জানুয়ারি ০২, ২০১২ ২০:৩০ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসিরবিষয়ক অনুষ্ঠান 'কুরআনের আলো'র আজকের পর্বে সূরা আল-বাকারাহ'র ৩১ থেকে ৩৩ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৩১ ও ৩২ আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন:

وَعَلَّمَ آَدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (31) قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ (32)

"আল্লাহ তা'লা আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।" (২:৩১) 

"তারা বলল, আপনি মহান পবিত্র, আপনি আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছেন তাছাড়া আমাদের তো কোন জ্ঞানই নেই, নিশ্চয়ই আপনি জ্ঞানময়, প্রজ্ঞাবান।" (২:৩২)

মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের কাছে মানুষের মর্যাদা তুলে ধরার জন্য উভয় দলকেই পরীক্ষা করেন। মানুষ ও ফেরেশতা উভয়কেই তিনি জ্ঞান শিক্ষা দেন এবং পরে এ সম্পর্কে তাদের প্রশ্ন করেন। তবে এই জ্ঞান কী ধরনের ছিল সে সম্পর্কে কোরআন কিছু বলেনি। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, মহান আল্লাহ সৃষ্টির শুরুতেই এ বিশ্বজগত ও প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দিয়েছেন এবং এগুলোর নামের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আর এটাই হচ্ছে মানুষের সহজাত জ্ঞান, যার মাধ্যমে মানুষ যে কোন বস্তুকে চিনতে পারে। ফেরেশতারা যেহেতু ভেবেছিল ইবাদতের কারণে তারা মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ তাই মহান আল্লাহ প্রথমে তাদেরকেই পরীক্ষা করেন এবং বলেন, যদি তোমরা নিজেদের দাবী সম্পর্কে নিশ্চিত হও তাহলে আমি তোমাদেরকে যেসব বিষয় শিক্ষা দিয়েছি সেগুলো এবার বল। ফেরেশতাদের ভুল ভাঙ্গে এবং তারা বুঝতে পারে কেবল ইবাদতই আল্লাহর প্রতিনিধি হবার জন্য যথেষ্ট নয় বরং এর জন্য উন্নত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। কাজেই আল্লাহর প্রশ্নের জবাবে তারা বললো- আপনি পরম পবিত্র, নিশ্চয়ই মানব জাতিকে পৃথিবীতে আপনার প্রতিনিধি হিসাবে নির্ধারণ করার পেছনে বিশেষ কোন যুক্তি বা বৃহৎ স্বার্থ রয়েছে। আর এ কারণেই আপনি আদমকে সৃষ্টি করেছেন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার বাইরে কোন কিছুই আমরা জানি না। মানুষের বিশেষ ক্ষমতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ ছিলাম। হে মহান প্রতিপালক! আপনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী এবং প্রতিটি কাজ যুক্তি ও জ্ঞানের আলোকে সম্পন্ন করেন।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-

এক. মহান স্রষ্টাই হলেন মানব জাতির প্রথম শিক্ষক। কেননা তিনিই মানুষকে সত্য উপলব্ধির ক্ষমতা ও যোগ্যতা দিয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষের জন্য মানুষ এ ঐশী প্রেরণার কাছে ঋণী।

দুই. মানুষ এ বিশ্বজগতের সকল রহস্য উদ্ঘাটন করার ক্ষমতা রাখে, যদিও এ ব্যাপারে এখনও সে তেমন অগ্রসর হতে পারেনি।

তিন. ফেরেশতা সহ অন্যান্য সকল সৃষ্টির ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার জ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তা শক্তির কারণে।

চার. ঐশী প্রতিনিধি হবার জন্য ইবাদতের চেয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বেশী প্রয়োজন। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তার জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেকের কথা উল্লেখ করেছেন।

পাঁচ. অনুশোচনা বা ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মানুষ মুক্তি পেতে পারে। ফেরেশতারা ভেবেছিল ইবাদতের কারণে তারা মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করার পরপরই তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং মহান আল্লাহও তাদের ক্ষমা করে দিলেন। কিন্তু শয়তান আগুন থেকে সৃষ্টি হবার কারণে নিজেকে মাটির তৈরী মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে। এ ব্যাপারে গোঁড়ামী ও একগুঁয়েমির কারণে শয়তান মহান আল্লাহর দরবার থেকে বহিষ্কৃত হয়।

এরপর ৩৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَ يَا آَدَمُ أَنْبِئْهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ فَلَمَّا أَنْبَأَهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُلْ لَكُمْ إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنْتُمْ تَكْتُمُونَ (33

"আল্লাহ বললেন, হে আদম, ফেরেশতাদেরকে এসবের নাম বলে দাও। তারপর যখন তিনি সে সবের নাম বলে দিলেন,তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আসমান ও যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে আমি খুব ভাল করেই অবগত রয়েছি এবং সেসব বিষয়ও জানি যা তোমরা প্রকাশ কর, আর যা তোমরা গোপন কর! (২:৩৩)

আল্লাহর পরীক্ষায় আদম সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন এবং ঐশী শিক্ষার আলোকে সৃষ্টিজগতের সকল রহস্য ফেরেশতাদের কাছে বর্ণনা করলেন। ফলে ফেরেশতারা বুঝতে পারলেন যে, মহান আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান ও যোগ্যতা দিয়েছেন, আর তারা এ যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত। এ পরীক্ষা শেষ হবার পর, মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা ভেবেছিলে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব পাবার যোগ্য কেবল তোমরাই। তোমরা এ ধারণা মনের মধ্যে লালন করছিলে, কিন্তু কখনও তা প্রকাশ করনি। জেনে রাখো মহান আল্লাহ যেমনিভাবে তোমাদের প্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কে জানেন, তেমনি তোমাদের অন্তরের কথাও তিনি জানেন। সৃষ্টি জগতের সব কিছুই তারই আওতাধীন। মহান আল্লাহ মানুষ ও প্রতিটি বস্তুর প্রকাশ্য ও গোপন দিক সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত।

এ আয়াতে এ বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ যেহেতু বিশ্ব প্রকৃতির গূঢ় রহস্য সম্পর্কে অবহিত নয় এবং শুধু মাত্র বাহ্যিক দিকটিই দেখতে পায় কাজেই আল্লাহর সিদ্ধান্তে সে যেন অযথা বিচলিত না হয় এবং কোন বিরূপ মনোভাব পোষণ না করে। কেননা মহান আল্লাহ সীমাহীন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী এবং সে মোতাবেক তিনি প্রতিটি কাজ করেন। এ বিশ্ব জগতের কোথাও যদি মানুষের কাছে কোন কিছু অসামঞ্জস্য মনে হয়, তা মূলত মানুষের অজ্ঞতা প্রসূত। আল্লাহর কাজে কোন খুঁত নেই।

এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-

এক. মানুষ জ্ঞান ও শিক্ষার দিক থেকে ফেরেশতাদের উর্ধ্বে। মানুষের শেখার ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু ফেরেশতাদের এ বৈশিষ্ট্য নেই। ফলে আদম (আঃ) যে সব কথা বলতে পেরেছিলেন, ফেরেশতারা তা বলতে পারেননি।

দুই. যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণের জন্য পরীক্ষার প্রয়োজন। মহান আল্লাহ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও ফেরেশতাদের কাছে তা প্রমাণ করার জন্য পরীক্ষার আয়োজন করেছেন।

তিন. ফেরেশতারা অদৃশ্য জগত সম্পর্কে ঠিক ততটুকুই জানেন, মহান আল্লাহ তাদের যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছেন। কেননা আগের একটি আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-"আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।" আর এ আয়াতে বলেছেন-"আমি পৃথিবী ও আকাশের অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবগত আছি।#

 

ট্যাগ