি, ২৯ রকমের সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী, পাঁচ রকমের উভচর প্রাণী, ৪৮ রকমের স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ১৭ রকমের মাছ সনাক্ত করা হয়েছে।  

কালো মোরগ

আরাসবরন সংরক্ষিত এলাকাটি সবুজের বিচিত্র প্রাকৃতিক আয়োজনে ঢাকা। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এই এলাকারও প্রাকৃতিক পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন ঋতুভিত্তিক প্রকৃতির সাথে কেমন যেন চমৎকার মানিয়ে যায়। সেজন্যে সকল ঋতুতেই এখানকার সৌন্দর্য থাকে অটুট এবং বৈচিত্রময়। আরাসবরনের বন জঙ্গল আর বিস্তীর্ণ প্রান্তর ও চারণভূমির দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই এলাকার অপর একটি বিস্ময়। আরাসবরনের চারণভূমিতে বিচিত্র ঘাস লতা পাতা কাঁটা গুল্ম ইত্যাদি পুরো এলাকাটিকে শ্যামলিমায় ভরে রাখে। এখানকার বাগান কিংবা জঙ্গলে সোমগ, যেরেশক, বুনো আনার, আপেল এবং বুনো নাশপাতি বেশ ফলে। সোমগ হলো এ ধরনের মশলা আর যেরেশক হলো মেরুন রঙের এক রকম বুনো ফল, এগুলোকে শুকিয়ে কিশমিশের মতো মশলা হিসেব পোলাওতে ব্যবহার করা হয়। তবে এর স্বাদ মিষ্টি নয় হালকা টক। পোলাওয়ের ওপরে যেরেশক ছিটিয়ে দিয়ে গার্নিশ করা হয়। তো এতোসব মশলাপাতি গাছ যে জঙ্গলে রয়েছে সেই জঙ্গলটা যে মোটামুটি অসমৃদ্ধ নয়, তা সহজেই বলে দেওয়া যায়।

এ পর্যন্ত পরিচালিত গবেষণামূলক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আরাসবরন সংরক্ষিত অঞ্চলে এ পর্যন্ত এক হাজার তিন শ’ রকমের উদ্ভিদ সনাক্ত করা হয়েছে। অবশ্য আরাসবরন সংরক্ষিত এলাকাটির গুরুত্ব কেবল এর ইকোলজিক্যাল দিক বা পরিবেশগত কারণেই নয়, বরং এ এলাকার সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। এখানে রয়েছে বেশ কিছু কেল্লা বা প্রতিরক্ষা দূর্গ। এগুলো যথেষ্ট পুরোণো। এসব কেল্লা নিয়ে সামান্য চিন্তাভাবনা করলেই একটি বিষয় অন্তত স্পষ্ট হবে, সেটা হলো আরাসবরনের জনগণ আর যাই হোক, শত্রুদের মোকাবেলায় যে বীরত্বপূর্ণ এবং সাহসী ভূমিকা পালন করেছে, সে বিষয়ে কোনোরকম সন্দেহ নেই।

কুরি গোল পুকুর

 

পূর্ব আজারবাইজানে ছোট বড়ো মিলিয়ে বেশ কয়েকটি পুকুর বা জলাধার রয়েছে। মারা’গেহ এবং হাশ্তরুদ শহরেই এগুলোর বেশিরভাগ পড়েছে। এইসব পুকুর শহরের সৌন্দর্য যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি আবহাওয়া ও পরিবেশগত দিকটিও নিশ্চিত করেছে। এগুলোর মধ্যে ‘কাররে কাশলক’, কুরি গোল, অলমা’গোলি, কাবদলু, মহিঅবদ, ইয়নিক গোলি এবং কুশা’গোলির নাম উল্লেখযোগ্য। কোরে কাশলক জলাধারটি উরুমিয়ে হ্রদের দক্ষিণ-পূর্ব তীরে অবস্থিত। প্রাকৃতিক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে জল এবং স্থলে বসবাসকারী বিচিত্র পাখির বাস রয়েছে। এর বাইরেও রয়েছে মেষ এবং মোরগের মতো পশু পাখির বিচরণ। এই জলাধারটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। কুরি গোল জলাধারটিও তাব্রিয থেকে চল্লিশ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এই জলাধারটি পাখিদের জন্যে বিশেষ করে জলে যেসব পাখির খাবার সংকুলানের ব্যবস্থা রয়েছে যেমন সাদা হাঁস জাতীয় পাখি, তাদের জন্যে একেবারেই নিরাপদ। এই জলাধারটিও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।

পূর্ব আজারবাইজানের আরেকটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে ‘অসিয়বে খারা’বে’ বা ‘খারা’বা দিরমন’। তাব্রিয শহর থেকে ১৩৫ কিলোমিটার উত্তরে জোলাফা সীমান্ত এলাকায় এটি অবস্থিত। সবুজে ঘেরা সুন্দর এই এলাকাটিতে দর্শনার্থীরা প্রবেশ করে মনের অজান্তেই আল্লাহর এতো চমৎকার শিল্প-নিপুণ সৃষ্টির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যান। এখানে বয়ে চলে চমৎকার ঝর্ণাধারা। ঝর্ণা ধারার দুই তীরে মোটা মোটা সবুজ পাতার ছায়াময় ডুমুর গাছ পুরো এলাকাটিকে দিয়ে সৌন্দর্যের আমেজ এবং বিশ্রামের সুশীতল আশ্রয়। ঝর্ণাধারার নিরন্তর বহমানতার কুলুকুলু ধ্বনি প্রকৃতি প্রেমিকদের হৃদয়ের ভেতর দিয়ে যেন সঙ্গীতের মতো বয়ে যায়। এই সঙ্গীতের ধ্বনি আপনার কানের ভেতর দিয়ে মনের গহীনে প্রবেশ করাবেন সময় সুযোগমতো এই প্রত্যাশা রইলো।*

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/৩১/টি-৪৪/অ-৪২