জুন ০১, ২০২০ ১৭:০১ Asia/Dhaka

থমাস কার্লাইল ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক, দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে এক সম্মেলনে দেয়া ভাষণে তিনি দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে মহানবী (সা), মুসলিম জাতি ও ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের নানা দিক তুলে ধরেন।

সেদিন মহানবী সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, এই বীর বা মহানায়ককে তাঁর অনুসারীরা খোদা বা প্রভু বলে মনে করেন না। বরং তিনি ছিলেন তাদের কাছে এমন এক রাসুল বা ঐশী প্রেরিত-পুরুষ যিনি খোদায়ি প্রেরণা বা ওহি পেতেন।

থমাস কার্লাইল উনবিংশ শতকের রাজনৈতিক ও ধর্মীয়-চিন্তাধারা ও লেখালেখির জগতকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিলেন। ইতিহাসের বীর নায়ক ও মহাপুরুষদের সম্পর্কে ধারাবাহিক কয়েকটি ভাষণ দিয়ে তিনি এ বিষয়ে সংবাদপত্র-সাহিত্য ও সাধারণ জনগণের মধ্যে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তার ভাষণগুলো ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। ফলে ‘হিরোজ এন্ড হিরোজ ওরশিপ তথা বীরকুল ও বীরকুল-বন্দনা’ শীর্ষক তার ওই বক্তৃতামালার সংকলনটি বই আকারে বেশ কয়েকবার ছাপাতে হয়েছিল।

থমাস কার্লাইলের দৃষ্টিতে বীর বা নায়ক এমন এক মানব যার রয়েছে অন্তর্দৃষ্টি ও গোপন রহস্যকে দেখার ক্ষমতা। তিনি বস্তুগত ঘটনা বা বিষয়গুলোর ভেতরের দিক ও সত্ত্বাকে দেখতে পারেন এবং বাস্তবতাকে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেন। আর এভাবেই তিনি গড়ে তোলেন ইতিহাস। থমাস কার্লাইল তার দ্বিতীয় ভাষণ তথা ‘নবী হিসেবে বীর বা নায়ক, মুহাম্মাদ: ইসলাম’ শীর্ষক ভাষণে মুহাম্মাদ (সা)-কে ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, স্রস্টা পৃথিবীর মানুষের প্রতি সবচেয়ে মূল্যবান যে অনুগ্রহটি করেছেন তা হল মুহাম্মাদের মত প্রতিভা যিনি উর্ধ্ব জগত থেকে খোদায়ি বাণী নিয়ে আমাদের মধ্যে নাজিল হয়েছেন। ... তাঁকে যেসব নামে ডাকা হোক না কেন বিশ্বের কোনও সাম্রাজ্যের সম্রাটই তাঁর মুকুট ও সিংহাসন নিয়ে কখনও এমন আনুগত্য পায়নি যা পেয়েছেন মুহাম্মাদ যিনি নিজ হাতে তার সাধারণ আলখাল্লাটি সেলাই করেছেন! তিনি দীর্ঘ ২৩ বছরে (ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে) কঠিনতম নানা কষ্ট ও জীবনের পরীক্ষাগুলো সহ্য করেছেন এবং অনেক বঞ্চনা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। আমি তাঁর মধ্যে একজন সত্যিকারের নায়কের সব বৈশিষ্ট্য দেখতে পাচ্ছি। তাঁর পরিচয় হিসেবে এটাই যথেষ্ট!

থমাস কার্লাইল আরও লিখেছেন ... আমি তাঁর সমস্ত কল্যাণ ও মঙ্গল বা ভালো দিকগুলো যতটা সম্ভব ন্যায্যভাবে তুলে ধরতে চাই .... এই ব্যক্তিকে ঘিরে যেসব মিথ্যার পাহাড় বা স্তূপ গড়ে তোলা হয়েছে তার মাধ্যমে আমরা কেবল নিজেদেরকেই কুৎসিত ও কলঙ্কিত করেছি! -কার্লাইলের এই ভাষণে মহানবীর (সা) মাধ্যমে মক্কা বিজয়ের ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল কোনও যুদ্ধ ও রক্তপাত ছাড়াই। মক্কার মুশরিকদের প্রধান আবু সুফিয়ান আগের রাতে মহানবীর (সা) চাচা হযরত আব্বাসকে সঙ্গে নিয়ে খুব ধীরে ও গোপনে মুসলমানদের শিবির ঘুরে দেখে। সকালের দিকে সে দেখল মুসলিম জনগণ মহানবীকে এতই ভালবাসেন যে তারা প্রিয়নবীর ব্যবহৃত ওজুর পানি নেয়ার জন্য কাড়াকাড়ি করছেন এবং সেই পানি মাথা ও মুখে মাখছেন! এ দৃশ্য দেখে আবু সুফিয়ান হযরত আব্বাসকে বললেন: কি বিস্ময়! আমি ইরানের ও রোম সাম্রাজ্যের বাদশাহদের দেখেছি! কিন্তু তোমার ভাতিজা যে গৌরবের অধিকারী তাদের কারো মাঝেই আমি তা দেখিনি! তারা গায়ের জোরে ও মাথার ওপর বর্শা রেখে জনগণকে শাসন করত! কিন্তু এই মুহাম্মাদ মানুষের হৃদয়ে শাসন করছেন। তিনি মানুষের বিশ্বাস ও অনুরাগ এবং প্রেমের অধিকারী।

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ থমাস কার্লাইল মহানবীর (সা) প্রশংসা করে আরও লিখেছেন: প্রকৃতির সন্তান মুহাম্মাদের ছিল মুক্ত সামাজিক আত্মা, তিনি হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তিত্ব মহান লক্ষ্য অর্জনের সুদৃঢ় ইচ্ছা ছাড়া অন্য কোনও চিন্তা তাঁর ছিল না। তিনি ছিলেন এক নীরব মহান আত্মা এবং তিনি ছিলেন এমন মহান ব্যক্তিদের একজন যারা নিবেদিত-প্রাণ বা আন্তরিক না হয়ে পারেন না। যখন অন্যরা কুপ্রথা ও বিভ্রান্তিকর শ্লোগানের মধ্যে আবদ্ধ থেকে তৃপ্ত ছিল তখন তিনি নিজেকে এইসব শ্লোগানের পর্দার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারেননি। .... অস্তিত্বের মহারহস্য এবং এর সব প্রতাপ, ভীতি-বিহ্বলতা, ঔজ্জ্বল্য ও জ্যোতি  ছিল তাঁর কাছে স্পষ্ট ... এমন ব্যক্তির কথা হচ্ছে সরাসরি প্রকৃতির হৃদয় থেকে উঠে-আসা বক্তব্য তথা খোদায়ি বক্তব্য। মানুষের উচিত অন্য কিছু না শুনে এমন ব্যক্তির বক্তব্য অবশ্যই শোনা- কারণ, এমন বক্তব্যের তুলনায় অন্য সব বক্তব্যই হচ্ছে বাতাস বা হাওয়ার মত!

কার্লাইলের এইসব প্রবন্ধ ও বক্তব্যের পর মহান আল্লাহর শেষ নবী (সা) সম্পর্কে অনেক বাস্তবতা ও অনেক মিথ্যাচার স্পষ্ট হয়। এমনকি মহানবীর প্রতি অজ্ঞতাসুলভ আক্রমণের যে জোয়ার দেখা দিয়েছিল সেই যুগে তা কমে আসে।

মহানবী (সা) ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও উচ্চাভিলাষী ছিলেন বলে যেসব অপবাদ দেয়া হত তার জবাব দেয়ার চেষ্টা করেছেন থমাস কার্লাইল। তিনি বলেছেন, শত্রুরা যদি সত্যের দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ্য করে তাহলে দেখতে পাবে যে এই মহাপুরুষের লক্ষ্যগুলো ছিল উচ্চতর এবং দুনিয়ার লোভ-লালসা, পদ-পদবী ও বাদশাহি পাওয়ার ঊর্ধ্বে ছিল তাঁর চিন্তাধারা। ....  মহানবীর মত একজন ব্যক্তিকে ইন্দ্রিয় ভোগ-বিলাসী বলে অপবাদ দেয়া বা এটা বলা যে তাঁর মধ্যে ভোগের প্রবৃত্তি ছাড়া অন্য কোনও লক্ষ্য ছিল না- এ জাতীয় অপবাদ  কতই না অন্যায় ও জুলুম! মুশরিক ও বিরোধী আরবরাই তাঁকে পবিত্র ও সৎ এবং আমিন বা বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী বলে উল্লেখ করত। তিনি ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছর বয়স্ক একজন নারীকে বিয়ে করেছিলেন। যিনি ৫০ বছর বয়স পর্যন্তু এই বয়স্ক নারীকেই স্ত্রী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট থেকেছেন ও অন্য স্ত্রী গ্রহণ করেননি তাকে কিভাবে ইন্দ্রিয়পরায়ণ বলে অপবাদ দেয়া যায়?

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ০১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ