মে ২৩, ২০১৭ ১৬:৫৪ Asia/Dhaka

ব্যক্তি ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে যাতায়াত করে সে আল্লাহর বিশেষ রহমতের অধিকারী হয়। মহান আল্লাহ মসজিদে যাতায়াতকারী ব্যক্তিদের বরকতের অসিলায় পৃথিবীর বুকে তাঁর নেয়ামত ছড়িয়ে দেন। মহানবী (সা.) এ সম্পর্কে বলেছেন, যে ব্যক্তি মসজিদে যায় সে আল্লাহর ঘরের অতিথি এবং আল্লাহ তায়ালা পার্থিব ও ঐশী রিজিক দিয়ে তার আতিথেয়তা করেন।

মসজিদের এই বরকতপূর্ণ ফজিলতের কারণে ইসলামের সোনালী যুগে মুসলমানরা আল্লাহর ঘর নির্মাণে ব্যাপক মনোনিবেশ করেছিলেন। মহানবী (সা.)’র বাস্তবধর্মী দাওয়াতের বাণী তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছিল বলে দিকে দিকে মসজিদ নির্মাণের সাড়া পড়ে গিয়েছিল। আল্লাহর রাসূল মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতে করেই নিজের হাতে কুবা মসজিদ ও মসজিদে নববী নির্মাণ করেছিলেন। এরপর মদীনায় বিভিন্ন গোত্রের বসবাসের স্থানে আরো নয়টি মসজিদ নির্মিত হয়। বিশ্বনবী (সা.) নিজে গিয়ে এসব মসজিদের স্থান ও কিবলার দিক সঠিকভাবে নির্ধারণ করে দিতেন। মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ’র ইমামতিতে প্রথম জামাতটি অনুষ্ঠিত হতো।

রাসূলে খোদা (সা.) যেখানেই সফরে যেতেন সেখানেই নামাজ আদায় করার জন্য একটি স্থান নির্ধারণ করতেন। এভাবে তিনি মসজিদ নির্মাণের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেন। ধীরে ধীরে মুসলিম সমাজের পরিচিতির প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে মসজিদ। অমুসলিমরা ইসলাম গ্রহণের পরপরই প্রথম যে কাজটি করতেন তা হলো নিজ নিজ এলাকায় মসজিদ নির্মাণ করা। মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে ইবাদত-বন্দেগী করার পাশাপাশি আরেকটি লক্ষ্য অর্জিত হতো। আর তা হলো, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা। রাসূলুল্লাহ (সা.)’র যুগে একবার মুনাফিকরা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার স্থান হিসেবে মসজিদ নির্মাণ করে। বিশ্বনবী এটি বুঝতে পেরে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। তিনি ওই মসজিদে নামাজ আদায় তো করেনইনি, উল্টো মসজিদটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। পবিত্র কুরআনে এই মসজিদকে ‘মসজিদে যিরার’ বা ক্ষতি সাধানকারী মসজিদ নামে অভিহিত করা হয়েছে।

মহান আল্লাহ এই মসজিদ সম্পর্কে সূরা তওবার ১০৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন: “আর যারা জিদের বশে এবং কুফরীর তাড়নায় মসজিদ নির্মাণ করেছে মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এবং ঐ লোকের জন্য ঘাঁটি স্বরূপ যে পূর্ব থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে, আর তারা অবশ্যই শপথ করবে যে, আমরা কেবল কল্যাণই চেয়েছি। পক্ষান্তরে আল্লাহ সাক্ষী যে, তারা সবাই মিথ্যুক।”    

রাসূলের যুগে কিছু মুনাফিক ইসলামের পোশাক পরে মুসলমানদের ক্ষতি করতে চেয়েছিল। তারা মসজিদকে ইসলামের বিরুদ্ধে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে মুসলিম সমাজকে ভেতর থেকেই ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এ সময় বিশ্বনবী (সা.)’র বিপ্লবী ও সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে মসজিদে যিরার ধ্বংস করে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলার স্থান নির্ধারিত হয়। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র ও শত্রুতার ঘাঁটি ধ্বংস করে ফেলতে হবে সেটিকে যদি বাহ্যিকভাবে পবিত্র স্থান বলেও মনে হয়।

মসজিদে নববী

পাঠক, গত আসরের ধারাবাহিকতায় আসরের এ পর্যায়ে আমরা মসজিদে নববীর আরো কিছু অংশের সঙ্গে পরিচিত হব। আল্লাহর রাসূলের এই মসজিদের অনেকগুলো উস্তোয়ানা বা স্তম্ভ ১,৪০০ বছর পর আজও টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। এসব স্তম্ভের মধ্যে আটটি বেশি বিখ্যাত। বিশ্বনবীর জামানায়ই এগুলোর নামকরণ করা হয়েছিল। বর্তমানে এই আটটি স্তম্ভের ওপর সাদা রঙের প্রলেপ দিয়ে পরবর্তীতে নির্মিত পিলারগুলো থেকে এগুলোকে আলাদা করা হয়েছে।

মসজিদে নববীর এই ফজিলতপূর্ণ ও বিখ্যাত স্তম্ভগুলোর একটির নাম ‘উস্তোয়ানা তওবা’। আহযাবের যুদ্ধে আবুলুবাবা’র বিশ্বাসঘাতকতা ও তওবা করে তার ইসলামে প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে এই পিলারটির নামকরণ করা হয়েছে।  পঞ্চম হিজরিতে আহযাবের যুদ্ধের পর আবুলাবাবা মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে অনুতপ্ত হন। তার দেহমন পাপের অনুভূতিতে ছেয়ে যায়। এই পাপ থেকে মুক্তি পেতে বিশ্বনবী (সা.)’র কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ার পরিবর্তে তিনি সোজা মসজিদে নববীতে চলে যান। সেখানে গিয়ে একটি স্তম্ভের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে ফেলে সবাইকে বলে দেন, আল্লাহর রাসূল ছাড়া কেউ যেন তার  গায়ে বাধা দড়িগুলো খুলে না দেয়। তখন থেকে এই স্তম্ভটির নাম হয় ‘উস্তোয়ানা তওবা’। বিভিন্ন বর্ণনায় এই স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করার অফুরন্ত ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বনবী (সা.)’র  হুজরা ও কবরের পাশের দ্বিতীয় স্তম্ভটিই হলো ‘উস্তোয়ানা তওবা’।

মসজিদে নববীর আরেকটি স্তম্ভের নাম ‘উস্তোয়ানা মুখাল্লাকা’। বিশ্বনবী যে স্থানে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন তার সবচেয়ে কাছের স্তম্ভ এটি। বর্তমানে এই স্তম্ভের শীর্ষে সোনালি রং দিয়ে গোলাকৃতিতে লেখা রয়েছে ‘উস্তোয়ানাতুল মুহাল্লাকা’। এই স্তম্ভের কাছে একটি সুগন্ধী পোড়ানো হতো যার ফলে গোটা মসজিদ আতরের ঘ্রাণে ভরে উঠত।

মসজিদে নববীর প্রধান স্তম্ভগুলোর ঠিক মাঝখানে রয়েছে ‘উস্তোয়ানা আয়েশা’। এটি মুহাজিরান বা আল-কুর’আ’ স্তম্ভ নামেও সমধিক পরিচিত। বর্তমানে এই স্তম্ভের উপরে লেখা রয়েছে ‘উস্তোয়ানাতুন আয়েশা’।

মসজিদে নববীর আরেকটি স্তম্ভের নাম ‘উস্তোয়ানা তাহাজ্জুদ’। বর্ণনায় এসেছে, সবাই যখন এশার নামাজ আদায় করে যার যার বাড়িতে চলে যেত তখন আল্লাহর রাসূল এই স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। এ কারণে এটির নাম হয়েছে তাহাজ্জুদ স্তম্ভ। এই স্তম্ভটি নবী নন্দিনী হযরত ফাহেমা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘরের ঠিক পেছনে অবস্থিত। এখানে মরমর পাথরে খোদাই করে আরবিতে যে কথাটি লেখা আছে তার অর্থ হলো- “এটি বিশ্বনবী (সা.)’র তাহাজ্জুদের স্থান।”

রাসূলের পবিত্র মাজার কক্ষের উত্তর অংশের সঙ্গে লাগোয়া অবস্থায় রয়েছে ‘উস্তোয়ানা মুরাব্বাআ’ল কাব্‌র’। এটিকে মাকামে জিবরাইলও বলা হয়। বর্তমানে এই স্তম্ভটি বাইরে থেকে দেখা যায় না। এই স্তম্ভের ঠিক পেছনেই হযরত আলী (আ.) ও ফাতেমা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘরের প্রবেশ পথ ছিল। এই স্তম্ভের ফজিলত সম্পর্কে আবিল হামরা বলেছেন, আমি রাসূলে খোদাকে দেখেছি তিনি টানা ৪০ দিন ধরে প্রতিদিন আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসেইনের বাড়ির সামনে আসতেন এবং দরজার ওপর হাত রেখে বলতেন, “হে আহলে বাইত তোমাদের ওপর সালাম।” সেইসঙ্গে তিনি সূরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াত পাঠ করতেন যেখানে বলা হয়েছে, হে আহলে বাইত নিশ্চয় আল্লাহ চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।

মসজিদে নববীর তওবা স্তম্ভের ঠিক পূর্ব পাশে কিবলামুখী যে স্তম্ভটি রয়েছে তার নাম ‘উস্তোয়ানা সারীর’। রাসূলুল্লাহ (সা.) পবিত্র মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে নববীতে এতেকাফ করার সময় এই স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করতেন এবং ইবাদত করতে করতে ক্লান্তি আসলে এখানেই বিশ্রাম নিতেন।

উস্তোয়ানা সারীরের পাশেই রয়েছে ‘উস্তোয়ানা মাহ্‌রাস’। হযরত আলী (আ.) এই স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে বিশ্বনবী (সা.)কে পাহারা দিতেন।  এ কারণে এই স্তম্ভকে ‘উস্তোয়ানা আলী ইবনে আবি তালিব’ও বলা হয়।

মাহরাসের দক্ষিণ পাশে কিবলার দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা স্তম্ভটির নাম ‘উস্তোয়ানা ওফুদ’। মহানবী (সা.)’র দৈনন্দিন একটি কাজ ছিল মদীনার গোত্র প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তিনি এই স্তম্ভের পাশে বসে সেই সাক্ষাতের কাজটি সম্পন্ন করতেন। এটি পরবর্তীতে ‘উস্তোয়ানাতুল ওফুদ’ নামে পরিচিতি পায় যে নামটি আজও এই স্তম্ভের গায়ে লেখা রয়েছে।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/আশরাফুর রহমান/২৩

 

ট্যাগ