অক্টোবর ০২, ২০২০ ১৬:৩০ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি, বিংশ শতকের আরেক প্রখ্যাত পশ্চিমা ইতিহাসবিদ ও মনীষী উইলিয়াম জেমস্ ডুরান্টও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে এ সম্পর্কে উদার ও যৌক্তিক প্রশংসাসূচক মন্তব্য করতে দ্বিধান্বিত হননি।

মহানবীর (সা) প্রশংসা করে মার্কিন মনীষী উইল ডুরান্ট লিখেছেন: মহাপুরুষরা কতটা মহৎ বা শ্রেষ্ঠ তা বিচারের মানদণ্ড হয় যদি প্রভাব তাহলে আমাদেরকে বলতে হবে যে মানব-ইতিহাসে মহাপুরুষদের মধ্যেও মুহাম্মাদ (সা) হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ। মহানবীর শিক্ষার আলোকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের খুব দ্রুত বিকাশ ঘটেছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

ডুরান্ট লিখেছেন: ইসলামী সভ্যতায় তথা হিজরি ৮১ সন থেকে বা খ্রিস্টিয় ৫৯৭ সন পর্যন্ত খ্রিস্টিয় ৭০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে নানা ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ অগ্রগতি ঘটেছিল।

উইল ডুরান্ট আরও লিখেছেন: ইসলামী সভ্যতায় পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জীববিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যাসহ প্রাকৃতিক ও ব্যবহারিক বিজ্ঞানের নানা শাখায় সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছিল। জ্ঞানের এইসব শাখার বড় বড় বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা মুসলিম বিশ্বে এসব বিষয়ে গবেষণা ও লেখালেখি করতেন এবং এসব বিষয়ে তারা শিক্ষকতাও করতেন। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের মৌলিক এইসব শাখার জ্ঞান বিশ্বের নানা অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষার্থীদেরও শেখাতেন। আর ইসলামী সভ্যতার উজ্জ্বলতার এই যুগে পশ্চিমা বিশ্ব মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা, বন্যতা বা হিংস্রতা ও গির্জাগুলোর গোড়ামিপূর্ণ চিন্তাধারায় ডুবে থেকে বুদ্ধিবৃত্তি, শিল্পকলা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান থেকে পুরোপুরি দূরে ছিল। অন্যদিকে একই সময়ে মুসলিম বিশ্বের অবস্থা ছিল ঠিক বিপরীত। এ সময় ইবনে সিনা, খাওয়ারেজমি, ফারাবি, মুহাম্মাদ বিন জাকারিয়া রাজি, আবু রায়হান বিরুনি, ওমর খৈয়াম ও ইবনে খালদুনের মত ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানীরা কোনো সীমাবদ্ধতা ছাড়াই বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো ছড়াতেন।

 

উইল ডুরান্টের উল্লেখিত এই ইসলামী সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল মহানবীর (সা) পবিত্র হাতেই যিনি মানুষকে দিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ নৈতিকতা, আত্মশুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও কুরআনের মত ঐশী মহাগ্রন্থের জ্ঞানের শিক্ষা। আর বিভিন্ন যুগে এ সভ্যতাই ফুলে-ফলে তথা জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্মীয় আইন, প্রযুক্তি, বুদ্ধিবৃত্তি, সাহিত্য, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির মত নানা ক্ষেত্রে হয়েছে বিকশিত ও সুশোভিত। একত্ববাদকেন্দ্রীক এই সভ্যতাই জন্ম দিয়েছে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সুতিকাগার যেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বরা। এই ইসলামী সভ্যতার ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে বিশ্বের বহু জাতি এবং এই সভ্যতার এত দ্রুত বিকাশ ও অকল্পনীয় উন্নতি পশ্চিমা মনীষী ও গবেষকদেরও বিস্ময়ে থ হয়ে যেতে বাধ্য করে।
বিশ্বনবীর (সা) বিশাল ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে উইল ডুরান্ট লিখেছেন:

মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন একটি সভ্রান্ত ও উচ্চ-বংশীয় ঘরের সন্তান যে তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন খুব নগণ্য সম্পদ। মুহাম্মাদ শব্দের অর্থ খুবই প্রশংসিত। এই শব্দটি ও পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোর কোনো কোনো উদ্ধৃতির মধ্যে আধ্যাত্মিক বন্ধন বা যোগসূত্র দেখা যায় যা মুহাম্মদের আগমন সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে বিবেচিত। তাঁর বাবা আবদুল্লাহ ছেলের জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যান কেবল ৫টি উট, কয়েকটি ভেড়া, একটি ঘর ও এক দাসী।... ছয় বছর বয়সে তিনি তার মাকে হারান। এ সময় প্রথমদিকে ৭৬ বছর বয়সী দাদা তাঁর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেন। এরপর চাচা আবু তালিব তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। মুহাম্মাদ তাঁদের কাছ থেকে অনেক স্নেহ ও দয়া পেয়েছেন। কিন্তু কেউই তাকে লেখাপড়া শেখানোর কথা ভাবেননি। সে সময় আরবদের মধ্যে লেখাপড়া শেখানোটা গুরুত্ব পেত না। আর তাই গোটা কুরাইশ গোত্রে লিখতে-পড়তে জানা শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭জনআর তা সত্ত্বেও আরবী ভাষার সবচেয়ে বিখ্যাত ও সবচেয়ে প্রচলিত বইটি মুহাম্মাদের মুখ দিয়ে প্রচার হয়েছে এবং তিনি নানা বিষয়ের জ্ঞান শিক্ষিত ব্যক্তিদের চেয়েও অনেক নিখুঁতভাবে জানতেন।

উইল ডুরান্টই হলেন প্রথম মনীষী যিনি ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেছেন সভ্যতার গতিধারা বা প্রবাহকে মানদণ্ড হিসেবে ধরে নিয়ে। জাতিগুলোর ইতিহাস কিভাবে মানব-সভ্যতার ইতিহাসে প্রভাব রেখেছে তা তিনি তুলে ধরেছেন। ডুরান্ট আরো লিখেছেন: মুহাম্মাদ ছিলেন মহানুভব। শত্রুরা অনুতপ্ত হলে তিনি তাদের ক্ষমা করতেন। যুদ্ধ, বিচার, ধর্ম, ও ধর্মীয় আইনের ব্যাখ্যার মত রাষ্ট্রীয় নানা কাজের তত্ত্বাবধানে তাঁর বেশিরভাগ সময় ব্যয় হত। তিনি পঞ্জিকা বা তারিখ-ব্যবস্থাপনার দিকেও নজর রাখতেন এবং এ বিষয়টিকে নিজ অনুসারীদের জন্য সুবিন্যস্ত করেছেন। রাসুল হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে তিনি কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতেন ও মানুষের নিত্যকার সাধারণ বিষয়েও আইন ও বিধানের ঘোষণা আসত পবিত্র কুরআনে।

উইল ডুরান্ট আরো লিখেছেন: মুহাম্মাদ বন্য স্বভাবের মানুষগুলোকে জ্ঞান ও নৈতিকতার দিক থেকে সর্বোচ্চ উঁচুতে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছেন এবং তাঁর এই সাফল্য বিশ্বের সব সংস্কারকের চেয়ে অনেক বেশি। তাঁর মত এমন কাউকে খুব কমই পাওয়া যাবে যিনি সব আকাঙ্ক্ষাগুলো ধর্মের মধ্যে বাস্তবায়ন করেছেন। মুহাম্মাদ মূর্তি-পূজারী মরুভূমির বিচ্ছিন্ন গোত্রগুলোকে এক ঐক্যবদ্ধ জাতিতে এবং তাদেরকে ইহুদি ও খ্রিস্টানসহ আরব উপদ্বীপের অতীতের সব ধর্মের অনুসারীদের চেয়ে অনেক উন্নত জাতিতে পরিণত করেছেন। তিনি এক সহজ-সরল, উজ্জ্বল ও শক্তিশালী ধর্ম উপহার দিয়েছেন। ... ব্যাপারটা এমনই যে ১০০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এক বিশাল ও সুবিস্তৃত সাম্রাজ্য গড়ে উঠল। তাঁর ধর্ম আমাদের এই যুগেও এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি এবং তা পৃথিবীর অর্ধেক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর ধর্মের অনুসারীর সংখ্যাও দিনকে দিন বাড়ছে। তাই মহাপুরুষ বা বড় ব্যক্তিত্বদের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের মানদণ্ড যদি হয় প্রভাবের মাত্রা তাহলে মুহাম্মাদ (সা) ইতিহাসের সব মহাপুরুষদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ। #

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ০৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ