সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২০ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

মহানবীর (সা) আবির্ভাব ছিল অজ্ঞতা, কুসংস্কার, নৈতিক অবক্ষয় ও চরম পথভ্রষ্টতার গভীর অন্ধকারে ডুবে যাওয়া মানব সমাজে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিবেক ও যুক্তি-ভিত্তিক ধর্মের প্রবক্তার আবির্ভাব। মুক্তিকামী মানুষ তাঁর কথাবার্তা ও আচার আচরণ দেখে সহজেই তাঁর অনুরাগী হয়ে পড়ত।

মহানবীর আবির্ভাব ছিল যেন ঘন অন্ধকার রাতে সূর্যের আবির্ভাবের মত। পবিত্র কুরআনের সুরা জুমআ’র দ্বিতীয় আয়াতে এই মহান রাসুল সম্পর্কে বলা হয়েছে:
তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও হিকমাত। ইতিপূর্বে তারা ছিল ঘোর পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।

বিগত পর্বগুলোর আলোচনায় আমরা জেনেছি পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবী মহল ইসলামের সূচনা পর্ব থেকেই শত শত বছর ধরে ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে বিদ্বেষী নানা প্রচারণা এবং মিথ্যা অভিযোগে প্রভাবিত হয়েছিল। মধ্যযুগের পর থেকে তাদের কেউ কেউ গবেষণার মাধ্যমে বা আরবি ভাষা শিখে ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস ও মহানবীর প্রকৃত জীবনী সম্পর্কে তথ্য পেতে থাকেন এবং এর ফলে তারা এ বিষয়ে অনেকেই ন্যায়বিচার-ভিত্তিক ও নিরপেক্ষ বক্তব্য রাখতে থাকেন। এই ধারা ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও এনলাইটেনমেন্ট বা বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্ত জ্ঞান চর্চার যুগে জোরালো হতে থাকে। ফলে ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার, জার্মান মহাকবি গ্যাটে, ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী গিবন, রুশ কবি পুশকিন ও ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ কার্লাইলের মত পশ্চিমা মনীষীরা মহানবী (সা) ও ইসলাম সম্পর্কে গভীর প্রশংসাসূচক ও জোরালো ইতিবাচক বক্তব্য রেখেছেন। এইসব পশ্চিমা মনীষী বা প্রাচ্যবিদরা হলেন খ্রিষ্টিয় সপ্তদশ শতক থেকে উনবিংশ শতকের। 
 বিংশ শতকে এসে ইসলাম ও মহানবী সম্পর্কে বিজ্ঞান-সম্মত উপায়ে সঠিক তথ্য পাওয়া আরও সহজ হওয়ায় এ বিষয়ে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের গবেষণার মাত্রা ও গতি বেড়ে যায়। বিশেষ করে এ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তা বেশ বেগবান হয়। পশ্চিমা পণ্ডিতদের অনেকেই মহানবীর (সা) খোদায়ি ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম হিসেবে ইসলাম সম্পর্কে গবেষণায় মনোযোগী হন।
 কিন্তু এই শতকেও ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণা ও ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। আসলে ইসলাম বিদ্বেষ বিভিন্ন যুগে ভিন্ন ভিন্ন রূপে, মাত্রায় ও আঙ্গিকে অব্যাহত থেকেছে। ইসলামের সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির মোকাবেলায় বিংশ শতকে পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন জোরদারর নগ্নতম দৃষ্টান্ত হল মহানবী (সা) ও ইসলাম সম্পর্কে অবমাননাকর বই ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ বা শয়তানের পদাবলী নামক বই। মহানবী (সা) ও ইসলাম সম্পর্কে অবাস্তব নানা মন্তব্য ও তথ্যে ঠাসা রয়েছে মুর্তাদ লেখক সালমান রুশদির এ বইটি। 

অন্যদিকে বিংশ শতকে যেসব পশ্চিমা মনীষী ইসলামী প্রাচ্যের অনুরাগী ছিলেন তাদের মধ্যে  আধুনিক রুশ লেখক ও কবি ইভান অ্যালেক্সিভিচ বুনিন অন্যতম। তিনিই প্রথম রুশ লেখক যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। প্রাচ্য ও ইসলাম এবং এর সংস্কৃতির প্রতি তার এত বেশি আগ্রহ ছিল যে তিনি এ বিষয়ে ভালোভাবে জানতে আরব বিশ্বের বহু দেশ সফর করেন। ১৯৩৩ সনে নোবেল পুরস্কার-পাওয়া ইভান বুনিন মিশর, ফিলিস্তিন, জর্দান, সিরিয়া, লেবানন ও আলজেরিয়াসহ আরও অনেক মুসলিম দেশ সফর করেছিলেন। পবিত্র কুরআন, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার পর তিনি বেশ কয়েকটি সুন্দর কবিতা লেখেন। এই কবিতাগুলো রুশ ও বিশ্ব সাহিত্যের অমর সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। তার এসব কবিতায় রয়েছে পবিত্র কুরআনের বাণীর ও প্রাচ্যের নানা ভাবধারার প্রতিফলন এবং ইসলাম, মহানবী (সা) ও মুসলমানদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা আর অনুরাগ। মহানবীর (সা) জীবনী, ধর্মের নানা দিক, হজ, নামাজ ও পবিত্র স্থানের বর্ণনা স্থান পেয়েছে বুনিনের এসব কবিতায়। বুনিন তার কবিতায় মুসলমানদেরকে নাফস্ বা নেতিবাচক প্রবৃত্তি ও বিজাতীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়েছেন। 

মুসলমানরা যাতে মানবীয় পূর্ণতা বজায় রাখে ও বিজাতীয়দের কাছে মাথা নত না করে- রুশ কবি বুনিন সে আহ্বান জানিয়েছেন তার কবিতায়। বিলীয়মান সূর্য, তারকা ও চাঁদ দেখে সেসব স্রস্টা হতে পারে না বলে হযরত ইব্রাহিম (আ)'র যে কাহিনী রয়েছে বুনিন কবিতায় তা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। মহানবীর হিজরত সম্পর্কে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে একটি সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন বুনিন। কবিতাটির শিরোনাম 'খোঁজা হচ্ছে মুহাম্মাদকে (বন্দি করার জন্য) '। ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে মহানবী (সা) যেসব দুর্ভোগ ও কষ্টের শিকার হয়েছিলেন তা ফুটে উঠেছে বুনিনের ওই কবিতায়। সুরা তওবার ৪০ ও ৪১ নম্বর আয়াতে এ বিষয়ে মহানবীর প্রতি ফেরেশতাদের সহায়তা ও মহানবীর (সা) প্রতি সান্ত্বনার বিষয়টিও বুনিনের দৃষ্টি এড়ায়নি। ওই আয়াতে বলা হয়েছে:

যদি তোমরা তাঁকে তথা রসূলকে সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো, আল্লাহ তাঁর সাহায্য করেছিলেন, যখন তাঁকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তাঁরা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন বিষণ্ণ হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর প্রতি নিজ সান্ত্বনা নাযিল করলেন এবং তাঁর সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখনি। বস্তুত: আল্লাহ কাফেরদের মাথা নিচু করে দিলেন আর আল্লাহর কথাই সদা সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ