ডিসেম্বর ১৫, ২০১৯ ১৯:০৯ Asia/Dhaka

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) তাকওয়া বা খোদাভীতি, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর হক আদায় করাসহ অন্যান্য নির্দেশ জারি করার পর বলেন, আমি যা কিছু বলেছি তার প্রতিটি নির্দেশ আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে।

ইমাম একথা বলার মাধ্যমে সবার সামনে এ সত্য তুলে ধরেন যে, সমাজে তাকওয়ার পরিবর্তে দুর্নীতি বাসা বেধেছে, সাধাসিধে জীবনযাপনের পরিবর্তে বিলাসিতা শুরু হয়েছে, ন্যায়বিচারের পরিবর্তে জুলুম বেড়েছে এবং সবচেয়ে অযোগ্য ব্যক্তি খলিফার পদ দখল করে বসেছে।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) তাঁর অন্য এক ভাষণে বলেন: “মহান আল্লাহ আমাদেরকে (অর্থাৎ ইমামদেরকে) সব ধরনের অপবিত্রতা থেকে দূরে রেখেছেন। যদি অন্য কেউ এই একই দাবি করে থাকে তাহলে সে মিথ্যা বলছে।” ইমামের এই বক্তব্য ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এখানে তিনি ইমামত, খেলাফত ও সমাজের নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতার বিবেচনায় ইমামদের অগ্রগামী থাকার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, আব্বাসীয় খলিফারা অবৈধভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। ইমাম সূরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতের একাংশ উদ্ধৃত করে নিজেদেরকে পবিত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন যেখানে মহান আল্লাহ বলছেন: “হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ! আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে।”

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) নিজে দ্বীন ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি বেশ কিছু যোগ্য ছাত্র তৈরি করে যান যারা ইমামের অবর্তমানে ইসলাম প্রচারের কাজ সঠিকভাবে পালন করেন। এরকম একজন প্রখ্যাত ছাত্রের নাম আহমাদ বিন ইসহাক আশআরি। বর্তমান ইরানের কোম নগরীর অধিবাসী এই আলেম সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন নানা প্রয়োজন ও প্রশ্ন ইমামের কাছে পৌঁছে দিতেন এবং ইমামের কাছ থেকে শুনে সেসব প্রশ্নের জবাব আবার প্রশ্নকারীদের জানাতেন।  আহমাদ ইবনে ইসহাক ইমাম আসকারির আগে ইমাম জাওয়াদ ও ইমাম হাদি আলাইহিমুস সালামেরও ছাত্র ছিলেন এবং এসব ইমামের অনেক বাণী প্রচার করেছেন।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.)’র আরেকজন ছাত্রের নাম আবুহাশেম দাউদ বিন আল-কাসেম আল-জাফরি। তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)’র চাচাতো ভাই ও সাহাবি জাফর তাইয়ার। ইমামের এই ছাত্র তাঁর আগে ইমাম জাওয়াদ ও ইমাম হাদি আলাইহিমুস সালামের ছাত্র ছিলেন। এ ছাড়া, ইমাম মাহদি (আ.)’র স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময় তিনি এই মহান ইমামের প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। আল-জাফরি চার চারজন ইমামের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে মূল্যবান জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সে জ্ঞান ছড়িয়ে দেয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

ইমাম আসকারি (আ.)’র আরেকজন ছাত্র যিনি তাঁর আগে ইমাম হাদি (আ.) এবং তাঁর পরে ইমাম মাহদি (আ.)’র স্বল্পকালীন অন্তর্ধানের সময় তাঁর প্রতিনিধি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন তার নাম আব্দুল্লাহ বিন জাফর হিমিয়ারি। তাঁর লেখা অনেকগুলো মূল্যবান বইকে এখনো শিয়া আলেমগণ রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে ব্যবহার করেন। তিনি ইমামদের সঙ্গে তাঁদের ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের বিনিময়কৃত গুরুত্বপূর্ণ চিঠি সংরক্ষণ করেন। এসব চিঠিতে ফিকাহশাস্ত্র সংক্রান্ত মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। ইমামত সম্পর্কে আদ-দালায়েল নামক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। আব্দুল্লাহ বিন জাফর ‘আল-গেইবাহ’ নামক গ্রন্থে ইমাম মাহদি (আ.)’র অন্তর্ধানের দর্শন ও তাৎপর্য সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন।

শেষ তিন ইমামের আরেকজন প্রখ্যাত ছাত্রের নাম আবু ওসমান বিন সাঈদ ওমরি। তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে ইমাম হাদি (আ.)’র শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ইমামদের সান্নিধ্যে থেকে কুরআন ও  হাদিস সম্পর্কে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এই ছাত্রের মাধ্যমে ইমাম হাদি, ইমাম আসকারি ও ইমাম মাহদি আলাইহিমুস সালাম সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। ইমাম হাদি ও ইমাম আসকারি তাঁদের অনুসারীদের এই বলে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তারা যেন ধর্মীয় যেকোনো প্রশ্ন ওসমান বিন সাঈদের কাছে পেশ করেন। এই দুই মহান ইমাম তার সম্পর্কে আরো বলেন: “ওসমান বিন সাঈদ আমাদের বিশ্বস্ত লোক। সে তোমাদেরকে যা কিছু বলে সেকথাকে আমাদের কথা বলে বিশ্বাস করবে ও মেনে  চলবে।”

এদিকে আব্বাসীয় খলিফারা ইমাম আসকারি (আ.)’র গতিবিধিকে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখে।  তাঁর পক্ষ থেকে বিপদ এড়ানোর জন্য মো’তামেদ আব্বাসি খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে ইমামকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এ ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে জনগণ খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে বলেও তার মনে আশঙ্কা কাজ করে। শেষ পর্যন্ত সে ষড়যন্ত্র সফল হয় এবং ইমাম খলিফার পক্ষ থেকে দেয়া বিষমেশানো খাবার খেয়ে শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর শাহাদাতের খবর প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামেরা শহরের হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রকাশ করে। এ অবস্থায় ইমামের শাহাদাতে রাজদরবারের হাত থাকার বিষয়টি যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য মো’তামেদ আব্বাসি তার সব পারিষদবর্গকে নিয়ে ইমামের জানাযায় শরিক হয়।

আব্বাসীয় এই দুর্নীতিবাজ শাসক ইমাম হাসান আসকারির জানাযার নামাজ আদায় করার জন্য ইমামেরই একজন ভাই যার নীতি-আদর্শে ইমামের অনুমোদন ছিল না তাকে নিয়োগ করে। এরকম একটি স্পর্শকাতর মুহূর্তে উপস্থিত লোকজনকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে ইমাম মাহদি (আ.) নিজের অযোগ্য চাচাকে সরিয়ে দিয়ে জানাযার নামাজের ইমামতি করেন। এরপর ইমাম হাসান আসকারির বাসভবনেই তাঁর দেহ সমাহিত করা হয়। দিনটি ছিল ২৬০ হিজরির ৮ রবিউল আউয়াল রোজ শুক্রবার।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ