অক্টোবর ০৬, ২০১৮ ২১:৩৪ Asia/Dhaka

আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমাদের সাপ্তাহিক আলোচনা অনুষ্ঠান- ধরণীর বেহেশত মসজিদে। আজকের আসরে আমরা অমুসলিম দেশ চীনের মসজিদগুলোর সার্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব। আর দ্বিতীয় অংশে আছে সেদেশের দু’টি মসজিদ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।

মসজিদ শুধু নামাজ আদায় করার স্থান নয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এই মসজিদে বসে বিচার-আচার, বিরোধের মীমাংসা, সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা, যুদ্ধের পরিকল্পনা ও পরামর্শ, বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, জনসভা, অসুস্থ ব্যক্তি ও যুদ্ধাহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হতো।  বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র ওফাতের পরও বেশ কিছুকাল ধরে এই পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। সে সময় মুসলমানরা দ্বীন প্রচারের জন্য বিশ্বের যে প্রান্তেই গেছেন সেখানে সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনার মসজিদে নববীতে ইবাদত-বন্দেগি করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে দ্বীন শিক্ষা এবং তাদের নানা ধর্মীয় প্রশ্নের উত্তর দিতেন। কুরআনের তাফসিরসহ ইসলামের অন্যান্য জ্ঞান এবং দ্বীন শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা এই মসজিদ থেকে উৎসারিত হয়েছে।

শুক্রবার জুমার নামাজে মুসল্লিরা

ইসলামের প্রাথমিক যুগে আশপাশে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ ঘটনাবলী নিয়ে মসজিদে বসে আলোচনা হতো। যেকোনো নতুন ঘটনা বা মতবাদ সামনে এলে মুসলমানরা মসজিদে বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এ সম্পর্কিত অস্পষ্টতা দূর করার চেষ্টা করতেন। অন্যান্য ধর্মের জ্ঞানী ব্যক্তিদের সঙ্গে মুসলমানদের যুক্তি-তর্ক এই মসজিদেই অনুষ্ঠিত হতো। ইসলামে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একাকী জীবনযাপনের অনুমতি দেয়া হয়নি বরং ভারসাম্য বজায় রেখে সমাজের সবার সঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপন করতে বলা হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মসজিদ প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামায়াতের ব্যবস্থা করে মুসলমানদের মধ্যে সেই সামাজিক মেলামেশার চমৎকার সুযোগ করে দিয়েছে। একটি মসজিদে নামাজ আদায়ের জন্য যত মুসল্লি সমবেত হন তাদের সবার অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা সবাই ঐশী ধর্ম ইসলামে বিশ্বাসী। এই বিশ্বাস জাতীয়তা, দেশ, ভাষা, বর্ণসহ অন্যান্য ভেদাভেদ  মুছে দিয়ে তাদের সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে।

‘হুয়াশেং’ মসজিদ

আসরের এ পর্যায়ে অমুসলিম দেশ চীনের কয়েকটি মসজিদ নিয়ে আলোচনা করব।  চীনের ঐতিহাসিক স্থাপনা সম্পর্কে কথা উঠলে বেশিরভাগ মানুষের মনেই বিখ্যাত চীনের প্রাচীর এবং সেদেশের বড় বড় উপাসনালয়ের কথা ভেসে ওঠে। কিন্তু আপনাদের অনেকেই হয়তো শুনে অবাক হবেন চীনে বসবাস করেন পাঁচ কোটিরও বেশি মুসলমান এবং দেশটিতে অন্তত ৪৫ হাজার মসজিদ রয়েছে।  ঐতিহাসিক দলিলে এসেছে, হিজরি ৩১ সালে হিজাযের মুসলমানদের একটি প্রতিনিধিদল চীনের তৎকালীন শাসকের দরবারে যান এবং মানবতার ধর্ম ইসলামের বাণী তুলে ধরেন। চীনের শাসক ইসলাম সম্পর্কে অল্পবিস্তর জ্ঞানলাভ করে একথা অনুধাবন করেন যে, প্রাচীন চীনের প্রখ্যাত দার্শনিক ও চিন্তাবিদ কনফুসিয়াসের শিক্ষার সঙ্গে ইসলামের শিক্ষার মিল রয়েছে। তিনি তখন মুসলিম প্রতিনিধিদলের নেতা সা’দকে চীনে ইসলাম প্রচারের অনুমতি দেন। চীনের তৎকালীন শাসক একই সঙ্গে তার দেশের ‘চাঙ্গান’ শহরে প্রথম মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেন। চাঙ্গান বা শিয়ান বিশ্বের প্রাচীনতম রাজধানী শহর হিসেবে খ্যাত। এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের ৮০ বছর পর মক্কা থেকে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দেশ চীনে প্রথম মসজিদ নির্মিত হয়।

শি ওয়ান শহর

এখানে বলে রাখা ভালো চীনে যাওয়া প্রতিনিধিদলটির নেতা সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ছিলেন বলে ঐতিহাসিক বর্ণনায় পাওয়া যায়। এ কারণে চীনের ‘কানতুন’ শহরে তার নামে একটি মসজিদ নির্মিত হয় যার বর্তমান নাম ‘রওজা আবি ওয়াক্কাস’। এই মসজিদের পাশে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের কবর রয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু এই বর্ণনাটির সত্য হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস ৫৫ বছর বয়সে মদীনার কাছাকাছি আকিক অঞ্চলে নিজের প্রাসাদে মৃত্যুবরণ করেন এবং বাকি’ কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। কাজেই, যে বিষয়টি সত্য হতে পারে তা হলো, চীনে যাওয়া মুসলিম প্রতিনিধিদলের নেতা ছিলেন অন্য কোনো সা’দ। কিন্তু পরবর্তীতে ইতিহাস লেখার সময় সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের সঙ্গে তার নাম গুলিয়ে ফেলা হয়।

সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের মাজার

বিগত চৌদ্দশ’ বছর ধরে চীনের মসজিদগুলো নির্মিত হয়েছে যুগের নির্মাণশৈলির সঙ্গে মিল রেখে। যেসব মসজিদ বেশি পুরনো সেগুলো নির্মিত হয়েছে কাঠ দিয়ে। এসব মসজিদে ইসলামি প্রতীকগুলোর পাশাপাশি ড্রাগন এবং কচ্ছপের মতো চীনা প্রতীকও দেখতে পাওয়া যায়। চীনের মুসলিম স্থাপত্যবিদরা প্রথমদিকে যেসব মসজিদ নির্মাণ করেছেন সেগুলোতে বৌদ্ধ ধর্মের নির্মাণশৈলী ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা পুরোপুরি ইসলামি স্থাপত্যশৈলী প্রয়োগ করে মসজিদ নির্মাণ করেন। চীনের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো নির্মাণে প্রতিসাম্য রীতি ব্যবহার করা হয় যার প্রয়োগ সে যুগে নির্মিত মসজিদেও করতে দেখা যায়।

চীনের গুয়াংজু শহরে অবস্থিত ‘হুয়াশেং’ মসজিদটি অন্তত এক হাজার ৩০০ বছর আগে নির্মিত হয়েছে। যদি ঐতিহাসিক দলিল সত্য হয়ে থাকে তাহলে এটি শুধু চীনের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ নয় বরং সারাবিশ্বেও এত পুরনো মসজিদ খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে। চীনা ভাষায় হুয়াশেং শব্দের অর্থ ‘পবিত্রতাকে স্মরণ করুন’। এ কারণে এই মসজিদকে ‘স্মরণী মসজিদ’ও বলা হয়। এ ছাড়া, মসজিদটি ‘নুর টাওয়ার মসজিদ’ নামেও সমধিক পরিচিত। কারণ, অতীতে এই মসজিদের সুউচ্চ মিনারে স্থাপিত ফানুস দিয়ে পার্শ্ববর্তী ‘ঝুজিয়াং’ নদীতে চলাচলকারী নৌযানকে দিকনির্দেশনা দেয়া হতো। নৌযানের নাবিকেরা এই মসজিদের মিনারে স্থাপিত ফানুস দেখলে বুঝতে পারতেন যে, তারা সিল্ক রোডে পৌঁছে গেছেন। হুয়াশেং মসজিদের এই মিনার নির্মিত হয়েছিল মূলত আজান দেয়ার জন্য। এ ছাড়া, অতীতে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার জন্যও আবহাওয়াবিদরা এই মিনার ব্যবহার করতেন। এই মসজিদ এ পর্যন্ত বহুবার পুনর্নিমাণ করা হলেও সুউচ্চ মিনারটিতে এখন পর্যন্ত হাত দেয়া হয়নি।

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে রয়েছে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে নির্মিত ‘নিউজি মসজিদ’। চীনা রাজবংশ ‘চীং’-এর রাজা ‘কাং শি’র শাসনামলে ৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদ স্থাপিত হয়। বর্তমানে প্রতিদিন অন্তত ২০০ মুসল্লি এই মসজিদে জামায়াতে নামাজ আদায় করেন। শুক্রবার জুমার নামাজে মুসল্লির সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। বেইজিংয়ে যতগুলো মসজিদ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে এই মসজিদ সবচেয়ে পুরনো ও সুন্দর। চীনের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতিতে নিউজি মসজিদ নির্মিত হয়েছে যার বাইরের অংশে রয়েছে কাঠের অপরূপ প্রলেপ।

 

দুঃখজনকভাবে চীনে পাঁচ কোটি মুসলমান বসবাস করা সত্ত্বেও বর্তমানে তারা সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র চাপের মুখে রয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে রমজান মাসে রোজা রাখা নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে।  দেশটির মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়াং প্রদেশে সরকারি কর্মচারীদের পাশাপাশি ছাত্র ও শিক্ষকদের রোজা রাখা নিষিদ্ধ। তাদেরকে রমজান মাসে দিনের বেলায় পানাহার করতে বাধ্য করা হয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ৬

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ