মে ১৫, ২০১৭ ২১:০২ Asia/Dhaka

একটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের জন্য যেমন একজন পরিচালক বা নেতা দরকার হয় তেমনি গোটা মানবজাতির জন্যেও পথ-প্রদর্শক বা নেতা থাকা জরুরি। মহান আল্লাহ সব সৃষ্টিকেই পূর্ণতা দানের ব্যবস্থা নিয়েছেন কোনো ধরনের ব্যতিক্রম ও দ্বিধা ছাড়াই। তাই মানব জাতির জন্য আদর্শ বা পূর্ণ মানব পাঠানোর ব্যাপারেও তিনি উদাসীন নন।

নবী-রাসূলরাই হলেন সেই আদর্শ মানব ও মানব-জাতির জন্য সঠিক পথের দিশারী। অন্য কথায় মহান আল্লাহ নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন মানুষকে পূর্ণতা দেয়ার জন্যই। মানুষকে যদি বিবেকের লাগামমুক্ত স্বাধীনতা দেয়া হত তাহলে তারা বিশ্বে যা খুশি তাই করে বেড়াত এবং দেখা দিত স্বার্থের সংঘাত ও নৈরাজ্য। ধ্বংস হয়ে যেত সমাজ ও সামাজিক সম্পর্ক। কিন্তু নবী-রাসূলরা মহান আল্লাহর বাণী ও মানুষের প্রকৃতির মধ্যে সংযোগ বা সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করে সমাজে শান্তি আর শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। উল্লেখ্য, মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে আল্লাহর বিধান ও বাণীর কোনো বিরোধ নেই, বরং রয়েছে মিল। নবী-রাসূলরা মানুষকে শিখিয়েছেন নৈতিকতা ও মহান মানবীয় মূল্যবোধ। নবী-রাসূলদের এইসব শিক্ষার অনুসরণ মানুষকে অহংকার ও স্বার্থপরতার মত নানা কুপ্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্ত করে তাদেরকে পরিণত করে প্রকৃত মানুষে।

নবী-রাসূলরা মানুষকে সৃষ্টির লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত করেছেন এবং তাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন জীবনের নানা ক্ষেত্রে কোনটি সঠিক ও কোনটি ভুল পথ। এভাবে তারা বিশ্বজগতে মানুষের অবস্থান তথা বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী স্পষ্ট করেছেন। ঐশী ধর্মগুলোর মূল বিশ্বাস ও মৌলিকতম শিক্ষা হল তাওহিদ বা একত্ববাদ। একত্ববাদ মানুষকে মুক্ত করে ভুল বা বাতিল চিন্তা-চেতনা এবং অলীক প্রভুগুলোর দাসত্ব থেকে। নবী-রাসূলরা মানুষের চিন্তা-জগতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি মানুষের অন্তরেও এনেছেন বিপ্লব। অর্থাৎ তারা মানুষের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক বা চিন্তাগত পরিবর্তনের পাশাপাশি তাদের আত্মাকেও করেছেন খোদা-প্রেমের অভিসারী। তাই বলা যায় মানব সমাজের কোনো দিকই নবী-রাসূলদের মহান শিক্ষাগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। মানব জাতির জ্ঞান-কাঠামোয় এই মহামানবদের শিক্ষাগুলোর ইতিবাচক ও গভীর প্রভাব বিশেষভাবে প্রনিধানযোগ্য। নবী-রাসূলরা মানুষকে শিখিয়েছেন মানব-প্রেম, ন্যায়-বিচার ও শান্তির সংস্কৃতি।

নবী-রাসূলরা এ দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন আল্লাহর রাজ্য যা হবে সবচেয়ে ন্যায়বিচার-ভিত্তিক রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের বিধান হবে খোদায়ী বিধান এবং শ্রেষ্ঠ  ও পূর্ণাঙ্গতম বিধান। আর এইসব বিধান বাস্তবায়ন করবেন সবচেয়ে যোগ্য ও সত ব্যক্তিরা। যুগের চাহিদা অনুযায়ী এ ধরনের রাষ্ট্রের বাহ্যিক চেহারা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু বিশ্বে এ ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে বলে পবিত্র কুরআনে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। সুরা আম্বিয়ার ১০৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, "আমার যোগ্য বান্দারা পৃথিবীর (শাসন-ক্ষমতার) অধিকারী হবে।" এ ধরনের রাষ্ট্রে থাকবে না স্বৈরশাসন এবং মানুষের ওপর মানুষের বলদর্পিতা। বরং ন্যায়বিচারপূর্ণ খোদায়ী রাষ্ট্রের শাসকরা খোদায়ী বিধানগুলোর বাস্তবায়নকারী হিসেবে মানুষের ওপর প্রভাবশালী হবেন ও তাদের আস্থাভাজন হবেন।

আলোচনার এ পর্যায়ে আমরা ব্রিটিশ নও-মুসলিম ম্যাকলিন-এর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘটনা ও ইসলাম সম্পর্কে তার অনুভূতিগুলো তুলে ধরব।

ম্যাকলিন কিশোর বয়স থেকেই ছিলেন সত্য-সন্ধানী। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন:  "আমি সেই কৈশোর থেকেই আত্মিক মুক্তির সন্ধান করতাম। এ জন্য ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম ও সম্মোহন এবং এ ধরনের তৎপরতায় অংশ নিতাম। কিন্তু কখনও প্রত্যাশিত আত্মিক-প্রশান্তি বা মুক্তি খুঁজে পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ও সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা করতে গিয়ে আরবী ভাষারও একটি কোর্সে ভর্তি হয়েছিলাম। একদিন আরবীর শিক্ষক আমাকে বললেন, 'আরবী ভাষার সঙ্গে আরো ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার জন্য কুরআন পড়তে পার। কুরআনকে বিশ্বাস করা বা না করা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নয়। কিন্তু তুমি যদি তা পড় তাহলে দেখবে যে এটা তোমার জীবনের অন্যতম সেরা আকর্ষণীয় বই। সত্যিই এটা পড়ার মত একটি বই।' 

এরপর পবিত্র কুরআনের একটি কপি সংগ্রহ করে তা পড়া শুরু করলাম। কুরআন অধ্যয়ন করে এর আলঙ্কারিকতা, বাগ্মিতা ও ভাষাশৈলিতার সৌন্দর্য অনুভব করলাম। যতই কুরআন পড়ছিলাম ততই কুরআনের প্রতি আমার ভালোবাসা বাড়তে লাগল।" এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ নও-মুসলিম ম্যাকলিন আরো বলেছেন,

"অবস্থা এমন হল যে যখন কুরআন পড়ায় মশগুল হতাম পারিপার্শ্বিক জগতকে ভুলে যেতাম। কেউ যদি আরবী ভাষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে থাকেন তাহলে দেখতে পাবেন যে কুরআনের শব্দগুলোর শৃঙ্খলা, মিল, স্টাইল ও ছন্দময়তা এতই অপূর্ব ও অনন্য যে, কোনো সাহিত্য-কর্মের ভাষাই সেসবের সঙ্গে তুলনার যোগ্য নয়।"

ব্রিটিশ নও-মুসলিম ম্যাকলিন আরো বলেছেন, " কুরআনের ভাষার অপূর্ব সূর, ছন্দ ও স্টাইলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার পর ধীরে ধীরে এর অর্থের দিকেও মনোযোগ দিতে লাগলাম। কুরআনের বাক্যগুলো নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা আমাকে এই বাস্তবতা হৃদয়ঙ্গম করালো যে, এই বইটিতে রয়েছে মানুষের জীবন পরিচালনার এক পরিপূর্ণ কর্মসূচি। আর এইসব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হলে মানুষের সৌভাগ্য নিশ্চিত হবে। এভাবে পবিত্র কুরআনের জ্ঞানের এক সুন্দর ও গভীর অর্থপূর্ণ জগত বাস্তবতার এমন এক জ্যোতি আমার হৃদয়ে বিকিরণ করল যে, কোনো শক্তিই এই নূরকে ম্লান ও অস্পষ্ট করতে পারবে না।"

ব্রিটিশ নও-মুসলিম ম্যাকলিন কুরআন অধ্যয়ন অব্যাহত রাখতে গিয়ে ইসলাম সম্পর্কেও গবেষণা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন,

 "ইসলামী শিক্ষাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও ইসলামী শিক্ষার কাঠামো আমাকে খুবই আকৃষ্ট করেছে। ইসলাম হচ্ছে এমন একটি ভবন যার বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় সেগুলোকে দান করেছে অপূর্ব সৌন্দর্য, পরিপূর্ণ ভারসাম্য ও শৃঙ্খলা। যে অংশটি যেখানে থাকা দরকার ইসলামে সেই অংশকে ঠিক সেখানেই রাখা হয়েছে। আমার মতে, ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ মানবজাতির প্রতি ইসলামের সবচেয়ে বড় উপহার। এ বিষয়টি সবচেয়ে জোরালো ঐক্য ও প্রকৃত ইসলামী সংহতি বয়ে এনেছে। অন্য কোনো ধর্ম ও মতাদর্শই বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জাতিগুলোকে এতটা গভীরভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। ইসলাম একটি যুক্তিবাদী, একত্ববাদী ও আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী আদর্শ ধর্ম।"

ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণার পর অবশেষে ম্যাকলিন ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজের জন্য রশিদ আহমাদ নামটি পছন্দ করেছেন। তার মতে,  ইসলাম অমুসলিম চিন্তাবিদদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। রশিদ আহমাদ বলেছেন,

"পাশ্চাত্যে উচ্চ শিক্ষিত সেইসব ব্যক্তিরাই মুসলমান হচ্ছেন যারা এ ধর্ম নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন। আর যারা একবার ইসলামকে বুঝতে পেরেছেন তাদের পক্ষে এ ধর্ম ত্যাগ করা এক অসম্ভব বিষয়। অনেক অমুসলিম মুসলমান হচ্ছেন, কারণ তারা জীবন-যাপনের সঠিক পদ্ধতি খুঁজতে  ইসলামকেই এ জন্য উপযুক্ত পথ হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন। ইসলামের মূল বিশ্বাসটি হল, এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) হচ্ছেন আল্লাহর রাসুল। এই সহজ-সরল মূলনীতিও মানুষকে আকৃষ্ট করে। এ বাণী আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় বদ্ধমূল হওয়ার পর তা মুখেও উচ্চারণ করেছি। ইসলাম আমাকে যেন শীতকালের অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে বসন্তে পৌঁছে দিয়েছে। ইসলাম আমার আত্মাকে দিয়েছে সজীবতা এবং এ ধর্মের সুন্দর শিক্ষাগুলো আমাকে করেছে পরিপাটি, আকর্ষণীয়।"  #

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/১৫