ঐশী দিশারী (পর্ব-৪) : মক্কায় হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)'র জীবন
নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর মদীনায় হিজরতের আগে তিনি ১৩ বছর মক্কায় অবস্থান করেন। এ সময়ে তাঁর এবং সাহাবীদের জীবনে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। আজকের আসরে আমরা সংক্ষেপে সেসব ঘটনার কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাব।
মহান আল্লাহ যুগে যুগে যেসব নবী-রাসূল পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তারা মানবজাতিকে শান্তি ও সফলতার দিকে আহ্বান এবং বিশ্বকে সুন্দর ও নিরাপত্তাময় করে তোলার জন্য জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে চেষ্টা করে গেছেন।
মহাপ্লাবনের পর হযরত নূহ (আ.)-এর কিশতি জুদি পাহাড়ে নোঙর করে। এ সময় আল্লাহর নবী ও তাঁর মুষ্টিমেয় সাথীগণ পৃথিবীকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর ওফাতের অনেক বছর পর হযরত ইব্রাহিম (আ.) বাবেল অঞ্চলে আল্লাহর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে হযরত মূসা (আ.) তাঁর অলৌকিক লাঠির সাহায্যে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে নিজ জাতিকে রক্ষা করেন। তারপর হযরত ঈসা (আ.) পৃথিবীর বুকে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং মানবজাতিকে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সর্বশেষ নবী আসার সুসংবাদ দিয়ে যান; এবং অবশেষে বিশ্বের জাতিগুলো যখন বহু উপাস্যের পূজা করতে শুরু করে এবং অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও মূর্তিপূজায় গোটা পৃথিবী আচ্ছন্ন হয়ে যায় তখন সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মক্কায় আবির্ভূত হন। পবিত্র কুরআনে তাঁর বর্ণনা এসেছে এভাবে: “তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী,মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।”(সূরা তওবা আয়াত: ১২৮)।
নবুওয়াতপ্রান্তির পরবর্তী ১৩ বছরের মক্কা জীবনে আল্লাহর একত্ববাদ প্রচারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালান আল্লাহর রাসূল। তিনি তাঁর পরিবারের সব ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেন এবং দ্বীন প্রচারের প্রতিটি সুযোগ কাজে লাগান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পুরুষদের মধ্যে হযরত আলী (আ.) সবার আগে ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সময় আলী বয়সে ছিলেন একজন কিশোর মাত্র। রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলীর সামনে ইসলামের বাণী শোনানো মাত্র তিনি রাসূলের হাতে নিজের হাত সঁপে দিয়ে বলে ওঠেন: “আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহ।” শাহাদাতের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত হযরত আলী (আ.) কালেমায়ে শাহাদাতের এই বাণীর ওপর অটল ও অবিচল ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল, বিবি খাদিজা ও হযরত আলী- এই তিনজনকে নিয়ে মক্কায় প্রথম ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রথম অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সা.) আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই দ্বীন প্রচারের কৌশল গ্রহণ করেন। রাসূলের সিরাত বর্ণনাকারীগণ মক্কায় তাঁর ১৩ বছরের জীবনকে তিন বছর ও ১০ বছর এই দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। এর মধ্যে প্রথম তিন বছরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আল্লাহর রাসূল বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া ইসলামের বাণী প্রকাশ্যে বর্ণনা করেননি। এ সময়ে শুধুমাত্র যারা নিজে থেকে মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে তাঁর কাছে আসত তাদেরকেই তিনি ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় দিতেন। এসব নওমুসলিম মূর্তিপূজা করতে গিয়ে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। তারা আল্লাহর রাসূলের নবুওয়াতপ্রাপ্তির খবর শোনামাত্র তাঁর কাছে ছুটে যান এবং সানন্দচিত্তে ইসলাম গ্রহণ করেন।
তিন বছর পার হওয়ার পর রাসূলে খোদা প্রকাশ্যে ইসলামের বাণী প্রচার এবং শিরক বা বহুত্ববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার নির্দেশ পান। এ সময় মুসলমানের সংখ্যা ৪০ জন ছিল বলে জানা যায়। এদেরকে তাদের নিজ নিজ গোত্রের লোকদের কাছে ইসলামের বাণী প্রচারের দায়িত্ব দেয়া হয়। আল্লাহর রাসূল নিজে সবার আগে নিজ গোত্রের লোকদের একত্রিত করে তাদেরকে তাদের মূর্তিপূজার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। পবিত্র কুরআনে যেমনটি বলা হয়েছে: “আপনি নিকটতম আত্মীয়দেরকে সতর্ক করে দিন এবং আপনার অনুসারী মুমিনদের প্রতি সদয় হোন। যদি তারা আপনার অবাধ্যতা করে,তবে বলে দিন,তোমরা যা কর,তা থেকে আমি মুক্ত। আপনি ভরসা করুন পরাক্রমশালী,পরম দয়ালু আল্লাহর উপর। ” (সূরা শোয়ারা: আয়াত ২১৪-২১৮) এই আয়াত নাজিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরাইশ বংশের শীর্ষস্থানীয় ৪৫ ব্যক্তিকে নিজ গৃহে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে তিনি খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী তুলে ধরেন। এ সময় হযরত আলী (আ.) ছাড়া আর কেউ এই বাণী গ্রহণ করেনি।
সে যুগে মূর্তিপূজা ও শিরকে পরিপূর্ণ সমাজে তৌহিদের বাণী প্রচারের অর্থ ছিল প্রচলিত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা। এই কঠিন কাজটি করার পর একদল কাফের রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এসব শত্রুতা ও বিদ্বেষে সঙ্কিত না হয়ে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দেন। সূরা হিজরের ৯৪ ও ৯৫ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে: “অতএব আপনি প্রকাশ্যে শুনিয়ে দিন যা আপনাকে আদেশ করা হয় এবং মুশরিকদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন (অর্থাৎ তাদের ভয় পাবেন না)। আমি বিদ্রুপকারীদের অনিষ্ট থেকে আপনাকে রক্ষা করব।”
এভাবে রাসূলে খোদা (সা.) সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ্যে দ্বীনের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। সাফা পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চস্বরে মানুষকে মূর্তিপূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কুলু লা ইলাহা ইল্লাহ তুফলিহু অর্থাৎ বলো আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই তাহলেই সফলকাম হবে।
আল্লাহর রাসূল নিজের অবস্থানের কথা উল্লেখ করে সমবেত জনতার উদ্দেশে বলেন: “আমার অবস্থান হচ্ছে সেই প্রহরীর মতো যে অনেক দূর থেকে শত্রুকে আসতে দেখে নিজের জাতির লোকদের রক্ষা করার জন্য তাদের দিকে ছুটে যায়। হে কুরাইশের লোকসকল! তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেদের রক্ষা করো।” এ সময় রাসূলের চাচা ও অন্যতম কাফের সর্দার আবু লাহাব তাঁর বক্তব্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য হৈ চৈ শুরু করে। সে চিৎকার চেচামেচি করে লোকজনকে তাড়িয়ে দেয়। এভাবে নিকটাত্মীয়সহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ উপেক্ষা করে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান আল্লাহর রাসূল (সা.)।
প্রতিদিনই রিসালাতের দায়িত্ব পালন তাঁর জন্য কঠিন ও জটিল হয়ে ওঠে। কুরাইশের কাফেররা ইসলামের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়ার জন্য নানারকম শত্রুতা ও ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করেন মোহাম্মাদি ইসলাম অতি দ্রুত গোটা আরব উপত্যকাসহ সারাবিশ্বের বেশিরভাগ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ুক।
রিসালাতের দায়িত্ব পাওয়ার পর সাত বছর পরের ঘটনা। কুরাইশের মুশরিকরা আল্লাহর রাসূলকে বিদ্রূপ করার জন্য তাকে পাগল ও যাদুকর বলে আখ্যায়িত করে। এমনকি নও মুসলিমদের উৎসাহ উদ্দীপনা থামিয়ে দেয়ার জন্য তারা রাসূলুল্লাহর মাথায় খড়কুটা ও নাড়িভুড়ি নিক্ষেপ করে। কিন্তু চরম ধৈর্যের আধার বিশ্বনবী (সা.) আল্লাহর নির্দেশ পালনের লক্ষ্যে এসব বিদ্রূপ, কষ্ট ও অপমান সহ্য করেন। কাফেরদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নও মুসলিমদের একটি দল হাবাশায় হিজরত করতে বাধ্য হন। মুসলমানরা যতদিন আফ্রিকার দেশ হাবাশায় অবস্থান করেন ততদিন সেদেশের বাদশাহ তাদেরকে নিরাপত্তা দেন এবং তারা সেখানে শান্তিতে বসবাস করেন। হাবাশায় হিজরতকারী মুসলিম দলটি ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার মাধ্যমে সেখানকার বাদশাহকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলেন। এ কারণে মক্কার কাফেরদের পক্ষ থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে যাওয়া প্রতিনিধিদলকে খালি হাতে ফেরত পাঠান হাবাশার বাদশাহ।
এদিকে মক্কাসহ গোটা আরব উপত্যকায় ইসলামের সুমধুর বাণী ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে মুশরিকেদের চরম অত্যাচার ও দমনপীড়নের নীতি ব্যর্থ হয়ে যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ওহীর উৎস থেকে ইসলাম নামক যে ঝর্নাধারা প্রবাহিত হয় তা সত্য অনুসন্ধানী প্রতিটি পীপাসার্ত ব্যক্তির পীপাসা মিটিয়ে দেয়।
ঠিক এ সময়ে মুসলমানদের একঘরে করে তাদের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কুরাইশ অধিপতিরা। তারা একটি অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করে সেটিকে বাঁধাই করে কাবাঘরে ঝুলিয়ে রাখে। ওই অঙ্গীকারনামায় বলা হয়, মুসলমানদের সঙ্গে কেউ যেন কোনো ধরনের লেনদেন বা পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন না করে। এর ফলে আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাঁরা মক্কা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী একটি উপত্যকায় আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে এই উপত্যকাটির নাম দেয়া হয় শোয়াবে আবি তালেব।
ওই উপত্যকায় মুসলমানদের জীবন আরো করুণ হয়ে পড়ে। এমন অনেক দিন গেছে যেদিন একজন মুসলমান সারাদিন একটিমাত্র খেজুর খেয়ে বেঁচে থেকেছেন। ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্নার রোল শোয়াবে আবি তালেবের আশপাশের মানুষের কাছে সহনীয় হয়ে উঠেছিল। আল্লাহর রাসূল (সা.) ওই কঠিন পরিস্থিতিতে অদ্ভুত ধীরস্থীর ও শান্তভাবে মুসলমানদেরকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান। বহুবার তিনি নিজের জন্য বরাদ্দকৃত খাবার অন্যকে দিয়ে নিজে উপোস থেকেছেন। শোয়াবে আবি তালেবে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র সবচেয়ে বেদনাদায়ক স্মৃতি ছিল সহধর্মিনী ও কঠিন দিনের সবচেয়ে আপনজন বিবি খাদিজা সালামুল্লাহি আলাইহার মৃত্যু। বিবি খাদিজার মৃত্যুর কিছুদিন পর রাসূলের চাচা এবং তার অন্যতম প্রধান আশ্রয়স্থল আবু তালেবও ইন্তেকাল করেন। এই দুই ব্যক্তিত্বের ইন্তেকালের কারণে রিসালাতের দশম বছরকে ‘আম্মুল হাজেন’ বা ‘দুঃখের বছর’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
মুসলমানরা শোয়াবে আবি তালেবে টানা তিন বছর অর্থনৈতিক অবরোধের মধ্যে অতিবাহিত করেন। এরইমধ্যে অবরোধ শেষ হলে তারা নিজেদের ঘরবাড়িতে ফিরে যান। কিন্তু তখনো কাফেরদের অত্যাচার ও দমনপীড়ন আগের মতো অব্যাহত থাকে। কাফেররা এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। আল্লাহ সে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিশ্বনবীকে অবহিত করলে তিনি মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। মদীনায় শুরু হয় ইসলামের নতুন অগ্রযাত্রা। ইসলামের ইতিহাসে মহানবীর হিজরতকে একটি মহা ক্রান্তিকাল হিসেবে অভিহিত করা হয়। কারণ, মদীনায় হিজরতের পর দ্রুত গতিতে ইসলামের সমৃদ্ধি ও প্রসার ঘটে এবং ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ১৩