দেখবো ঘুরে ইরান এবার: রাশতের কিছু নিদর্শন
রাশত শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মাঝে ‘মির্যা কুচাক খান জাঙালি’র কবর খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। এই কবর স্থাপনাটি ‘সোলায়মান দারাব’নামক গোরস্তানে অবস্থিত। এই গোরস্তানটি এতো বিখ্যাত হবার কারণ হলো উপনিবেশবাদীদের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ইরানকে রক্ষা করার জন্যে স্বাধীনতাকামী জনতার আন্দোলন সংগ্রামের কথা স্মরণ করিয়ে এটি। স্থাপনাটির নকশা ও পরিকল্পনা ইসলামের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীর আদলে করা হয়েছে।
আটকোণাকৃতির জ্যামিতিক প্যাটার্নের যে ধারাটির প্রচলন ইরানী স্থাপত্যকলায় রয়েছে সেই ধারাটি এই গোরস্তানের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা যাবে। ‘মির্যা কুচাক খান জাঙালি’র কবরটির আয়তন চল্লিশ বর্গ মিটারের মতো আর এর উচ্চতা ৯ মিটার। যেসব সরঞ্জাম এতে ব্যবহার করা হয়েছে সেসবের মধ্যে রয়েছে ইট, সিরামিক, মৃৎ শিল্প এবং কাঠ। এগুলোর সবই স্থানীয়ভাবেই উৎপাদিত বলে মনে করা হয়।

কবরস্থানের পরিবেশটাও বেশ সুন্দর, পুরোণো গাছ গাছালি পরিবেষ্টিত সবুজ শ্যামল। এই সবুজ প্রকৃতি আর গাছ গাছালি দেখে স্মরণে পড়বে বীর সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব মির্যা কুচাক খান জাঙ্গালির স্বাধীন মন মানসিকতা ও চিন্তা চেতনার কথা। জঙ্গলের মতো পরিবেশ তাঁর স্বাধীনচেতা সত্ত্বার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মির্যা কুচাক খানের সমাধির ছাদ মৃৎশিল্পের কাজে পূর্ণ, তাতে সিংহের মাথাও ডিজাইন করে তিনটি সারিতে বিন্যস্ত হয়েছে। তবে স্থাপনাটির বাহ্যিক দিকটি সিরামিক আর ইটের সাহায্যে সুসজ্জিত করা হয়েছে। ভেতরের ছাদটিতে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ। আর দেয়ালের উপরের অংশে সুন্দর লিপিতে নকশা করা হয়েছে কুরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি। গিলানের ইতিহাসের পাতায় যদি আমরা নজর দেই তাহলে দেখতে পাবো, গিলান ইরানের একটি সবুজ শ্যামল উৎসাহ উদ্দীপনা আর জাঁকজমকপূর্ণ একটি প্রদেশ। যুগে যুগে এই গিলান ছিল স্বাধীনচেতা মনোবৃত্তি এবং সাহসিকতার অনন্য দৃষ্টান্তপূর্ণ একটি শহর।
যারাই এই গিলানকে নিয়ে গবেষণা করেছেন, সেই প্রাচীন আমলের গবেষক কিংবা ঐতিহাসিকদের বাইরেও ইসলামী যুগসহ ইসলাম পরবর্তী বিভিন্ন যুগে এমনকি আজ পর্যন্ত সকলেই অনুমোদন করেছেন যে, গিলানের জনগণ সবসময়ই ছিল সাহসী, নির্ভীক, মুক্ত ও স্বাধীন। তারা কখনোই বিদেশীদের হস্তক্ষেপের মুখে পরাজয় স্বীকার করে নি, মাথানত করে নি। এই সাহসী এবং বীরত্বপূর্ণ জনতার কাছে স্বাধীন গিলানের ঋণ কোনোদিন শোধ হবার নয়। না কেবল আঞ্চলিক ক্ষেত্রেই নয় বরং ইরানের স্বাধীনতাকামী বহু আন্দোলন সংগ্রামেও তাদের বীরত্বের কথা ইতিহাসে স্বীকৃত। ইরানের সাংবিধানিক বিপ্লবের ক্ষেত্রে গিলানের জনগণের অবদানের কথা অনস্বীকার্য। মরহুম আয়াতুল্লাহ মোদাররেসের নেতৃত্বে সংঘটিত ঐ বিপ্লবে গিলানবাসীরা যে ভূমিকা রেখেছিল তা ইতিহাসে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। মির্যা কুচাক খান ‘জঙ্গল আন্দোলন’ প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে এই বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন। অকুতোভয় এই বীরের জীবনী নিয়ে চলুন কিছু কথা বলা যাক।

মির্যা কুচাক খান জাঙ্গালি ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে রাশত শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটোবেলা থেকেই তিনি জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা দীক্ষায় উৎসাহী ছিলেন। এ কারণেই তিনি রাশতের সালেহাবাদ মাদ্রাসায় যান এবং তারপর তেহরানে যান ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনের জন্যে। মির্যা কুচাক খান ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, নম্র, বিনয়ী, সদাচারী, ধর্মীয় বিধি বিধানে বিশ্বাসী এবং চারিত্রিক নীতিমালার প্রতি অনুগত। তিনি সবসময় মজলুমদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতেন এবং ন্যায়নীতি সমর্থন করতেন। তাঁর কথাবার্তার ভঙ্গিও ছিল স্পষ্ট এবং মাধুর্যপূর্ণ। মির্যার মন মানসিকতাই ছিল সংগ্রামী। খ্রিষ্টিয় বিশ শতকের শুরুর দিকে ইরানে যে সাংবিধানিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেই আন্দোলনে তিনি মুজাহিদদের কাতারে গিয়ে যোগ দেন। মুজাহিদদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তুমুল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তেহরান এবং ক্বাজভিন বিজয়ে অংশ নিয়েছিলেন। মির্যা কুচাক খান সাংবিধানিক আন্দোলনের পর নিজের জন্মস্থান গিলানে ফিরে যান এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মধ্য দিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, ঐ পরিস্থিতিতে ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে নিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু রাশিয়া এবং বৃটেনের নেতারা সবাই একদিক থেকে ইরানে প্রবেশ করেছিল এবং আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক লুটতরাজ চালিয়েছিল। ভিনদেশী কমান্ডাররা শাসনকার্যসহ সকল ব্যাপারেই নাক গলাতে বা হস্তক্ষেপ করতে শুরু করলো। তারা জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে পায়ের তলায় পিষ্ট করেছে। এই সময় ইরানের সরকার বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সার্বিকভাবে পুরো ইরান এবং ইরানের জনগণ চরম দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সামাজিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়ে, সেইসাথে জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থাও নাজুক হতে হতে একেবারে ফকিরের পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এ কারণে সমগ্র দেশ জুড়ে জনগণের মাঝে এক ধরনের অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল।

মির্যা কুচাক খান তেহরান বাস করতেন। সে সময় তিনি আলেমদের সাথে পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, ভিনদেশীদের জুলুম অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হলে জুলুমের চাপ অনেক কমে যাবে এবং সমাজ সংস্কারের পথে উন্নয়ন ও অগ্রগতি আসবে। এই চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতেই মির্যাকে গিলানে পাঠানো হয় এবং তিনি সেখানে গিয়ে জঙ্গল আন্দোলনের সূচনা করেন। অন্যায়, জুলুম আর স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার লক্ষ্যে, নিজের দেশ থেকে বিদেশীদেরকে বের করে দেওয়অর লক্ষ্যে, তাদের হস্তক্ষেপের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার স্বার্থে এবং সবোর্পরি সামাজিক ন্যায ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্যে এভাবেই বহু নিবেদিত প্রাণকে পাওয়া গেল যারা পরস্পরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করতে প্রত্যয় ঘোষণা করেন। এভাবে যখন জঙ্গল বাহিনী আগ্রাসীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে হামলা করতে শুরু করলো বিদেশী বাহিনী ভয় পেয়ে গেল। রুশরা তখন সেই এলাকায় অর্থাৎ ইরানের উত্তরাঞ্চলেই ছিল। তারাও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। গিলানের প্রশাসনের কাছে তারা আবেদন জানালো যেন জঙ্গল বাহিনীকে প্রতিহত করা হয়, তাদের নির্মূল করার জন্যে যেন তাদের ওপর কঠোর চাপ সৃষ্টি করা হয়।
এমনকি তারা সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে জঙ্ঘল বাহিনীকে ধ্বংস করার চেষ্টাও চালায়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে জঙ্গল বাহিনীকে প্রতিহত করতে সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ব্রিটিশরা এবং কমিউনিস্ট রুশরা চেয়েছিল মির্যাকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করতে। কিন্তু পারে নি। অবশেষে রুশ ও ব্রিটিশদের ক্রীড়ণক রেজা খান পাহলভি নিজেই মির্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিদেশীদের ষড়যন্ত্রে নিজ দেশের শাসকের সেই হামলার এক পর্যায়ে ১৯২১ সালে মির্যা কুচাক খান শাহাদাত বরণ করেন।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/৩১/টি-৬০/ই-৬০