যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্যে দুর্ভোগ!: সুরা মুতাফফিফিন
সুরা মুতাফফিফিন পবিত্র কুরআনের ৮৩ তম সুরা। মক্কি এ সুরায় রয়েছে ৩৬ আয়াত।
এ সুরার ৫টি প্রধান আলোচ্য বিষয় হল ওজনে বা মাপে কম দেয়ার পাপসহ নানা পাপ ও পুনরুত্থান বা বিচার দিবসের প্রতি দৃঢ় ঈমান না থাকার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি, বিচার-দিবসে পাপাচারীদের পরিণতি, বেহেশতবাসীদের জন্য নানা সুখের কিছু উপকরণ এবং মুমিনদের প্রতি কাফেরদের মুর্খতাপূর্ণ পরিহাস ও বিচার-দিবসে তা বিপরীত হওয়া।
হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা) যখন মদিনায় প্রবেশ করেন সে সময় মদিনার জনগণের মধ্যে ওজনে বা মাপে কম দেয়ার পাপাচার ছিল ব্যাপক মাত্রায় প্রচলিত। এ অবস্থায় সুরা মুতাফফিফিনে এ সংক্রান্ত আয়াত নাজেল হয়: যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্যে দুর্ভোগ!... । মদিনার জনগণও তা মেনে নেন এবং ওজনে বা মাপে কম দেয়ার কুপ্রথা বর্জন করেন। মহানবী (সা) ওই আয়াত তিলাওয়াত করে মদিনাবাসীকে বলেন, পাঁচটি কাজের পরিণতিতে ঘটে অন্য পাঁচ! তাঁকে প্রশ্ন করা হল: হে আল্লাহর রাসুল! কোন্ পাঁচের মোকাবেলায় কোন্ পাঁচ? মহানবী বললেন, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী প্রত্যেক জাতির ওপর শত্রুদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন মহান আল্লাহ; যেসব জাতি বা সমাজ আল্লাহর হুকুম বা বিধান অমান্য করে চলে তাদের মধ্যে দারিদ্র বেড়ে যায়; যেসব জাতি বা সমাজের মধ্যে ব্যাভিচার বেড়ে যায় তাদের মধ্যে মৃত্যু ও প্রাণহানি ব্যাপক হয়ে ওঠে; যারা ওজনে বা মাপে কম দেয় তাদের খাদ্য-শস্য ধ্বংস হয়ে যায় এবং তারা দুর্ভিক্ষের শিকার হয়; আর যারা যাকাত দেয় না তাদের অঞ্চলে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়।

সুরা মুতাফফিফিনের প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে: যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্যে দুর্ভোগ!- এ আয়াতের অর্থ অনেক ব্যাপক! এখানে রয়েছে মানুষের অধিকার লঙ্ঘনকারী এবং জালিম ও নির্যাতনকারীদের প্রতি মহান আল্লাহর কঠোর হুশিয়ারি! মহান আল্লাহ বলছেন, (দুর্ভোগ তাদের জন্য) যারা লোকের কাছ থেকে যখন মেপে নেয়, তখন পূর্ণ মাত্রায় নেয় এবং যখন লোকদেরকে মেপে দেয় কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।
অবশ্য মাপে কম দেয়া কেবল বিক্রেতা বা দোকানদারের জন্যই প্রযোজ্য নয়। চাকুরিজীবি ও শ্রমিকের জন্যও নির্দিষ্ট সময়ে যতটুকু কাজ করার জন্য চুক্তি রয়েছে সে সময়ে ততটুকু কাজ না করা বা সেই সময়ে ব্যক্তিগত কাজ করাও মাপে কম দেয়ার সমতুল্য। এমনকি আল্লাহর যে কোনো বিধান লঙ্ঘন করা এবং সামাজিক-সম্পর্ক, নৈতিক ও দাপ্তরিক ক্ষেত্রে যে কোনো অনিয়মকারীরাও মুতাফফিফিনের অন্তর্ভুক্ত।
ঠগবাজদের লক্ষ্য করে সুরা মুতাফফিফিনের চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, তারা কি চিন্তা করে না যে, তারা পুনরুত্থিত হবে সেই মহাদিবসে, যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব পালনকর্তার সামনে?
অর্থাৎ এখানে বলা হচ্ছে যে ঠগবাজরা যদি কিয়ামত বা বিচার-দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখত এবং সেদিনের কঠোর বিচারের কথা ভাবত তাহলে তারা করত না জুলুম ও লঙ্ঘন করত না মানুষের অধিকার।
পাপাচারীদের পরিণতির একাংশের কথা তুলে ধরে সুরা মুতাফফিফিনের সাত থেকে নয় নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন,
'কখনও এমন নয় যে তারা কিয়ামত সম্পর্কে ভাবে, নিশ্চয়ই পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জীনে আছে। আপনি জানেন, সিজ্জীন কি? এটা নির্ধারিত পরিণতির বিষয়ে লিপিবদ্ধ খাতা।'
একদিন হযরত আলী (আ) ও একদল মুমিন মক্কার একদল কাফেরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। কাফেররা আলী (আ) ও মুমিনদেরকে দেখে পরিহাস করল। মুমিনদের বেশিরভাগই দরিদ্র ও সাধারণ শ্রেণীর মানুষ ছিলেন। তাই কাফেররা এই মুমিনদের দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাত এবং তাদের ঈমানকে মূল্যহীন বলে মনে করত ও তাদের ধর্মকে তথা ইসলামকে উপহাস করত। কাফেররা মুমিনদের বলত, এরা পথভ্রষ্ট এবং নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় এই কাফেররা মুসলমানদের উপহাস করা নিয়ে আনন্দ প্রকাশ করত। আর এরই প্রেক্ষাপটে সুরা মুতাফফিফিনের ২৯ থেকে ৩৬ নম্বর আয়াত নাজেল হয়। এখানে বিচার-দিবসে মুমিনদের উপহাসকারী কাফেরদের পরিণতি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। আসলে বিচার-দিবস খোদায়ি ন্যায়-বিচার বাস্তবায়নের দিবস। তাই সেদিন আল্লাহর আদালতে মুমিনরা হাসবেন কাফেরদের পরিণতি দেখে। তারা বেহেশতের সুরম্য আসন বা পালংকে বসে কাফেরদের অশুভ পরিণতি লক্ষ্য করবেন।
পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী সব নবী-রাসুল ও তাদের অনুসারী সম্প্রদায় কাফেরদের উপহাসের শিকার হয়েছেন। উপহাস ও বিদ্রুপ বা কটাক্ষ করাটা ছিল নবী-রাসুলদের মোকাবেলায় তাদের অন্যতম যুদ্ধ-উপকরণ। উপহাস সাধারণত তারাই করে যারা যুক্তির ধার ধারে না এবং অহংকারে মদমত্ত হয়ে নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড় মনে করে ও অন্যদের অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে। আর তাই মুমিনদের মোকাবেলায় কাফেরদের পক্ষ থেকে এ ধরনের নোংরা অস্ত্র ব্যবহার করা খুবই স্বাভাবিক। আজও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা বাক-স্বাধীনতার নামে ইসলামের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অশালীন কার্টুন, ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক ছবি ও নানা ধরনের বিনোদন-মাধ্যমকে ব্যবহার করছে। আর সেই একই প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা সত্যের অনুসারীদের কোন্ঠাসা করতে চায়। অন্যদিকে মুমিনদের জন্য পবিত্র কুরআনের এই আয়াতগুলো ধৈর্য, প্রশান্তি ও অক্লান্ত সংগ্রাম ও প্রতিরোধ অব্যাহত রাখার এক মহা-অনুপ্রেরণার মাধ্যম।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ২১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।