সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০ ১৬:৩৫ Asia/Dhaka

ঔপনিবেশিক যুগের অবসানের পর পাশ্চাত্যে মহানবী (সা) ও ইসলাম এবং প্রাচ্য সম্পর্কে গবেষণা ও তথ্য-অনুসন্ধান আগের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় যুক্তি ও প্রামাণ্য তথ্য-নির্ভর হয়ে উঠতে থাকে।

তবে ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে পশ্চিমা শিক্ষিত মহলের ও ক্ষমতাসীন মহলের সবাই-ই যে বন্ধু-ভাবাপন্ন বা নিরপেক্ষ হয়ে পড়েন তা কিন্তু নয়। পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে মহাকবি গ্যাটে, গিবন, কার্লাইল, টয়েনবি, ওয়াশিংটন আরভিং ও লিও টলস্টয়ের মত ব্যক্তিত্বরা খ্রিস্টবাদের কথিত ধারক-বাহক ও তাদের সমর্থক-গোষ্ঠীর ইসলাম-বিদ্বেষী অনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইসলাম ও মহানবী (সা)-কে বিচার করার এবং ইসলাম ও এর মহানবীর ব্যাপারে অবমাননাকর মত প্রকাশের কঠোর বিরোধিতা করেছেন। তারা ইসলাম ও এর মহানবীর (সা) শ্রেষ্ঠত্বের নানা দিক তুলে ধরেছেন এবং মহানবীর (সা) ভূয়সী প্রশংসা করেছেন নিরপেক্ষ যুক্তি ও বিচার-বিশ্লেষণের আলোকে। 

ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায়  পবিত্র কুরআনের মোটামুটি যথাযথ অনুবাদ প্রকাশ হওয়ায় এবং মহানবীর জীবনী সম্পর্কে সরাসরি মুসলমানদের উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহের রীতি চালু হওয়ায় পাশ্চাত্যে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করার ও অতীতের বিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর প্রভাব দূর করার পরিবেশ গড়ে উঠতে থাকে। অবশ্য  বিংশ শতকের প্রথমার্ধেও ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে অতীতের ভুল বিচার-বিবেচনার ধারার প্রভাব অব্যাহত থেকেছে। তবে পবিত্র কুরআনের বেশিরভাগ পশ্চিমা অনুবাদক ও মহানবীর জীবনী লেখকদের বেশিরভাগই বিংশ শতকে ইউরোপের ইসলাম-বিদ্বেষী ভুল ধারণাগুলোর অনুগামী হননি। তারা বরং মহানবীর (সা) আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করে তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
 রুশ মনীষী লিও টলস্টয় মহানবীর (সা) নির্বাচিত বক্তব্য বা হাদিস তুলে ধরে বই লিখেছেন যাতে পশ্চিমারা মহানবীর (সা) উচ্চ পর্যায়ের চিন্তাধারা ও মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালনা বা শিক্ষা দেয়ার বিষয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি কিছুটা হলেও বুঝতে পারে। যেমন, মহানবীর (সা) ন্যায়বিচারকামিতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারবোধ তুলে ধরতে গিয়ে লিও টলস্টয় সেই বিখ্যাত হাদিসটি তুলে ধরেছেন যেখানে মহান আল্লাহর সর্বশেষ রাসুল (সা) বলেছেন: তোমাদের ভাইদের মধ্যে যারা জালেম ও মজলুম- এ দুই শ্রেণীকেই সাহায্য কর। প্রশ্ন করা হল যে মজলুম তাকে আমরা সাহায্য করতে পারি, কিন্তু যে জালেম তাকে কিভাবে সাহায্য করব? মহানবী (সা) এ প্রশ্নের উত্তরে বললেন: জালেমকে জুলুম থেকে বিরত রাখাটাই হচ্ছে তাকে সাহায্য করা।

আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের সাহায্য করা ও  ভালবাসা এবং পরোপকারের বিষয়ে মহানবীর (সা) আহ্বান লিও টলস্টয়কে এতই মুগ্ধ করেছিল যে এরই আলোকে টলস্টয় তার সব সম্পদ বিলি-বণ্টন করেছিলেন। টলস্টয় এরই আলোকে মনে করতেন যে মালিকানা ও জুলুমের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। টলস্টয় তার 'রিসারেকশান' বা পুনরুত্থান নামক উপন্যাসে এ বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। 
মহানবীর (সা) সুমহান ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের প্রতি জার্মান মহাকবি গ্যাটের আকর্ষণের কথা আমরা অনেকেই শুনেছি। মহানবীর প্রশংসায় লেখা গ্যাটের কবিতায় আকৃষ্ট হয়েছেন আরেক বড় জার্মান কবি রাইনার মারিয়া রিল্কে। গ্যাটের কবিতা ও লেখার প্রভাবে তিনি প্রাচ্য, ইসলাম ও মহানবীর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। রাইনার মনে করতেন ইসলাম ধর্ম মানুষের আত্মা ও শরীরের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে যা থেকে ইউরোপীয়রা বঞ্চিত। রাইনার ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে নিজের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তার ‘ডুইনো এলিজিস’ নামক কাব্যে। 
 ইসলামের যে বিষয়টি রাইনারকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে তা তুলে ধরতে গিয়ে রাইনার বলেছেন: এক সময় পবিত্র কুরআনকে কণ্ঠস্থ বা মুখস্থ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমি যা পেয়েছি তা হল সেখানে আমি আঙ্গুলের শক্তিশালী নির্দেশনা দেখতে পেয়েছি যা একটি হাতের মত নির্দেশক হয়ে আকাশের দিকে পথ দেখাচ্ছে ও আল্লাহকে দেখাচ্ছে। আর চিরস্থায়ীভাবে তার উদয় হচ্ছে প্রাচ্য-ভূমিতে এবং তা কখনও শক্তিহারা হবে না।  
অত্যন্ত জনপ্রিয়, চিন্তাশীল ও অন্তর্মুখী আধুনিক কবি রাইনার  মহানবীর (সা) প্রশংসা করে লিখেছেন:  মুহাম্মাদ পড়ালেখা-শেখা ব্যক্তি ছিলেন না যা কুরআনেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি কেবল তখনই পড়া শিখতে শুরু করেন যখন মক্কার মরু প্রান্তরের দূরবর্তী একটি গুহায় তাঁর ওপর নাজিল হওয়া খোদার বাণী স্পষ্ট হয়। আল্লাহর সঙ্গে মুহাম্মাদের নৈকট্য এবং সুস্পষ্ট বাস্তবতার সঙ্গে তাঁর মিলন – এসবই এসবই তাঁর পবিত্রতা ও কলুষমুক্ততারই ফসল।

রাইনার জীবনে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোসহ অনেক মুসলিম দেশ সফর করেছেন। পর্যবেক্ষণ করেছেন নানা জাতির চিন্তা-চেতনা, সংস্কৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গি।  এইসব সফর তার জীবনের ওপর প্রভাব রেখেছে। জীবনের লক্ষ্য ও অর্থ খুঁজে নেয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন উৎসাহী গবেষক ও সক্রিয়। এক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টার ফসল হল ‘ইউরোপে মুহাম্মাদ’ শীর্ষক বই। বইটিতে লেখা হয়েছে: মিশর, আলজেরিয়া ও তিউনিশিয়া সফরের অনেক আগেই ইসলামের প্রতি আগ্রহ অনুভব করেছিলেন তিনি.... আলজেরিয়া থেকে স্ত্রীর কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি লিখেছেন: জীবন এখানে এক হাজার ও এক রাত (আলেফ-লায়লা) থেকে উৎসারিত হয়, আল্লাহ সবচেয় বড়, বিশ্বের কোনো শক্তিই তাঁর শক্তির চেয়ে বড় নয়। কায়রো থেকে স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছেন: এটা খুব বিস্ময়ের ব্যাপার যে মানুষ কিভাবে এই ধর্ম তথা ইসলামের সরলতা ও প্রাণবন্ততা বা শক্তিমত্তা অনুভব করে! ব্যাপারটা এমন যে মনে হয় যেন মহানবী (সা) গতকালও এখানে ছিলেন এবং এ জনপদ বা শহর তাঁরই কর্তৃত্বাধীন!#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ