জানুয়ারি ৩১, ২০২১ ২০:৩০ Asia/Dhaka

আজ আমরা মহানবীর (সা) জীবনী সংক্রান্ত একটি বই নিয়ে আলোচনা করব। বইটির নাম হল ‘প্রাচীনতম তথ্য-উৎসগুলোর আলোকে মুহাম্মাদ (সা)’।

বইটি লিখেছেন প্রখ্যাত নওমুসলিম কবি ও ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ মার্টিন লিঙ্গস ওরফে আবুবকর সিরাজউদ্দিন। বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। সেই থেকে এ পর্যন্ত বইটি বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছে এবং বহুবার বইটি ছাপাতে হয়েছে। মার্টিন লিঙ্গস ওরফে আবুবকর সিরাজউদ্দিন এ বইয়ে মহানবীর (সা) জীবনী প্রাচীনতম তথ্য-প্রমাণের আলোকে তুলে ধরেছেন এবং তাঁকে বিশ্ববাসীর জন্য মহান আল্লাহর পাঠানো এক উজ্জ্বল ও কালোত্তীর্ণ নূর বলে উল্লেখ করেছেন।

মার্টিন লিঙ্গস ওরফে আবুবকর সিরাজউদ্দিন ১৯০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান পরিবারের সদস্য হিসেবে বড় হয়ে ওঠার সময় বিশ বছর বয়সে তিনি খ্রিস্ট ধর্মের ওপর আস্থা হারান। এরপর শুরু করেন সত্য ও বাস্তবতা খোঁজার সাধনা। মার্টিন লিঙ্গস ২৫ বছর বয়সে বিশ্বের ধর্মগুলো নিয়ে পড়াশুনা করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি পশ্চিমা দার্শনিক রেনে গনোন-এর লেখনীর সংস্পর্শে আসেন। রেনে গনোন-এর লেখা পড়ে মার্টিন লিঙ্গস এই বার্তা পান যে বিশ্বের সব ঐশী ধর্মই সত্য এবং এ সব ধর্মই মানবীয় পূর্ণতা ও মহান আল্লাহর সঙ্গে মিলনের পথ দেখানোর যোগ্যতা রাখে। রেনে গনোন-এর লেখা থেকে আরও বোঝা যায় যে ধর্ম, বিশেষ করে খ্রিস্ট ধর্ম মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে পরিত্যাগ করেছে এবং কেবল মানুষের আবেগ-প্রবণতাকেই খাদ্য যোগাচ্ছে। আর আধুনিকতার বিপর্যয় ঠিক এখান থেকেই শুরু হয়েছে।

রেনে গনোন-এর লেখা পড়ে খ্রিস্টান যুবক মার্টিন লিঙ্গস পশ্চিমা সভ্যতার ভুলগুলো বুঝতে সক্ষম হন এবং এটাও বোঝেন যে খোদায়ী ধর্মগুলো বাস্তব বা সত্য। আর এ ধর্মগুলোর বার্তাবাহক নবী-রাসুলরা নানা আঙ্গিকে বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। রেনে গনোন-এর লেখাগুলো মার্টিনের মধ্যে যেন বিদ্যুতের প্রবাহ বইয়ে দেয় এবং এই লেখাগুলোকে বাস্তব হিসেবে ধরে নিয়ে তিনি করণীয় কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। অবশেষে ব্যাপক গবেষণার পর মার্টিন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নিজের নাম রাখেন আবুবকর সিরাজউদ্দিন। ইসলাম ধর্মকে তিনি বেছে নেন এ কারণে যে এ ধর্ম অন্ধ অনুকরণের ধর্ম নয় ও হত্যাযজ্ঞের ধর্ম নয় বরং বুদ্ধিবৃত্তিক ও ক্ষমার ধর্ম।

মহানবীর (সা) অনুপম ব্যক্তিত্ব মার্টিনকে অভিভূত করে। তাই তিনি মহানবীর সুউচ্চ ব্যক্তিত্ব তুলে ধরার কাজে অনেক সময় ব্যয় করেন। মহানবীকে নিয়ে লেখা মার্টিনের বই ‘প্রাচীনতম তথ্য-উৎসগুলোর আলোকে মুহাম্মাদ (সা)’-এর অনুবাদক সায়িদ তেহরানি নাসাব লিখেছেন, আমি ২০০৪ সালের গ্রীস্মকালের শেষের দিকে মার্টিন লিঙ্গস তথা আবুবকর সিরাজউদ্দিন-এর সঙ্গে দেখা করেছিলাম তার সুন্দর অথচ সাদামাটা বাসভবনটিতে। এটা তার মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগের ঘটনা। তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও গুরুত্ব দিয়ে মহানবী (সা) সম্পর্কে কথা বলছিলেন এবং মহানবীকে (সা) মানবজাতির জন্য এক বড় উপহার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার বাসায় দেয়ালে মহান আল্লাহর পবিত্র নাম ও নামাজের জায়নামাজটিই কেবল দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। মনে হচ্ছিল তার ঘরটি যেন এক মসজিদ যেখানে দৈনিক পাঁচবার নামাজ পড়া হয়। তিনি হয়তো এখানে বসেই তার বইগুলো লিখতেন। বোঝাই যাচ্ছিল মার্টিন লিঙ্গস ওরফে আবুবকর সিরাজউদ্দিনের জীবনও ইসলামের সর্বোচ্চ নেতার অনুকরণে ঘড়ির মতই নিখুঁত, অর্থপূর্ণ কর্মসূচী-ভিত্তিক, সুশৃঙ্খল ও পরিকল্পিতভাবে চলছে।

মার্টিন লিঙ্গস তার বইয়ে মহানবীকে (সা) একজন অক্লান্ত নবী, ধৈর্যশীল সংগ্রামী ও অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন নেতা হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি হচ্ছেন এমন এক মহামানব যিনি অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়াই করেন বীরের মত, ভেঙ্গে দেন খোদারূপী মূর্তিগুলোকে এবং আল্লাহর সবচেয়ে অনুর্বর জমিতে বপন করেছেন সচেতনতার বীজ। আর সেই নতুন চারা গাছের যত্ন নিতে নিতে জীবন শেষ করেছেন। তার মতে মহানবীর অস্তিত্বই ইসলামের মূল ও চিরস্থায়ী বিষয়। মার্টিন লিখেছেন, আসল বিষয় হল যা সরাসরি আসল থেকে গড়ে ওঠে ঠিক যেমন বিশুদ্ধ ও পবিত্র পানি কখনও দূষণকারী উপাদানগুলোর নাগালে ও প্রভাবের আওতায় আসে না। ঠিক একইভাবে মহানবী (সা) সবকিছুর চেয়ে ওহির সঙ্গেই বেশি সম্পর্কিত। তিনি বিস্ময়করভাবে অন্য সব মানুষের চেয়ে ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও সুপথের বার্তাবাহক। কারণ তিনি মহান এক আল্লাহর সত্ত্বা ও একত্ব নিয়ে কথা বলেন।

মহানবীর পূর্বপুরুষদের সবাই যে ছিলেন এক খোদার উপাসক সে দিকে ইঙ্গিত করে মার্টিন লিঙ্গস তার বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে মহানবীর পূর্ববর্তী বংশধারা ও বংশধরদের প্রসঙ্গে লিখেছেন, তার জন্ম বা সৃষ্টি শীর্ষক বইয়ে এসেছে ইব্রাহিম নবীর কোনো সন্তান ছিল না এবং এ নিয়ে তিনি মনে কোনো আশাও লালন করতেন না যতক্ষণ না এক রাতে মহান আল্লাহ তাকে ঘর থেকে বেরুতে বললেন ও তাঁকে বললেন: এবার আকাশের দিকে তাকাও ও তারকাগুলো গুণে দেখ যদি গুণতে পার! এরপর ইব্রাহিম যখন আকাশের তারকাগুলোর দিকে তাকাচ্ছিলেন তখন আবারও এই গায়েবি বাক্য শুনলেন: তোমার বংশধরও হবে এমনই অসংখ্য

মার্টিন লিঙ্গস আরও লিখেছেন: ভাগ্যে এটাই লেখা হয়েছিল যে কেবল একটি উম্মত বা জাতি নয় বরং দুটি বড় জাতি বা উম্মত ও হেদায়াতপ্রাপ্ত দুই জাতি আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের দুই মাধ্যম বা ওয়াসিলা হবে। আর সে দুই উম্মতই হবে ইব্রাহিমের বংশধর। ইব্রাহিম (আ) দুই আধ্যাত্মিক ধারার ও দুই ধর্মের, দুটি বৃত্তের ও দুটি কেন্দ্রের উৎস। এ দুই ধারার একটি আমেনার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় রূপ পেল। তিনি তার সত্ত্বার ভেতরে একটি নুরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। একদিন তিনি তথা মা আমেনা শুনলেন যে তাকে বলা হল: তুমি এই উম্মত বা জনগণের আনন্দকে নিজের গর্ভে বহন করছ। যখন তাঁর জন্ম হবে তখন বলবে: আমি তাঁকে হিংসুকদের অনিষ্ট হতে এক আল্লাহর কাছে সোপর্দ করছি এবং এরপর তার নাম রাখবে মুহাম্মাদ (সা)।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ৩১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ