আসমাউল হুসনা (পর্ব-৭)
গত কয়েক পর্বে আমরা পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত সুন্দরতম নাম বা আসমাউল হুসনা হিসেবে খ্যাত মহান আল্লাহর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নামের অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা শুনেছি। আজ আমরা মহান আল্লাহর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম সালাম-এর অর্থ, ব্যাখ্যা ও গুরুত্ব নিয়ে কথা বলব।
সালাম শব্দটি পবিত্র কুরআনে চল্লিশ বারেরও বেশি এসেছে। বাহ্যিক ও অদৃশ্য বা সুপ্ত বিপদ-আপদ থেকে সুরক্ষা চাওয়া হয় এ শব্দের মাধ্যমে। শান্তিও এ শব্দের অন্যতম অর্থ। সালামাত বা নিরাপত্তা, ইসলাম, তাসলিম, সালিম ইত্যাদি শব্দের উৎস হল এই সালাম শব্দটি। সালাম শব্দের অনেক অর্থ রয়েছে। এ শব্দের অর্থ তথা শান্তি বা নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও সুস্থতা ইত্যাদি আসে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই। আর এ জন্যই পরস্পরকে সালাম দেয়াটা বরকত ও সৌভাগ্য বয়ে আনে। এ নামের পুনরাবৃত্তি আল্লাহকে স্মরণ করার মাধ্যম। সম্ভবত সালাম দেয়ার ওপর ইসলামের এমন ব্যাপক গুরুত্ব আরোপের অন্যতম রহস্য লুকিয়ে আছে এর মধ্যে। মহান আল্লাহ স্বয়ং তাঁর প্রিয় বান্দাহদের সালাম দিয়েছেন ও তাঁদের প্রশংসা করেছেন।
প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক ও মুফাসসির আয়াতুল্লাহ যাওয়াদ অমোলির মতে নবী-রাসুল ও সৎ-বান্দাহদের প্রতি মহান আল্লাহর সর্বোত্তম শুভকামনা হল সালাম। মহান আল্লাহর এই সালাম কখনও কখনও কোনো মাধ্যম ছাড়াই পাঠানো হয়েছে। যেমন, মহান আল্লাহ নুহ নবী ও হযরত ইব্রাহিমকে সরাসরি সালাম দিয়েছেন। আবার কখনও কখনও মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় কোনো মানুষ বা নবী-রাসুল বা ওলির মাধ্যমে সৎকর্মশীল মানুষকে সালাম দিয়েছেন। যেমন, সুরা ত্বাহার ৪৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ হযরত মুসার মাধ্যমে বলেছেন, হেদায়াত বা সুপথের অনুসারী সবার ওপর রইল সালাম। - এই সালাম কেবল দুনিয়াতেই সীমিত নয়। বিচার-দিবস বা পরকালেও সৎ বান্দাহদের প্রতি এটি সর্বোচ্চ উপহার।

ফেরেশতারাও আল্লাহর সৎ বান্দাহদের বেহেশতে অভ্যর্থনা জানাবেন যেসব সুন্দর শব্দ উচ্চারণ করে তার মধ্যে প্রথমেই থাকবে সালাম। আর রুহ কবজের সময় তথা মৃত্যুর সময়ও ফেরেশতারা সৎ বান্দাহদের সালামসহ নানা শুভেচ্ছা-বার্তা জানিয়ে পার্থিব শরীর থেকে রুহকে বিচ্ছিন্ন করেন।
এভাবে মুমিনরা ফেরেশতাসহ যাদেরই সামনে পড়েন তাদের পক্ষ থেকে সালামসহ নানা শুভেচ্ছা-বার্তা পেয়ে থাকেন। আয়াতুল্লাহ যাওয়াদ অমোলির মতে সালামের মত পবিত্র শব্দ ছাড়া অন্য শব্দগুলো মুমিনের কানে প্রশান্তি যোগায় না। মুমিনদের কান এ ধরনের পবিত্র শব্দ ছাড়া অর্থহীন ও পাপময় বা কলুষিত শব্দ আর বাক্য থেকে পবিত্র থাকে।
সুরা হাশরের ২৩ নম্বর আয়াতে সালাম শব্দটি মহান আল্লাহর নাম হিসেবে এসেছে। এই আয়াতের অর্থ হল :তিনিই আল্লাহ তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, সব ত্রুটি থেকে পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা, আশ্রয়দাতা, সব কিছুর ওপর পরাক্রান্ত ও অপরাজেয়, প্রতাপান্বিত, গৌরবান্বিত ও মাহাত্যশীল। তারা যাকে অংশীদার করে আল্লাহ তা’ আলা তা থেকে পবিত্র।
মহান আল্লাহর নামের ক্ষেত্রে এ শব্দটি ব্যবহারের কারণ হল তাঁর অস্তিত্বের মধ্যে বিন্দুমাত্র অকল্যাণ বা মন্দ কিছু নেই বরং তিনি পরিপূর্ণরূপে মঙ্গলময়। মহান আল্লাহ তার বান্দাহদের সঙ্গে শান্তিময় ও কল্যাণময় বা সুরক্ষাময় আচরণ করে থাকেন। বেহেশতকে দারুস সালাম বা শান্তির ঘর বলা হয় এ কারণেই। চিরস্থায়ী এই আবাসে রয়েছে কেবলই প্রাচুর্য ও সম্মান নেই দারিদ্র ও অসম্মান, অসুস্থতার বিপরীতে এখানে রয়েছে কেবলই সুস্থতা। আর এটাই হচ্ছে পরিপূর্ণ সুস্থতা।
সুরা ইউনুসের দশ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, সেখানে তাদের প্রার্থনা হল ‘পবিত্র তোমার সত্তা হে আল্লাহ’। আর শুভেচ্ছা হল সালাম আর তাদের প্রার্থনার সমাপ্তি হয়, ‘সমস্ত প্রশংসা বিশ্বপালক আল্লাহর জন্য’ বলে।
মহানবী (সা) বলেছেন, সালাম হচ্ছে মহান আল্লাহর অন্যতম নাম যা জমিনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাই তোমরা ছড়িয়ে দাও নিজেদের মধ্যে সালাম।
সালামের সঙ্গে মিশে রয়েছে সুস্থতা ও পবিত্রতা। হারাম খাদ্য, হারাম দৃশ্য ও হারাম কিছু শোনা থেকে বিরত থাকতে হবে সালাম অর্জনের জন্য। আল্লাহর পরিপূর্ণ দাসত্বের মধ্যেই রয়েছে আমাদের সালাম। আর তা নেই বলেই আমাদের মধ্যে রয়েছে নানা সংকট, পাপ ও পঙ্কিলতা। নামাজ রোজা হজ জাকাত, খোমস্- এসবই সালাম অর্জনের জন্য জরুরি। আর আত্মিক সুস্থতা বা সালামতির জন্য দরকার উন্নত বা ইসলামী নৈতিক গুণ। হিংসা মনে রেখে বেহেশত অর্জন সম্ভব নয়।
সালাম এক ধরনের প্রশংসা ও শুভেচ্ছা। সুরা নুরের ৬১ নম্বর আয়াতের একাংশে মহান আল্লাহ বলেছেন, অতঃপর যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ কর, তখন তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া।
আবার কুরআনের অন্যত্র সালামকে শুভেচ্ছা হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে কেউ তোমাকে শুভেচ্ছা জানালে আরও ভালো শুভেচ্ছা বা অন্তত সমপর্যায়ের উত্তর দাও। এখানে সালাম বলতে কারো জন্য ভালো কাজও হতে পারে। একবার ইমাম হুসাইনের এক দাসী তাঁকে একটি ফুল উপহার দেন। ইমাম তাকে মুক্ত করে দেন। অন্যরা এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে ইমাম বললেন, মহান আল্লাহই বলেছেন কেউ তোমাকে শুভেচ্ছা জানালে তাকে আরও ভালো শুভেচ্ছা জানাও! আর দাসীর এই শুভেচ্ছার জবাবে অপেক্ষাকৃত ভালো শুভেচ্ছা হল তাকে মুক্ত করে দেয়া।
সালাম দেয়া হচ্ছে অহংকারমুক্ত মন ও বিনম্রতার পরিচয়। সালাম বয়ে আনে ভালবাসা। মহানবী সালাম দিতে এত অভ্যস্ত ছিলেন যে অন্যরা সালাম দেয়ার আগেই তিনি সালাম দিতেন এবং শিশুদেরও তিনি সালাম দিতেন। তিনি বলেছেন, একটি সালাম প্রদান ও তার জবাবে ৭০টি সাওয়াব থাকে। আর যিনি আগে সালাম দেন তিনি পান এর ৬৯টি সাওয়াব এবং জবাবদাতা পায় একটি সাওয়াব। যে সালাম দিতে কার্পণ্য করে তাকে তিনি প্রকৃত কৃপণ বলে উল্লেখ করেছেন।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।