সুরা দাহির বা ইনসানের প্রাথমিক পরিচিতি ও ব্যাখ্যা
সুরা হাল আতা বা সুরা দাহ্র তথা সুরা ইনসান পবিত্র কুরআনের ৭৬ তম সুরা। অবশ্য আদি ধারাক্রম অনুযায়ী এটি ছিল পবিত্র কুরআনের ৯৮ তম সুরা। মদিনায় নাজিল হওয়া এ সুরায় রয়েছে ৩১ আয়াত।
এ সুরা হযরত আলী (আ.),হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) এবং ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের প্রশংসায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এতে মানুষের উদাসীনতা,কাফির ও মুমিনের অবস্থা,বেহেশতের সুখ্যাতি ও ইবাদাতের আদর্শ হিসেবে মহানবীর আহলে বাইতের প্রশংসাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা রয়েছে।
মানুষ সৃষ্টির উৎস, তার ইচ্ছার স্বাধীনতা ও সুপথ এবং খোদায়ী সুপথ-প্রাপ্তির পথে বাধাদানকারীদের জন্য নানা শাস্তির ব্যবস্থা ও সৎকর্মশীলদের পুরস্কার সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে এ সুরায়। পবিত্র কুরআনের গুরুত্ব ও এর বিধি-বিধান বাস্তবায়নের পথ এবং আত্ম-সংশোধন সম্পর্কেও বক্তব্য রয়েছে সুরা ইনসানে। এ সুরার প্রথম দিকেই মানুষ বা ইনসান সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে বলে সুরাটির নাম হয়েছে ইনসান।
মানুষের সৃষ্টির সুচনা ও তার উৎপত্তির উৎস সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে সুরা ইনসানে। এসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি মানুষের চিন্তা-ভাবনাকে করে খোদামুখী এবং কিয়ামত বা বিচার-দিবস সম্পর্কে করে সচেতন। এ সুরার দ্বিতীয় বাক্যে মহান আল্লাহ বলছেন:
(২) নিশ্চয়ই আমরা মানুষকে মিশ্রিত শুক্র-বিন্দু হতে সৃষ্টি করেছি,তাকে পরীক্ষা করার জন্য; অতঃপর আমরা তাকে শ্রবণ ও দৃষ্টি-শক্তিসম্পন্ন করেছি।

পবিত্র কুরআনের নানা আয়াতে মানব-সৃষ্টি ও তার উৎস সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে। এইসব বক্তব্য পবিত্র কুরআনের অলৌকিকতার নিদর্শন। মহান আল্লাহ মানুষকে প্রথমে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। এরপর তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে বীর্য বা শুক্র থেকে। এই বীর্য পরিণত হয় জমাটবদ্ধ রক্তে। এক সময় এ রক্ত পরিণত হয় গোশতে। এরপর দেয়া হয় হাড়ের কাঠামো ও হাড় ঢেকে দেয়া হয় গোশত দিয়ে। অবশেষে রুহ ফুঁকে দেয়ার পর জন্ম নেয় মানুষ। মানুষ সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া বেশ জটিল ও সূক্ষ্ম। আর মানুষ সৃষ্টির নানা পর্যায় থেকে বোঝা যায় যে মহান আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতা কত ব্যাপক।
এরপর সুরা ইনসানে এসেছে মানুষের পরীক্ষা ও দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গ। এসব বিষয় সচেতনতা ছাড়া সম্ভব নয়। এ জন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন: অতঃপর আমরা তাকে শ্রবণ ও দৃষ্টি-শক্তিসম্পন্ন করেছি।
সুরা ইনসান বা সুরা দাহ্রের তৃতীয় বাক্যে মানুষের হেদায়াত বা সুপথ সম্পর্কে বক্তব্য এসেছে।
মহান আল্লাহ বলছেন:
আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সে হয় কৃতজ্ঞ,না হয় অকৃতজ্ঞ হবে। -অর্থাৎ মানুষকে পথ বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে বলে সে হয় সুপথ বেছে নিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে অথবা অকৃতজ্ঞ ও আল্লাহর বিধি-বিধানের বিষয়ে বিদ্রোহী হয়ে এর পরিণতি ভোগ করবে।
শিয়া ও সুন্নি সূত্রের নানা বইয়ে সুরা ইনসানের শানে নুজুল বা এ সুরা নাজিল হওয়ার পটভূমি সম্পর্কে বলা হয়েছে:
হযরত ইবনে আব্বাস হতে বর্ণিত,একবার হযরত ইমাম হাসান (আ) ও তাঁর ভাই হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) অসুস্থ হলে মহানবী (সা.) হযরত আলীকে বলেন, ‘তোমার সন্তানদের আরোগ্যের জন্য মানত করলে ভাল হত।’ এ কথা শুনে হযরত আলী, ফাতিমা ও তাঁদের দাসী ফিয্যা তিনটি করে রোযার মানত করেন। এরপর তাঁরা সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁরা সবাই মানত পুরো করার জন্য রোযা রাখলেন। সে সময় ঘরে কোন খাদ্যদ্রব্য না থাকায় হযরত আলী শামউন নামের এক ইহুদীর কাছ থেকে তিন সা’ পরিমাণ যব ঋণ গ্রহণ করেন। হযরত ফাতিমা এক সা’ যব পিষে পাঁচটি রুটি তৈরি করেন। কিন্তু ইফতারের সময় এক ভিক্ষুক অনাহারের কথা জানালে তাঁরা নিজেদের রুটিগুলো তাকে দিয়ে দিলেন এবং সবাই কেবল পানি পান করে দ্বিতীয় দিনের রোযা রাখলেন। এদিনও হযরত ফাতিমা যাহরা এক সা’ যব পিষে পাঁচটি রুটি প্রস্তুত করলেন। কিন্তু আগের দিনের মত এদিনও এক পিতৃহীন খাদ্য প্রার্থনা করলে তাঁরা একইভাবে তাঁদের রুটিগুলো তাকে দান করলেন ও পানি পান করে শুয়ে পড়লেন।
এরপর তাঁরা তৃতীয় দিনের রোযা রাখলেন। এদিনও হযরত ফাতিমা অবশিষ্ট যব পিষে রুটি তৈরি করলেন। কিন্তু ইফতারের সময় এক বন্দি এসে খাবার চাইলে তাঁরা যথারীতি তাঁদের রুটিগুলো তাকে খাওয়ালেন এবং নিজেরা শুধু পানি পান করে শয়ন করলেন। চতুর্থ দিন সকালে হযরত আলী (আ.) ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের হাত ধরে মহানবী (সা.)-এর কাছে আসলেন। তখন তাঁরা ক্ষুধায় কাঁপছিলেন। তাঁদের এ অবস্থা দেখে তিনি খুব কষ্ট পেলেন এবং তাঁদের সঙ্গে নিয়ে হযরত ফাতিমার কাছে আসলেন। সে সময় তিনি তাঁর ঘরে ইবাদাতে রত ছিলেন এবং তাঁর পেট যেন পিঠের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করলেন হাসান ও হুসাইন অতি দুর্বল হয়ে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থা দেখে তিনি আল্লাহর উদ্দেশ্যে বললেন,‘হে আল্লাহ,এরা আমার আহলে বাইত যারা ক্ষুধার তাড়নায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে। তাই তুমি তাদের রহম কর। হে আমার প্রতিপালক,এরা আমার আহলে বাইত এদের তুমি ক্ষমা কর,রক্ষা কর এবং কখনও পরিত্যাগ কর না।’
এ অবস্থায় জিব্রাইল ফেরেশতা অবতরণ করে বললেন,‘হে মুহাম্মাদ! আল্লাহ আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং তাদের ব্যাপারে আপনার দোয়া কবুল করেছেন। তিনি তাদের গুণগ্রাহী ও তাঁদের প্রতি পূর্ণ সন্তুষ্টি ব্যক্ত করেছেন।’ এরপর জীব্রাইল আলোচ্য সূরার আয়াতগুলি তিলাওয়াত করলেন। (শাওয়াহেদুত তানযিল,২য় খ-, পৃ. ৩৯৭)। রেওয়ায়েতটি তাফসীরে বায়দাবী প্রভৃতিতেও উল্লেখ রয়েছে। #
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।