সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২০ ১৭:৪০ Asia/Dhaka

অনস্বীকার্য বাস্তবতা হচ্ছে, নতুন নতুন প্রযুক্তি মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্রমকে সহজতর করে। প্রযুক্তির সহযোগিতায় জীবনে আরও সুশৃঙ্খল করা সম্ভব। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রযুক্তিরই ভালো-মন্দ দু'টি দিকই রয়েছে।

ভার্চুয়াল জগত বা ইন্টারনেটও তেমনি একটি প্রযুক্তি যা সঠিকভাবে ব্যবহার করলে জীবন আরও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। আবার উল্টো ঘটনাও ঘটতে পারে যদি আমরা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন না হই। গত আসরে আমরা মানবজীবনে ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতের প্রভাব নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি।

ইন্টারনেট বিভিন্ন ক্ষেত্রের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ স্থাপনেও ব্যবহার হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে কোটি কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। গত আসরেও যেমনটি আমরা বলেছি, অনেকে ইন্টারনেটে সময় দিতে গিয়ে পরিবারকে সময় দেওয়ার কথা ভুলে যাচ্ছেন। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ড. আফশিন তাবাতাবায়ি এ সম্পর্কে বলেছেন, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা জরুরি। এর ফলে পারস্পরিক হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং এ ধরণের পরিবেশ যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।  কিন্তু অনেক পরিবারেই নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার সংস্কৃতি নেই, যে যার মতো চলছে ও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এর ফলে নানা সমস্যার জন্ম নিচ্ছে। এর ফলে যেকোনো সমস্যায় হতাশ হয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। হতাশার কারণে নানা ধ্বংসাত্মক পথও অনেকে বেছে নিচ্ছেন। পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা না থাকায় অনেকে ইন্টারনেটের প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন। একবার ইন্টারনেটের প্রতি আকর্ষন মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছালে পরিবারের প্রতি আগ্রহ ও দায়িত্ববোধ আরও কমতে থাকে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতা হ্রাসের সঙ্গে ইন্টারনেটের প্রতি আকর্ষণের পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে।

ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষনের পেছনে প্রধানত পাঁচটি কারণ কাজ করে। এক- যৌন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি ঝোকপ্রবণতা; দুই- ইন্টারনেটের মাধ্যমে নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রবল আগ্রহ; তিন- জুয়াসহ এ ধরনের নেশা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন খেলার প্রতি ঝোকপ্রবণতা; চার- নতুন নতুন তথ্য সংগ্রহের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ এবং সর্বশেষ কম্পিউটার গেইমের নেশা। ইন্টারনেটের প্রতি আসক্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সামাজিক তৎপরতা কমিয়ে দেয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের প্রতি তাদের আগ্রহ হ্রাস পায়। পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারে বাধা পেলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ইন্টারনেটের প্রতি নেশাগ্রস্তদের মধ্যে অনেকেই সাধারণত দিনে ছয় ঘন্টারও বেশি সময় কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল বা ট্যাবলেটের সামনে বসে সময় কাটায়, তাদের সমবয়সী বা বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মেশার তেমন কোন আগ্রহ তাদের মধ্যে থাকে না।

এ ধরনের ব্যক্তিরা মনে করেন, তাদের সামনে থাকা যন্ত্রটিই তাদের বড় বন্ধু। আসলে যখন মানুষের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার সবচেয়ে উপযুক্ত বয়স ঠিক সে বয়সেই যদি তারা দিনের এতটা সময় কম্পিউটার গেইম বা যৌন বিষয়ক ওয়েবসাইট নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায় তাহলে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া খুব কঠিন। তরুণদের মধ্যেই এ প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। আসলে তরুণরা  অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে বাস্তব জীবনে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। এ অবস্তায় এ ধরনের ছেলেমেয়েদের বাবা-মা এবং শিক্ষকদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ছেলেমেয়েদেরকে কেবল প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহ দিলেই চলবে না, পাশাপাশি সামাজিক হয়ে ওঠার দিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। অন্যথায় বাস্তব জীবনের অনেক সমস্যাই তারা আর সমাধান করতে পারবে না। ইন্টারনেট তথা ভাচুর্য়াল জগতের প্রতি অতিনির্ভরতার কারণে জীবনের প্রকৃত সাধ উপভোগ করাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

রাতে ঘুমানোর সময় এ ধরনের একটা ডিভাইস হাতে নিয়ে শুতে গিয়ে অনেকেই নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে ঘুমান। এ অভ্যাস আস্তে আস্তে ঘুম না আসার কারণে পরিণত হচ্ছে। অধিকাংশ শিশুই মোবাইলে গেম খেলে অথবা কার্টুন দেখে। বর্তমান সময়ে শিশুরা যে ভিডিও গেমস পছন্দ করে, তার অধিকাংশেরই উপজীব্য হচ্ছে হিংস্রতা, মারামারি ও যুদ্ধ। এ কারণে এসব বিষয় শিশু-কিশোরদের ওপর মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক প্রভাব ফেলে। চিকিৎসকদের ভাষ্য মতে, ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতের প্রতি আসক্তির কারণে একজন ব্যবহারকারী প্রথমেই মাথা ব্যথার মতো সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন। শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ অবস্থা বেশি দেখা যায়। মাথা ব্যথার পর চোখের সমস্যা দেখা দেয় এবং মেরুদণ্ডে সমস্যা হয়। ভার্চুয়াল জগতের নানা গেমস ও কার্টুনের প্রভাবে অনেক শিশুই সহিংসতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

গেমস খেলতে খেলতে শিশু-কিশোরদের মধ্যে শুধু জয়ের মাসনিকতা গড়ে উঠছে। পরাজয় মেনে নেয়া বা সইতে পারার মানসিকতা তাদের তৈরি হয় না। ফলে পরাজয় না সইতে পেরে তারা ব্যাপকভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে জীবনের সব কিছুর ওপর। এ ধরণের নানা কারণে ইন্টারনেটে আসক্ত শিশু-কিশোররা সামাজিকভাবে বিকশিত হয় না। তাদের মধ্যে এ ধারণা গড়ে উঠে যে, ইন্টারনেট ভিত্তিক গ্রুপগুলোই হলো সবচেয়ে আধুনিক চিন্তা-চেতনার অধিকারী। নিজে যে গ্রুপের সদস্য সেই গ্রুপের চিন্তা-চেতনার বাইরে অন্য কিছু সে ভাবতে পারে না। এ কারণে এক পর্যায়ে তার দৃষ্টিভঙ্গিও একপেশে হয়ে উঠে। ভার্চুয়াল জগতের বাইরে বাস্তব জগত তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। এভাবে এক পর্যায়ে সে নিজেকে স্বেচ্ছায় একঘরে করে ফেলে। এ ধরণের প্রবণতার কারণে অধিকাংশ শিশু আত্মকেন্দ্রীক হয়ে বেড়ে ওঠছে।

ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি শিশুদের সামাজিক দক্ষতাও নষ্ট করছে। শিশু-কিশোররা সব সময় ইন্টারনেট নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে সেখানে নানা বিনোদন খুঁজতে থাকে। কিন্তু এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে অবাধ যৌনাচারের প্রতি ঝোক বাড়ছে যা পারিবারিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সুন্দর ও সফল  জীবনযাপনের জন্য সব মানুষেরই কিছু যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন জরুরি। বর্তমানে ইন্টারনেট বা ভার্চুয়াল জগতকে কীভাবে, কোন কাজে ব্যবহার করলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে না, তা জানা জরুরি। প্রয়োজনে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া উচিৎ। এই জগতের নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেকে দূরে রেখে সেটাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা যদি জানা না থাকে তাহলে ভয়াবহ সংকটের আশঙ্কা দেখা দেয়।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ