মার্চ ১৮, ২০১৭ ১৫:৪৩ Asia/Dhaka
  • ইসলামের দৃষ্টিতে নওরোজ

নওরোজ ফার্সি ভাষার দু’টি শব্দের মিলিত রূপ। নও অর্থ নতুন এবং রোজ মানে দিন। কাজেই নওরোজ মানে নতুন দিন।  তবে বিশেষ অর্থে ফার্সি বছরের প্রথম দিনটিকে নওরোজ বলা হয়। 

বসন্তের প্রথম দিন নওরোজ পালনের মধ্যদিয়ে এদেশের নতুন বছরের উৎসব উদযাপন শুরু হয়। ইরানে এখন শীতের আমেজ শেষ হয়ে দিকে দিকে বসন্তের ফুল ফুটতে শুরু করেছে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজানো শুরু হয়েছে।  প্রকৃতির এই পরিবর্তন মানুষের মনেও জাগিয়েছে নতুন রং, দিয়েছে পুরনোকে ধুয়ে মুছে আরেকটি নতুন বছর শুরু করার প্রেরণা।  ইরানিরা হাজার হাজার বছর ধরে পালন করে আসছে এই নওরোজ উৎসব।  বর্তমানে ইরান ছাড়াও ফার্সি ভাষাভাষী আরো বেশ কয়েকটি দেশে পালিত হয় নওরোজ। আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক এবং ইরাকেও এ উৎসব জাতীয় পর্যায়ে পালিত হয়। এছাড়া, উৎসবটি কম-বেশি পালিত হয় জর্জিয়া, পাকিস্তান ও ভারতেও। ইরান থেকেই এই উৎসবের জন্ম হয়েছে এবং কয়েক হাজার বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এই উৎসবে এতটুকু ভাটা পড়েনি। ইসলামের আবির্ভাবও নওরোজকে ম্লান করে দিতে পারেনি। কারণ, মানবতার মুক্তির এই ধর্ম অন্যান্য জাতি ও ধর্মের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সম্মান জানিয়েছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে নববর্ষ পালন প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তিকে আরো দ্রুত গতিতে আত্মিকতার পথে অগ্রসর হওয়ার প্রেরণা যোগায়। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মানুষকে সব খারাপ ও পাপকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়ে পুণ্যের পথে অগ্রসর হওয়ার শপথ যোগায় নওরোজ।  ইমাম আলী (আ.) যেমনটি বলেছেন, মুমিন যেদিন গোনাহ করবে না সেদিনই তার জন্য ঈদ বা উৎসবের দিন। এই সৃষ্টিজগতের যে একজন প্রতিপালক আছেন এবং মৃত্যুর পর আবার পুনরুজ্জীবিত হয়ে একদিন যে তার কাছে আমাদেরকে জবাবদিহী করতে হবে- এই বিষয়টিতে যাদের সন্দেহ আছে তাদের জন্য চিন্তার অপার দুয়ার খুলে যায় নওরোজ এলে।  তারা দেখতে পায়, প্রতি বছর নববর্ষে কীভাবে মৃতপ্রায় ভূমি প্রাণ ফিরে পায়, মৃতসম গাছগুলিতে কীভাবে নতুন পাতা গজানোর মাধ্যমে প্রাণের সঞ্চার হয়। নববর্ষের আগমন মানুষের অন্তরে যেন কিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সূরা রুমের ৫০ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে, “আল্লাহর রহমতের নিদর্শন দেখে নাও, কিভাবে তিনি মৃত্তিকার মৃত্যুর পর তাকে জীবিত করেন। নিশ্চয় তিনি (কিয়ামতের দিন) মৃতদেরকে জীবিত করবেন এবং তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।

মুসলিম চিন্তাবিদরা মনে করেন, নওরোজের সঙ্গে ইসলামি শিক্ষা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার পর এই উৎসব কুসংস্কারমুক্ত হয়েছে।  ইরানের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ড. শারিয়াতি এ সম্পর্কে বলেন, “ইসলাম নওরোজের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে, একে বিক্ষিপ্ততার হাত থেকে রক্ষা করে এই উৎসবকে ধ্বংস থেকে বাঁচিয়েছে।  ইসলাম আসার পর সম্পূর্ণ জাতীয় ঘরানার এই উৎসবে যোগ হয়েছে ধর্মীয় আমেজ। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ইরানিরা শুরু থেকেই ইসলামকে সাদরে গ্রহণ করেছে এবং এই ঐশী ধর্মের উন্নতি, সমৃদ্ধি ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।”

অপচয় ও বিলাসী জীবন পরিহার করা, অহংকার ও আত্মম্ভরিতা থেকে দূরে থাকা, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা ও শত্রুতা ভুলে যাওয়া, পিতামাতা ও বয়োবৃদ্ধদের সঙ্গে সদাচারণ, গত এক বছরের বস্তুগত ও আত্মিক কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন এবং ছোট-বড় ভ্রমণ হচ্ছে ইরানি নওরোজের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য। ইরানিরা নতুন বছর এলে এসব ভালো কাজ করার শপথ নেয়। এই কাজগুলো নওরোজ উৎসবকে সত্যিকারের ঈদ উৎসবে পরিণত করে। নতুন বছর শুরুর মুহূর্তে ইরানিরা ‘আহসানুল হাল’ নামক একটি বিশেষ দোয়া করার মাধ্যমে নতুন বছরে চলার পথে মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করে।

চিত্তবিনোদন মানুষের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা।  কারণ, দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনে মানুষের দেহ ও মন এক সময় ক্লান্তিতে ভরে ওঠে।  এই ক্লান্তি দূর করার জন্য তার প্রয়োজন বিনোদন। ইসলাম মানুষের জন্য পরিপূর্ণ জীবন বিধান নিয়ে এসেছে বলে এ ধর্মে মানুষের জন্য সুস্থ বিনোদনের পথও বাতলে দিয়েছে।  নওরোজ হচ্ছে সেই সুস্থ বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ।

বসন্তের সাজে প্রকৃতিকে যতটা সুন্দর লাগে বছরের আর কোনো সময়ই তাকে ততটা সুন্দর মনে হয় না। ফলে এ সময়ে মানুষের মনে যে আনন্দ ও উৎসবের আমেজ তৈরি হয় অন্য সময়ে তা পাওয়া কঠিন। এই সময়ে প্রকৃতিতে ভ্রমণ ও চিত্তবিনোদনে মশগুল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইসলাম। এই ধর্মে বলা হয়েছে, প্রকৃতিতে বিচরণ ও এর সৌন্দর্য তোমাদেরকে এর স্রষ্টার কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।  সূরা আনকাবুতের ২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: “বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ, কিভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ (একইভাবে) পুর্নবার (পরকালীন জীবন) সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।”

মৃত প্রকৃতির জীবিত হয়ে ওঠার পাশাপাশি পুরনো সব কিছু ধুয়েমুছে নতুনের সমারোহ হয় বলে নওরোজে সত্যিই চারিদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। এ সময়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও যেকোনো ভ্রমণ মানুষকে একঘেঁয়ে জীবনের গণ্ডি থেকে বের করে আনে। মানুষ সত্যিকার অর্থে সুখ ও আনন্দের সন্ধান পায়। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম জাফর সাদেক (আ.)  এ সম্পর্কে বলেছেন, বুদ্ধিমান মানুষ হালাল বিনোদন পাওয়ার জন্য সফরে বের হয়। তিনি অন্যত্র বলেছেন, সুস্থ দেহ ও সুস্থ মন পেতে চাইলে ভ্রমণ করো। কাজেই দেখা যাচ্ছে, আল্লাহর ওলীরা পর্যন্ত  শারিরীক ও মানসিক অবসাদ কাটিয়ে শরীর ও মনকে চাঙ্গা করার জন্য ভ্রমণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

এ বছরের নওরোজ উৎসব পড়েছে আরবি রজব মাসে। এই মাসে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ খুশির দিন থাকায় এবার ইরানিদের ঈদের আনন্দ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। হাদিসে এসেছে, রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবারের রাত হচ্ছে লাইলাতুর রাগাইব বা আকাঙ্ক্ষার রাত। রজব মাসের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে এই রাতের ওপর আলেকপাত করতে গিয়ে মহানবী (সা.) একথা বলেন।  এই রাতে আল্লাহ তায়ালার কাছে মনের কথা খুলে বলে যা কিছু চাওয়ার তা চেয়ে নিতে বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে এই রাতের রয়েছে বিশেষ কিছু আমল। রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ আদায়, কুরআন তেলাওয়াত ও দীর্ঘ মুনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে মহান স্রষ্টা মানুষকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন না। তাঁর দয়ার ভাণ্ডার অসীম এবং বান্দার জন্য কখনো  এই ভাণ্ডার বন্ধ হয় না। নওরোজের সঙ্গে এই পবিত্র রাত মিলে যাওয়ার কারণে ইরানিরা এবার বৈষয়িক ও আত্মিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য এই রাতকে ব্যবহার করতে পারছে। এই রাতে এক আল্লাহর ধ্যানে মশগুল হলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে গত এক বছরের ভুলগুলো স্মরণের মাধ্যমে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ উপায় বেরিয়ে আসবে।

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/আশরাফুর রহমান/১৮

ট্যাগ