আগস্ট ৩০, ২০১৬ ২১:২০ Asia/Dhaka

গত পর্বে আমরা বলেছিলাম ইরানের উত্তর পশ্চিমে আজারবাইজান নামে একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল রয়েছে। ঐ অঞ্চলটিকে তিনটি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছেঃ পূর্ব আজারবাইজান, পশ্চিম আজারবাইজান এবং আর্দেবিল। ইতোমধ্যে আমরা পূর্ব আজারবাইজান এবং পশ্চিম আজারবাইজান নিয়ে কথা বলেছি। আজকের পর্বে আমরা যাবো আর্দেবিল প্রদেশের দিকে।

ইরানের উত্তর পশ্চিমে এবং সাবালান সু-উচ্চ পাহাড়ের পাশেই আর্দেবিল প্রদেশটি অবস্থিত। প্রদেশটির আয়তন আঠারো হাজার বর্গ কিলোমিটার। আর্দেবিল প্রদেশের উত্তর এবং উত্তর পূর্বে রয়েছে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র, পূর্ব এবং দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত গিলান প্রদেশ, পশ্চিমে অবস্থিত পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশ আর দক্ষিণে রয়েছে যানজন প্রদেশ। আর্দেবিল প্রদেশটি ইরানের প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক সকল দিক থেকেই যথেষ্ট সমৃদ্ধ একটি এলাকা। এ অঞ্চলের ভূ-তাত্ত্বিক এবং প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগত পরিস্থিতির কারণে আর্দেবিল প্রদেশটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং এর দৃশ্যাবলি এতো বেশি মনোমুগ্ধকর। সাবালনের পার্বত্য সৌন্দর্য এবং এখানকার সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, সেইসাথে এখানকার গরম জলের নহর, ছোটো ছোটো অসংখ্য প্রাকৃতিক হ্রদ ইত্যাদি ইরানের এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক লীলা বৈচিত্রের সংক্ষিপ্ত তালিকার মধ্যে পড়ে।

আর্দেবিলের একটি হ্রদ

 

সাবালন পর্বতমালা অনেকগুলো পর্বতের সমন্বয়ে সৃষ্ট। এই পর্বতমালার সবচেয়ে উঁচু চূড়াটির নাম হলো ‘সুলতান সাবালন’ চূড়া। সবোর্চ্চ এই চূড়াটির উচ্চতা হলো চার হাজার আট শ’ এগারো মিটার। ইরানে যতোগুলো পর্বত চূড়া রয়েছে সেগুলোর মাঝে সবচেয়ে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় হলো এই সাবালন চূড়াটি। এই সৌন্দর্যের কিছু প্রত্যক্ষ রহস্য রয়েছে। যেমন এই চূড়াটির উচ্চতায় রয়েছে দৃষ্টিনন্দন চমৎকার একটি হ্রদ। এ কারণেই ইরানের পর্বতগুলোর মধ্যে এই চূড়াটির একটা বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। এখানে আরো একটি বিস্ময়কর জিনিস রয়েছে। সেটা হলো প্রাকৃতিক হিমাগার। বিস্ময়কর বললাম এজন্যে যে, প্রাকৃতিক এই হিমাগারটি চারদিক থেকেই পর্বত চূড়াটিকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু এখানে থেকে বেশ কয়েকটি জলের ধারা বেরিয়ে গেছে। এগুলোর সবই গরম পানির ধারা। বরফাচ্ছাদিত পর্বত চূড়া থেকে বেরিয়ে এসেছে গরম  জলের ধারা-সত্যিই বিস্ময়কর। এখানে আরো রয়েছে চার হাজার মিটারেরও বেশি উঁচু উঁচু অনেক পর্বতচূড়া। এগুলোর মধ্যে রয়েছে হেরাম দগ চূড়া, কেসরা দগ চূড়া, এইলগর চূড়া, গেযেল দগ চূড়া এবং  গুশা চূড়া। এই এক গুচ্ছ পর্বতচূড়া আর্দেবিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই পাল্টে দিয়েছে।  

শোরাবিল

আর্দেবিল এবং পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে যেসব নদী রয়েছে সেগুলোর পানির উৎস হলো এইসব পর্বত চূড়া নিঃসৃত জলের ধারা। সাবালন পর্বতমালার উত্তর উপকূল ‘গারে সু’ নদী এবং ‘আহার চয়ি’ নদী পর্যন্ত বিস্তৃত আর দক্ষিণ উপকূল গিয়ে মিশেছে ‘তালখে রুদ’ বা ‘অজি চয়ি’ নদীর তীরে। আরাস নদীসহ উরুমিয়ে হ্রদের প্রয়োজনীয় পানির বিরাট একটা অংশেরও সংকুলান হয়ে থাকে এই সাবালন পর্বতমালা নিঃসৃত জলের ধারা থেকে। সাবালন উপত্যকায় এই যে গরম পানি এবং ঠাণ্ডা পানির বিচিত্র ধারা, এগুলো এই অঞ্চলের সৌন্দর্যকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সেইসাথে পরিবেশটাকেও দিয়েছে দূষণমুক্ত এক উপভোগ্য সুষমা।

আর্দেবিল প্রদেশটির নাম শাহসাভান উপজাতিদের নামের সাথে সম্পর্কযুক্ত। শাহসাভান উপজাতি কিংবা এইলসাভান উপজাতি হলো তারাই যারা দীর্ঘকাল ধরে এই সাবালন পর্বতমালার পাদদেশে ঠাণ্ডা এবং অর্ধ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে জীবন যাপন করে আসছে। এরা সবুজ শ্যামল এই প্রান্তরে বসবাস করে এখানকার আবহাওয়া এবং পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সাবালন পর্বতের টাওয়ারের মতো সু-উচ্চ চূড়া বছরের পর বছর ধরে এই উপজাতীয়দের কার্যক্রমের নিরব স্বাক্ষী হয়ে আছে। কখনো এই উপজাতীয়রা দক্ষিণ উপত্যকা থেকে উত্তরে আবার কখনোবা তার উল্টো দিকে যাওয়া আসা করেছে।

খনিজ গরম পানির ঝর্না

সামগ্রিকভাবে আর্দেবিল প্রদেশের আবহাওয়াকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। সাবালনের উঁচু এলাকাটি ঠাণ্ডা এলাকা। আর তুলনামূলকভাবে নীচু এলাকাটির আবহাওয়া গরম। তবে সামগ্রিকভাবে পুরো এলাকার মাঝামাঝি উচ্চতা সম্পন্ন অঞ্চলের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। এছাড়াও আর্দেবিল প্রদেশেটির আকর্ষণীয় দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক বহু নিদর্শন। রয়েছে গরম খনিজ জলের ধারা, রয়েছে অসংখ্য হ্রদের উপস্থিতি, রয়েছে শিকারের উপযুক্ত বন জঙ্গল, আরো রয়েছে বিনোদনের জন্যে বহু অবকাশ কেন্দ্র। উপভোগ্য আবহাওয়ার বাইরেও এইসব আকর্ষণীয় দিকগুলোর জন্যে আর্দেবিলে সারা বছর জুড়েই ভ্রমণেচ্ছুদের আনাগোণা দেখা যায়। এখানে যে কেবল ইরানের বিভিন্ন প্রান্তের ভ্রমণ পিপাসুরাই আসেন তা নয় বরং দেশের বাইরে থেকেও বহু পর্যটক বেড়াতে আসেন আর্দেবিলে।

আর্দেবিল প্রদেশটি কৃষিকাজের জন্যেও বেশ উপযোগী। কিংবা বলা যেতে ইরানের মধ্যে কৃষিকাজের জন্যে আর্দেবিল প্রদেশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যেসব কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয় তার মধ্যে রয়েছে গম, যব, গোল আলু, বিভিন্ন ধরনের শস্যদানা এবং তেলবীজ। এর বাইরেও বিভিন্ন জাতের ফল ফলাদি তো রয়েছেই। স্বাভাবিকভাবেই এখানে গড়ে উঠেছে ‘মোগন শিল্প ও কৃষি’ কমপ্লেক্স। কৃষিজাত পণ্যসহ আরো বহু শিল্প পণ্য সামগ্রী উৎপাদনের দিক থেকে তাই আর্দেবিলকে সমগ্র ইরানের মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ হিসেবে গণ্য করা হয়।

আর্দেবিল প্রদেশের অন্যান্য বিশেষত্বের মধ্যে উল্লেখ করার মতো আরো বিভিন্ন দিক রয়েছে। যেমন এখানে পশুপালনের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে। সাবালন পার্বত্য উপত্যকার পাদদেশে অসংখ্য চারণভূমি থাকার কারণে পশুপালনের এই পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। আর পশুপালনকে ঘিরে আরো কিছু পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। যেমন গোশত, দুধ এবং দুধ থেকে তৈরি হয় যেসব পণ্য অর্থাৎ দধি, পণির, মাখন, সর, মাঠা, ঘি জাতীয় প্রোটিন সামগ্রী ইত্যাদি। তাছাড়া বনাঞ্চল হবার কারণে মধুও পাওয়া যায়। এখানে পাখি পোষার যেমন ব্যবস্থা রয়েছে তেমনি রয়েছে মধু চাষেরও প্রচলন রয়েছে। অনেকেই এখন এইসব পেশায় জড়িত রয়েছেন।

শুরুতেই বলেছিলাম এখানে ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান বহু নিদর্শনও রয়েছে। এইসব নিদর্শন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে ইসলাম পূর্ববর্তী যুগের ইরানী সভ্যতার সাথে সংযুক্ত করে। খ্রিষ্টপূর্ব চার হাজার বছর আগে থেকেই এই এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠেছে বলে ইতিহাসবিদদের অভিমত। ‘শায়খ সাফিউদ্দিন আর্দেবিলি’র জাঁকজমকপূর্ণ সমাধি’ এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর অন্যতম। প্রাছীন বহু হাম্মাম, বিশাল বিশাল অনেক ভবন, বিখ্যাত অনেক ব্যক্তিত্বের কবরসহ আরো বহু নিদর্শন রয়েছে দেখার মতো। সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক নিদর্শনের বাইরেও হস্তশিল্প সামগ্রীও এখানকার আরো কিছু উল্লেখোগ্য আকর্ষণ। এখানে আরো রয়েছে স্টিল, স্বর্ণ, তামা, সীসা, যিঙ্ক ইত্যাদির মতো বহু রাসায়নিক পদার্থের খনি।*

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/টি:৫১/অ:৫১/ই:৫১/৩০