ইসলাম ও শিশু অধিকার (পর্ব-৯): মাতৃগর্ভে ভ্রূণ হত্যা এবং ভ্রূণের অধিকার
গত কয়েকটি আসরে আমরা বলেছি, ইসলাম ধর্মে শিশুকে এতোটাই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, নারী ও পুরুষ উভয়কে বিয়ের আগেই অনাগত সন্তানের ভালো-মন্দ দিক বিবেচনায় নিয়ে জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সৎ, চরিত্রবান ও যোগ্য জীবনসঙ্গী নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরও কিছু দিকনির্দেশনার কথা আমরা বলেছি। যেমন মদ পান করেন এমন নারী ও পুরুষকে বিয়ে না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ইসলাম ধর্মে। শিশুর গুরুত্ব তুলে ধরার ধারাবাহিকতায় আজ আমরা জন্মের আগে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের অধিকার এবং ভ্রূণ হত্যা ও গর্ভপাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করব।

পবিত্র ইসলাম ধর্ম জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেমন অনাগত সন্তানের ভালো-মন্দ দিক বিবেচনায় নেয়ার কথা বলেছে ঠিক তেমনি বিয়ের পর গর্ভে আসা সন্তানের পৃথিবীতে নিরাপদ আগমন নিশ্চিত করার কথা বলেছে। ইসলাম ধর্মে মাতৃগর্ভে থাকা ভ্রূণও অধিকারপ্রাপ্ত হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা মুমিনিনের ১৩ ও ১৪ নম্বর আয়াতে ভ্রূণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, "অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক নিরাপদ আধারে স্থাপন করি। পরে আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংস পিণ্ডে পরিণত করি এবং মাংস পিণ্ডকে অস্থি-পঞ্জরে, অতঃপর অস্থি-পঞ্জরকে মাংস দ্বারা ঢেকে দেই। অবশেষে আমি তাকে চরম সৃষ্টিতে পরিণত করি, অতএব আল্লাহ মহান, যিনিই মহান সৃষ্টিকর্তা।"
পবিত্র কুরআনে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের অস্তিত্ব লাভ থেকে বিকাশ পর্যন্ত ছয়টি পর্যায়ের কথা বলা হয়েছে। ভ্রূণে প্রাণের অস্তিত্বের বিষয়টি কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভ্রূণকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য করে ইসলাম। এ কারণে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের যথাযথ পরিপুষ্টির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মনে রাখতে হবে ভ্রূণের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তাও বাড়ে। তাই গর্ভবতী মায়ের জন্য সুষম খাদ্য ও পুষ্টিকর বাড়তি খাবারের দরকার। ভ্রূণকেতো আর সরাসরি খাবার দেওয়া যায় না, তাই মায়ের খাবারের ওপরই নির্ভর করে ভ্রূণের পরিপুষ্টির বিষয়টি। এ জন্য সুস্থ ও সবল শিশু পেতে হলে গর্ভাবস্থায় মাকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্য খেতে দিতে হবে। পবিত্র কুরআনের সূরা আল-বাকারার ২৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘সন্তানের বাবার দায়িত্ব হলো মায়ের খাওয়া-পরার উত্তম ব্যবস্থা করা।’ ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, সন্তান হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার। এই বক্তব্যের মাধ্যমেও শিশুর গুরুত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু অনেকেই এই উপহারের মর্যাদা রক্ষা করতে সক্ষম নয়।
দুঃখজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অনেক বাবা-মা ভ্রূণ হত্যা করছে। সন্তান গর্ভে আসার পর নানা অজুহাত তুলে বিভিন্ন উপায়ে ভ্রূণ হত্যা করছেন তারা। অনেকেই অর্থনৈতিক সমস্যার কথা বলে, আবার কেউ কেউ সন্তানকে সঠিকভাবে বড় করতে পারবে না এই অজুহাত দেখিয়ে গর্ভের সন্তানকে মেরে ফেলছেন। আল্লাহতায়ালা সূরা আনআমের ১৩৭ নম্বর আয়াতে বলছেন,আর এভাবে অনেক মুশরিকের জন্য তাদের শরীকরা তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করা শোভিত করেছে, যাতে তাদেরকে ধ্বংস করতে পারে এবং তাদের নিকট তাদের দীনকে সংশয়পূর্ণ করতে পারে। আর আল্লাহ যদি চাইতেন,তারা তা করত না। সুতরাং তারা যে মিথ্যা বানায়,তা নিয়ে তুমি তাদেরকে থাকতে দাও।
ইসলাম ধর্মসহ কোনো ধর্মেই ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষ হত্যা গ্রহণযোগ্য নয়। মানুষ হত্যা মহাপাপ। ভ্রূণ হত্যাও মানুষ হত্যার শামিল। গর্ভবতী মায়েরও অধিকার নেই তার গর্ভের ভ্রূণকে নষ্ট করা। কারণ গর্ভে জীবনের অস্তিত্ব আসার পর তা পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য হয়।
সূরা মুমতাহানার ১২ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা ঈমানদার নারীদের আনুগত্য গ্রহণ করার ক্ষেত্রে যেসব শর্তারোপের কথা বলেছেন, তার মধ্যে একটি হলো সন্তানদের হত্যা না করা। এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন,
হে নবী,ঈমানদার নারীরা যখন আপনার কাছে এসে আনুগত্যের শপথ করে যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না, চুরি করবে না,ব্যভিচার করবে না,তাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না,জারজ সন্তানকে স্বামীর ঔরস থেকে আপন গর্ভজাত সন্তান বলে মিথ্যা দাবি করবে না এবং ভাল কাজে আপনার অবাধ্যতা করবে না,তখন তাদের আনুগত্য গ্রহণ করুন এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কারণ আল্লাহ ক্ষমাশীল অত্যন্ত দয়ালু। |
|

পবিত্র ইসলাম ধর্মে শিশু হত্যাকে সরাসরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলেও অনেকেই এই নিষেধাজ্ঞা মানছেন না। অনেকেই এটা উপলব্ধি করতে পারেন না যে, গর্ভে থাকা ভ্রূণ একটি পরিপূর্ণ মানুষের অধিকারপ্রাপ্ত। ভ্রূণের ক্ষতি করার অধিকার কারো নেই। পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, কেউ যদি মনে করেন আগত শিশুকে লালনপালন করা তার পক্ষে হয়ত সম্ভব হবে না এবং সেই ভয়ে ভ্রূণকে মেরে ফেলেন,তাহলে সেটি মহাপাপ বলে বিবেচিত হবে৷ সুরা ইসরার ৩২ আয়াত বলা হয়েছে,‘‘তোমরা তোমাদের সন্তানকে দারিদ্রতার ভয়ে হত্যা করো না। আমরা তোমাকে এবং তোমার সন্তানকে দেখেশুনে রাখি৷ তাই তাদের হত্যা করা সত্যিকার অর্থেই একটি মহাপাপ৷’’
ইসলাম ধর্ম স্পষ্টভাবে বলছে, ভ্রূণের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর সেটাকে ধ্বংস করা হারাম। আহলে বাইতের ইমামরাও বিভিন্ন সময় ইচ্ছাকৃত গর্ভপাতকে হত্যা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আসলে প্রতিটি মানুষের সবচেয়ে মৌলিক অধিকার হচ্ছে বেঁচে থাকার অধিকার। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদেও এ অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্ম যেখানে ভ্রূণের কোনো ধরণের ক্ষতিসাধনের অনুমতি দেয় নি সেখানে জন্মের পর শিশু নির্যাতন বা হত্যাকে প্রশ্রয় দেওয়ারতো প্রশ্নই আসে না। সর্বোপরি জন্মের আগে হোক আর পরে হোক, শিশুর গুরুত্ব অপরিসীম। শিশু অধিকার রক্ষার দায়িত্ব প্রতিটি মানুষের। মনে রাখতে হবে আমরা বড়রাও এক সময় শিশু ছিলাম।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৮
খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন