অক্টোবর ০৬, ২০২০ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

আমরা গত আসরে বলেছিলাম 'সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ' সংক্রান্ত ঐশী বিধান সম্পর্কে। আমরা বলেছিলাম যে,একটা সুষ্ঠু সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে কেবল স্রষ্টার নির্দেশিত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

আল্লাহ সেরকম সমাজব্যবস্থার রূপরেখা গ্রন্থাকারে এবং রাসূলের জীবন বাস্তবতার সুন্নাতের আদলে সমগ্র মানব জাতির জন্য দিয়ে দিয়েছেন।

মানুষ যখনই ওই ঐশী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা ভুলে গিয়ে ভিন্ন কোনো ব্যবস্থার অধীন হয়ে পড়বে তখনই সমাজে দেখা দেবে বিচিত্র সামাজিক বিচ্যুতি ও  অবক্ষয়। আর একটি অবক্ষয়িত সমাজে কেউই নিরাপদ নয়। কেউ সুস্থ থাকতে পারে না। পুরো সমাজটাই তখন হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়ে-নীতি নৈতকতার হুমকি, চারিত্র্যিক অবক্ষয়ের হুমকি, বিচিত্র বিশৃঙ্ক্ষলার হুমকি। এইসব হুমকি থেকে মুক্ত থাকার জন্যই ধর্মীয় শিক্ষা, বিধি-বিধানগুলো সমাজে বজায় রাখার জন্য এককথায় ঐশী ব্যবস্থা সমাজে চালু রাখার জন্য স্রষ্টার পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি টানবো 'আদর্শ জীবনযাপন" শীর্ষক ধারাবাহিকের।

এই যে বললাম ঐশী ব্যবস্থা সমাজে প্রতিষ্ঠার কথা ভুলে গেলে সামাজিক নিরাপত্তা, পবিত্রতা এককথায় সার্বিক শৃঙ্ক্ষলা হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, সে কারণেই ধর্মীয় বিধি-বিধানগুলোকে সমাজে বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই দায়িত্বটা কেবল মুসলমানদের ওপরই বর্তায় না। মুসলমানদের বাইরেও যারা সমাজে বসবাস করে তাদের দায়িত্ব। তবে তাদেরকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব সচেতন করে তোলার জন্য অনুপ্রাণিত করে তোলার কাজটি করতে হবে স্রষ্টার প্রতি অনুগতদেরকেই।  সৎ কর্মের আদেশ আর অসৎ কাজে নিষেধ করার দায়িত্বটি পালন করার মধ্য দিয়ে সামাজিক শৃঙ্ক্ষলা বিধি মেনে চলার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ হবার পাশাপাশি  সামাজিক মূল্যবোধগুলোও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

তো একটি সমাজের লোকজন যদি একে অপরকে শৃঙ্ক্ষলাবিধি মেনে চলার ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতে থাকে, ভালো কাজ করার আদেশ দিতে থাকে আর মন্দ কাজ করতে নিষেধ করতে থাকে, তখন ধীরে ধীরে ওই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কল্যাণ ও শুভের বিস্তার ঘটতে থাকে। ওই শুভ ও কল্যাণের ইতিবাচক প্রভাব পড়ে সমাজের প্রতিটি মানুষের অন্তরাত্মায়। সমাজ তখন হয়ে ওঠে আদর্শস্থানীয়। রাসূলে খোদা (সা) সমাজকে একটি নৌকার সঙ্গে তুলনা করে চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়েছেন। সেইসঙ্গে 'ভালো কাজ করার আদেশ আর মন্দ কাজ করতে নিষেধ' করা এবং সমাজের প্রতি নজর রাখার প্রবণতাকে স্বভাব ও প্রকৃতিগত অধিকার বলে উল্লেখ করেছেন।

ধর কোনো এক ব্যক্তি পাপ করেছে। সমাজের অসংখ্য মানুষের মাঝে সেই লোকটির অবস্থান হলো একটি নৌকার যাত্রীর মতো। নৌকায় সে যে স্থানে বসেছে সেই স্থানে কুঠার দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে নৌকা ছিদ্র করে দিচ্ছে। অন্যান্য যাত্রীরা যতই তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করছে সে ততই বলছে: 'আমি আমার অংশে যা খুশি করবো, কার কী বলার আছে'।  নৌকার অপরাপর যাত্রীরা যদি তাকে এই বিপজ্জনক কাজ থেকে বিরত না রাখে তাহলে সমুদ্রের পানি ওই নৌকার ভেতর ঢুকতে বেশি সময় লাগবে না। লক্ষ্য করার বিষয় হলো যে লোকটি নৌকায় কুঠার মেরেছে সমুদ্রের অথৈ জলে শুধু সে-ই কিন্তু ডুবে মরবে না বরং নৌকার সকল যাত্রীই একসঙ্গে ডুবে যাবে।

এ কারণেই কুরআনের সংস্কৃতিতে মুমিনদের ওপর সমাজের প্রতিটি মানুষের ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সামাজিক অবক্ষয় রোধ করার লক্ষ্যে কিংবা নীতি-নৈতিকতার সুরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। কোনোভাবেই নিষ্ক্রিয় বসে থাকার সুযোগ নেই। ঈমানি এই দায়িত্ব পালনের স্বার্থে সবাইকে পরস্পরের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। তাহলেই একটি সুষ্ঠু, সুন্দর ও পবিত্র একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি হবে। পবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে অনেক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। একটি আয়াত হলো সূরা আল-ইমরানের ১০৪নম্বর আয়াত। বলা হয়েছে: "তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা নেকি ও সৎকর্মশীলতার দিকে মানুষকে আহবান জানাবে,ভালো কাজের নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে। 

প্রশ্ন জাগতে পারে সৎ কাজ আর অসৎ কাজ কোনগুলো। কুরআনে মজিদে সৎ কাজের আদেশ করার জন্য যে কাজগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে পড়ে: আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা, ন্যায় বিচার, ধৈর্যশীলতা, আল্লাহর জিকির বা স্মরণ, কাজের প্রতি আন্তরিক হওয়া ইত্যাদি। আর যেসব কাজ করতে নিষেধ করার কথা বলা হয়েছে সেসব কাজের মধ্যে রয়েছে: জুলুম অত্যাচার, খোদাদ্রোহিতা, পাপাচার, খিয়ানত বা আমানত রক্ষা না করা, বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করা, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যারা পথ দেখান তাদের বিরোধিতা না করা ইত্যাদি। সমালোচনা বা ভুল-ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দেয়ার বিষয়টি অনেকটা তিক্ত ওষুধের মতো। খেতে খুব তিতা হলেও রোগ সারিয়ে তোলে। সুতরাং সমাজে এক মুমিন অপর মুমিনকে এই ওষুধ দিয়ে যাবে কারই উপকারে-সেটা যতো তিক্তই মনে হোক না কেন। এটাই সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ।

কোনো রোগীকে যদি অপারেশন করাই লাগে তাহলে তার অপারেশন করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হয়। নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজে যদি সেরকম অপারেশন চালানোর প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে সমাজের স্বার্থেই আপনাকে পদক্ষেপ নিতে হবে। সমাজে যারা অবক্ষয় সৃষ্টির জন্য দায়ী তাদেরকে যে করেই হোক বোঝাতে হবে। এই বোঝানোর কাজটাই হলো আমর বিল মারুফের কাজ আর নিহি আনিল মুনকারের কাজ।

এই ধারাবাহিকে আমরা কুরআনের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের জীবনকে আদর্শ স্থানীয় করে তোলার উপায়গুলো নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। যদি এতোটুকুও আপনাদের কাজে লাগে থেকে তাহলে আমরা আমাদের শ্রমকে সার্থক বলে মনে করবো।

আল্লাহ আমাদের সকলকে তারই প্রদর্শিত নিয়মে জীবন সাজানোর যোগ্যতা দিন। কুরআন হয়ে উঠুক আমাদের জীবন চলার সহায়ক। সততা ও কল্যাণ হোক আমাদের পাথেয়-এই প্রত্যাশায় পরিসমাপ্তি টানছি 'আদর্শ জীবনযাপন' শীর্ষক ধারাবাহিকের। যারা এই দীর্ঘ যাত্রায় আমাদের সঙ্গী ছিলেন সবার প্রতি রইলো আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো:আবুসাঈদ/ ০৬

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ