দেখব ঘুরে ইরান এবার: তুর্কামান অধ্যুষিত গোলেস্তান
তুর্কামানরা তুরস্ক এবং মোঙ্গলীয়দের অন্যান্য গোত্রের সাথে কয়েক হাজার বছর আগে থেকেই সেন্ট্রাল এশিয়ায় বসবাস করতো। এই কবিলার লোকজনের জীবনযাপনের ভিত্তি ছিল আবহাওয়া। যেখানে আবহাওয়া বাস অনুকূল ছিল সেখানেই তারা চলে যেত। আর নির্বাহরে জন্যে তাদের মূল পেশা ছিল পশুপালন। সেজন্যে যেখানেই তারা যেত সেখানে পানি এবং ঘাস লতাপাতাময় চারণভূমি আছে কিনা তা দেখে নিত। এরকম স্থানান্তর বা যাযাবর জীবন যাপনের কারণে তুর্কামানের এই কবিলাদের নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান ছিল না।
শ্রম নির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল তারা, যদিও এরকম জীবন যাপন যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণটা হলো সবসময় তো আর একেবারে সবদিক থেকে উপযোগী,আবাদী কিংবা উর্বর এলাকা পাওয়া যেত না। কিন্তু বসবাস তো করতেই হতো। ফলে অনেক সময় দেখা যেত যে এলাকায় তারা আবাস গড়ে তুলেছে সে এলাকায় হয়তো খরায় ফসলহানী ঘটেছে কিংবা কোনো কারণে তাদের পশুগুলো মারা গেছে ইত্যাদি। এসব কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে তুর্কামান উপজাতীরা অনেক সময় আক্রমণাত্বক হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন এলাকায় তারা যে হামলা বা আক্রমণ চালিয়েছে এটাই তার মূল কারণ।
তুর্কি এবং মধ্য এশিয় মোঙ্গলদের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে সবসময়ই বিভিন্ন এলাকায় যাওয়ার প্রবণতা ছিল। তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চীন এবং ইরানে হিজরত করতো। এ কারণে লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হলো যে ইরানের সাথে তুরস্কের সাথে মোঙ্গলদের সাথে সবসময়ই মোটামুটি যোগাযোগ ছিল। অন্তত শক্তিশালী রাজবংশ সাসানী শাসনামল পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে এই যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। সাসানী শাসনামলের শেষের দিকে মধ্য এশিয়ার মোঙ্গল এবং তুর্কি উপজাতীয় গোত্রগুলো ধীরে ধীরে খোরাসানের উত্তরাঞ্চলের দিকে যেতে শুরু করে। সেখানে তারা তাদের পশুগুলোকে চারণভূমিতে চরিয়ে মোটামুটি উন্নয়ন ও অগ্রগতি লাভ করে। আস্তে আস্তে তারা গ্রামীণ জীবনযাপন এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে শহরেও বসবাস করতে শুরু করে।
শুধু তাই নয় যাযাবর জীবনের নির্মোহ চিন্তা থেকে শহুরে জীবনে আসার পর তাদের ভেতরে ইরানের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হবার কৌতূহলও জেগে ওঠে। ধীরে ধীরে তারা পরিচিতি লাভ করে। এমনকি সাম্রাজ্য বিস্তারের মতো রাজনৈতিক চিন্তা, দেশ শাসন করার মতো উচ্চাভিলাষও তাদের পেয়ে বসে। একসময় তাদের এই চিন্তা সফলও হয়। ইরানে যে গযনভি এবং সালজুকি সুলতানদের কথা শোনা যায়, তারা মূলত এই যাযাবর বেদুইনদেরই উত্তরাধিকার ছিল। শাসন ক্ষমতায় আসার আগে তারা পশুপালন করেই জীবিকা নির্বাহ করতো। হিজরি তৃতীয় শতকে তুর্কিরা বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে যায় এবং তাদেরই একটি শাখা পরবর্তীকালে তুর্কামান গোত্রের গোড়াপত্তন করে।
হিজরি সপ্তম অষ্টম শতকে তুর্কামান গোত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই থেকেই তুর্কামান গোত্রের ভিত্তিভূমি রচিত হয় এবং এ নামে একটি গোত্রের আবির্ভাব ঘটে। এই গোত্রের লোকজনের রুপকথার মতো বংশলতিকা রয়েছে। তাদের পূর্বপুরুষের নাম হলো ‘ওগুযখান’। তাঁর থেকে বংশ পরম্পরা ধীরে ধীরে বিভিন্ন দল উপদলে বিভক্ত হয়ে বহু গোষ্ঠি ও শাখায় পরিণত হয়েছে। এইসব শাখাও কালক্রমে বিভিন্ন উপশাখায় বিভক্ত হয়েছে। ইরানে যেসব তুর্কামান বসবাস করছে তাদের একটি অংশ কাস্পিয়ান সাগরের পূর্বদিক থেকে গোলেস্তান প্রদেশের মারা’ভে টিলা পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অপর একটি অংশ বাস করে খোরাসান প্রদেশের জারগালান এলাকায়।
সামগ্রিকভাবে ইরানে বসবাসকারী তুর্কামানদেরকে দুটি প্রধান উপজাজিতে বিভক্ত করা যায়। একটি হলো ইয়ামুত উপজাতি অপরটি হলো গোকলান উপজাতি। ইয়ামুতরা বাস করে কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী এলাকায় আর গোকলানরা বাস করে কালা’লে এবং গোলিদগ পার্বত্য উপত্যকায়। এরা যেহেতু সবার আগে এসব এলাকায় বাস করতে শুরু করেছে, সেজন্যে তারাই এ অঞ্চলে পশুপালন, কৃষিকাজ, বাগবাগিচার কাজ, মধু চাষ এবং সূর্যমুখির চাষবাসের পেশায় অগ্রগামী ভূমিকায় রয়েছে।
অবশ্য খোরাসান প্রদেশের জারগালন অঞ্চলেও দুটি গোত্রের বসবাস রয়েছে। একটি গোত্র হলো ‘তাক্কেহ’ অপরটি ‘নাখোর’।
যাই হোক, তুর্কামানরা তাদের তুর্কামানি ভাষাতেই কথা বলে। ভাষাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এই ভাষাটির গোড়ায় চীনা তুর্কিস্তানি অধিবাসীদের ভাষার মিল রয়েছে। এই ভাষার একটি শাখা হলো উগুযি। আজকের তুর্কামানি ভাষা এই উগুযি’রই বংশধর।
তুর্কামানের সামগ্রিক সাহিত্যকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো লিখিত সাহিত্য অপরটি মৌখিক বা অলিখিত সাহিত্য। লিখিত যে তুর্কামান সাহিত্য যা ইরানের পাশাপাশি তুর্কমেনিস্তানেও প্রচলিত আছে, সেই সাহিত্যের সূত্রপাত হয়েছে অন্তত পাঁচ শ বছর আগে থেকে। এই ধারার কজন নামকরা কবি সাহিত্যিক হলেন দৌলত মুহাম্মাদ আযাদি। তিনি হিজরি বারো শতকের কবি। মাখতুম কুলি ফারা’গি হলেন তুর্কামানের বিখ্যাত একজন কবি। কুরবান দারদি জালিলি অপর একজন বিখ্যাত কবি। তিনি অবশ্য তেরো শতকের ক্ল্যাসিক কবিদের অন্যতম। মামদুলি নামের অপর একজন বিখ্যাত তুর্কামানি কবিও রয়েছেন যিনি মুহাম্মাদ আলি নামেও পরিচিত। এঁদের বাইরেও তুর্কামান ভাষার আরো অনেক কবি সাহিত্যিক রয়েছেন।
অলিখিত বা মৌখিক যে সাহিত্যের কথা বলেছি সেটা ফোক বা লোকসাহিত্য হিসেবেই পরিচিত। তুর্কামানদের লোকসাহিত্যও বেশ সমৃদ্ধ। প্রতিবেশি অনেক দেশেরই সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর তুর্কামান লোকসাহিত্য প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। তুর্কামান লোকসাহিত্য বা মৌখিক সাহিত্য বহু শ্রেণী ও প্রকারের। তবে এগুলোর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো লোকগল্প, রূপকথা, প্রবাদ প্রবচন, সংগীত এবং শ্লোক বা ধাঁধাঁ। সর্বশেষ ধারাটি অর্থাৎ শ্লোক ও ধাঁধা তুর্কামান লোক সাহিত্যের খুবই জনপ্রিয় একটি শাখা। বিশেষ করে তাঁবুবাসী উপজাতীয় জনগোষ্ঠির সাথে এই ধাঁধাঁগুলোর খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। তারপরও বলতেই হবে তুর্কামান জনগণের লোক সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ শাখাটি হলো ছন্দ এবং কাব্যময় কথা যাকে আখ্যানকাব্যও বলা হয় এবং গান।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২২
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন