অক্টোবর ০২, ২০১৭ ২১:৩৬ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা?  তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো যে, বছর ঘুরে আমাদের মাঝে আবারো হাজির হয়েছে শোক ও ত্যাগের মাস মহররম। ‌এটি হিজরী সনের প্রথম মাস। এ মাসের ১০ তারিখে অর্থাৎ ৬১ হিজরীর পবিত্র আশুরার দিন ইরাকের কারবালার ময়দানে সংঘটিত হয়েছিল এক অসম যুদ্ধ।

ঐতিহাসিক এ যুদ্ধে রাসূল (সা.)-এর নাতি ইমাম হোসেইন (আ.) অবৈধ উমাইয়া শাসক ইয়াজিদের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হন। সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এ যুদ্ধে মাত্র ১৩ বছর বয়সী কিশোর কাসিম এবং দুধের শিশু আলী আসগরও শহীদ হন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-

কুল মাখলুক কাঁদিয়ে ওই এলো মহররম
হায় হোসেন! হায় হোসেন! উঠলো রে মাতম

সারা জাহান কেঁদে বিভোর আসমান-জমিন

দজলা কাঁদে ফোরাত কাঁদে কাঁদে মুসলিমিন....

কাতরা পানি পায়নি  হায়রে পিয়াসে কাতর

তির খেয়ে যে মরলো কচি শিশু সে আসগর।

বন্ধুরা, বেদনাবিধুর মহররম উপলক্ষে আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন  করেছি। এতে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব প্রবাসী দু'জন বন্ধু অংশ নিয়েছে।  

তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, ঐতিহাসিক কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ইমাম হোসেইন ও ইয়াজিদের মধ্যে। যুদ্ধের মূল ঘটনা বর্ণনার আগে আমরা এই দুই ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরছি।

ইমাম হোসেইন ছিলেন আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী ও উম্মুল মোমেনীন হযরত ফাতিমা (সা. আ.)'র পুত্র। রাসূল (সা.) ইমাম হোসেইনকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি বলতেন, 'হোসেইন আমা হতে আর আমি আমি হোসেইন হতে।' ইমাম হুসাইন (আ)'র জন্মের পর এই নবজাতক শিশু সম্পর্কে বিশ্বনবী বলেছিলেন, 'হে ফাতিমা! তাকে নাও। নিশ্চয়ই সে একজন ইমাম ও ইমামের সন্তান। সে নয়জন ইমামের পিতা। তারই বংশে জন্ম নেবে নৈতিক গুণ-সম্পন্ন ইমামবৃন্দ। তাঁদের নবমজন হবেন আল-কায়েম তথা মাহদি।' 

রাসূলেখোদা আরও বলেছেন, 'হুসাইন আমার সন্তান, আমার বংশ ও মানবজাতির মধ্যে তাঁর ভাই হাসানের পর শ্রেষ্ঠ। সে মুসলমানদের ইমাম, মুমিনদের অভিভাবক, জগতগুলোর রবের প্রতিনিধি বা খলিফা, ... সে আল্লাহর হুজ্জাত, বেহেশতের যুবকদের সর্দার এবং উম্মতের মুক্তির দরজা। তার আদেশ হল আমার আদেশ। তার আনুগত্য করা হল আমারই আনুগত্য করা। যে-ই তাকে অনুসরণ করে সে আমার সাথে যুক্ত হয় এবং যে তার অবাধ্য হয় সে আমার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না।'   

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, তাঁকে মহান আল্লাহ ওহির মাধ্যমে জানিয়েছেন যে, শাহাদতের মাধ্যমে হুসাইন (আ.) এমন এক মর্যাদা পাবেন যে তার কাছাকাছি যাওয়া অন্য কারো জন্য সম্ভব হবে না"। মহানবী আরো বলেছেন, নিশ্চয়ই প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ে হুসাইনের শাহাদতের ব্যাপারে এমন ভালোবাসা আছে যে, তার উত্তাপ কখনও প্রশমিত হবে না।"  

প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে, 'যখন আবু সুফিয়ানের পুত্র মুয়াবিয়া এবং মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ ইসলামকে ধ্বংস এবং এর নাম নিশানা মুছে দিতে চাইবে তখন ইমাম হোসেইনের মাধ্যমে ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হবে।'

বন্ধুরা, ইমাম হোসেইনের পর এবার আমরা কারবালা যুদ্ধের খলনায়ক, পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরছি।

ইয়াজিদ ছিল আমীর মুয়াবিয়ার পুত্র। সে ছিল মদ পানকারী, অত্যাচারী, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠনকারী ও ভোগবিলাসী একজন যুবক। মানব চরিত্রের এমন কোনো বদগুণ নেই যা ইয়াজিদের মধ্যে ছিল না। মুয়াবিয়া তার অযোগ্য পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী শাসক হিসেবে নিযুক্ত করলেও জনগণ তা মেনে নেয়নি। কারণ শয়তানি ও লম্পট আচরণের জন্য জনগণ তার প্রতি খুবই ক্ষুব্ধ ছিল।

যা হোক, জনগণের মতামতকে না মেনে পিতার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ মুসলিম জাহানের শাসক হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করে। কিন্তু সে জানতো যে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে ইমাম হোসেইনের বায়াত বা আনুগত্য জরুরি। তাই সে ক্ষমতায় বসেই মদীনার গভর্ণর অলিদ ইবনে ওতবাকে হুকুম দেয় যে, ইমাম হোসেইন যেন ইয়াজিদের শাসন মেনে নেয়। আর অস্বীকার করলে যেন তাঁকে হত্যা করা হয়।

মদীনার গভর্ণর যখন ইমামকে এ কথা জানাল তখন ইমাম বললেন, 'নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাব।’ তিনি গভর্ণরকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি আল্লাহর পরিবর্তে কখনো শয়তানের কাছে আত্মসমর্পন করবেন না।

ইমামের বলিষ্ঠ বক্তব্য শুনে ইয়াজিদ শক্তি প্রয়োগ করতে শুরু করল। এ অবস্থায় তিনি বাধ্য হয়ে মক্কায় চলে যান। কিন্তু মক্কাতেও ইয়াজিদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকল না। ইয়াজিদ কাবার পবিত্র প্রাচীরের মধ্যে গোপনে ইমামকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। এ সময় কুফা থেকে হাজার হাজার চিঠি আসে ইমামের কাছে। তারা ইমামকে কুফা যেতে আবেদন জানায় যেন তারা জালেম ইয়াজিদি শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারে। এ অবস্থায় কাবার পবিত্রতা রক্ষা এবং নিরাপত্তার খাতিরে ইমাম তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যাত্রা পথে তিনি কখনো ইঙ্গিতে আবার কখনো সরাসরি ঘোষণা দেন, “আমি কোনো ধন-সম্পদ, ক্ষমতার লোভ কিংবা কোনো গোলযোগ সৃষ্টির জন্য বিদ্রোহ করছি না। আমি শুধু আমার নানাজানের উম্মতের মধ্যে সংস্কার করতে চাই। আমি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করতে চাই এবং আমার নানাজান যে পথে চলেছেন আমিও সেই পথে চলতে চাই।" 

যাইহাক, ইমাম সঙ্গী সাথীদের নিয়ে যখন তিনি কারবালায় পৌঁছান তখন হুর ইবনে ইয়াজিদ ইবনে রিয়াহির নেতৃত্বে ইয়াজিদের একটি অগ্রবর্তী বাহিনী তাঁকে থামিয়ে দেয়। এরপর এই বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয় আরো হাজার হাজার সেনা।  

ইয়াজিদের বিশাল বাহিনী কারবালার মরুভূমিতে ইমামের সঙ্গী-সাথীদেরকে ঘেরাও করে রাখে। তারা অত্যন্ত অমানবিকভাবে ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেয়। ইমামের তাঁবুতে পানির অভাবে হাহাকার পড়ে যায়। এ সময় ইয়াজিদ ফরমান জারি করে জানায়- ‘হয় তাকে শাসক হিসেবে নেতৃত্ব মেনে নিতে হবে অথবা ইমাম হোসেইনকে মৃত্যুবরণ করতে হবে।’

কিন্তু ইমাম হোসেইন (আ.) ইয়াজিদের এই অন্যায় হুমকির তোয়াক্কা না করে হাতে যা ছিল তাই নিয়ে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিলেন। ১০ মহররম ভোর বেলায় ইয়াজিদের হাজার হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন ঈমানের বলে বলীয়ান এক ক্ষুদ্রবাহিনী। এ দৃশ্যটি বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশের কবি আসাদ বিন হাফিজ তাঁর 'কারবালা কাহিনী' কবিতায়।

কম বেশী সকলের জানা কাহিনী
মুখোমুখি দুই দল সেনাবাহিনী৷
একদল সত্যের পতাকাবাহী
আরেক দল দুনিয়ায় চায় বাদশাহী৷

সত্যের দলনেতা ইমাম হোসেন
বাদশাহী আশা বুকে এজিদ পোষেণ৷
নবীজির নাতি তিনি, পুত্র আলীর
ফাতেমার নয়নের মনি মহাবীর৷

ইমাম হোসেন নাম, হাসানের ভাই
তাঁর সাথে এজিদের বাঁধলো লড়াই৷
মুক্ত কৃপাণ হাতে দুই দল খাড়া
চারদিকে বেজে উঠে কাড়া নাকাড়া৷

শন শন তীর ছোটে এদিক-ওদিক
ঘোড়ার খুরের আওয়াজ বাজে চারদিক৷
ফোরাত নদীর কুল কারবালা মাঠ
মানুষের লাশ দিয়ে হ'ল তা ভরাট৷

এজিদের তাঁবু জুড়ে বাসা বাঁধে ভয়
অবশেষে থামে এই যুদ্ধ প্রলয়৷
লড়াই থামলে ইমাম তাকিয়ে দেখেন
সাথী হারা তিনি যেন একাকী আছেন৷

মনের দুঃখে ইমাম হয়ে অসহায়
নিজেকে লুটিয়ে দেন মরু বালুকায়৷
তখন সেখানে এক পাষন্ড সীমার
এসে নিজ হাতে কাটে ইমামের ঘাড়৷

ছিন্ন মস্তক গেঁথে বর্শার আগায়
নরপশু ছুটে চলে এজিদ সভায়৷
কম বেশী সকলের এই জানা কাহিনী
স্মরণে আস্লে ফেলে দু'চোখের পানি৷

হাজার বছর আগে মহররম মাসে
ঘটেছিল আজও তবু হৃদয়ে তা ভাসে৷

ইমাম হুসাইন (আ.) জালিম ইয়াজিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন যে, কোন শাসক ইসলামের নীতিমালা থেকে দূরে সরে গেলে কিংবা অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখল করলে তার বিরুদ্ধে নিজের সাধ্যনুযায়ী সংগ্রাম করতে হবে। ইমাম হুসাইন তাঁর নিজের, পরিবার পরিজনের এবং সঙ্গী সাথীদের জীবন উত্সর্গ করে ইসলামকে যেভাবে রক্ষা করে গেছেন,বিশ্বের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে হবে। তাহলে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী সাথীদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে।  

বন্ধুরা, এ মাসে  আমাদেরকে শপথ নিতে হবে অত্যাচারি, দুর্নীতিবাজ শাসকদের বিরুদ্ধে আমরা সাধ্যানুযায়ী সংগ্রাম করব এবং ইসলামের সত্যিকার আদর্শ মানুষের মধ্যে তুলে ধরতে আমরা কখনোই পিছপা হব না। মহান আল্লাহ আমাদেরকে এ শপথ মেনে চলার তৌফিক দিন এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২