আসমাউল হুসনা (পর্ব-১০)
মহান আল্লাহর সত্ত্বার রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন অসম্ভব। মহান আল্লাহ'র কোনো কোনা গুণ ও গুণবাচক নাম থেকেই মহান আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে কিছু ধারণা অর্জন করা যায়।
পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত মহান আল্লাহর এ ধরনের বেশ কয়েকটি নামের অর্থ ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে আমরা বিগত কয়েক পর্বে আলোচনা করেছি।
মহান আল্লাহর আরেকটি বিখ্যাত নাম হল আযিয। অপরাজেয় এ শব্দের অন্যতম অর্থ। পবিত্র কুরআনে এ নাম এসেছে ৮০ বারেরও বেশি। সুরা হাশরের ২৩ নম্বর আয়াতেও মহান আল্লাহর নাম এসেছে। এই আয়াতের অর্থ হল :তিনিই আল্লাহ তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, সব ত্রুটি থেকে পবিত্র, তিনি কারো ওপর জুলুম করেন না। তিনি মুমিনদের নিরাপত্তা দান করেন। বিশ্ব ও বিশ্ববাসীর সংরক্ষক। শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা, আশ্রয়দাতা, সব কিছুর ওপর পরাক্রান্ত ও অপরাজেয়, তিনি তার অদম্য ইচ্ছার মাধ্যমে সব কিছুকে সংশোধন করেন। তিনি প্রতাপান্বিত, গৌরবান্বিত ও মাহাত্যশীল। তারা যাকে অংশীদার করে আল্লাহ তা’ আলা তা থেকে পবিত্র।
আরবি আযিয শব্দের রয়েছে নানা অর্থ। সম্মানিত বা মূল্যবান, সভ্রান্ত বা মর্যাদাশীল ও মহান এ শব্দের অন্যতম অর্থ। তবে আরবি সাহিত্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই শব্দটি বলতে বোঝায় প্রবল পরাক্রান্ত হওয়ার কারণে যিনি সব সময়ই বিজয়ী বা চির-বিজয়ী ও অপরাজেয়। অপরাজেয় হওয়ার জন্য দরকার হয় ক্ষমতা বা শক্তি। আর শক্তির জন্য দরকার হচ্ছে জ্ঞান ও সচেতনতা। যে শক্তির মধ্যে নেই যথাযথ বা দরকারি জ্ঞান ও যে শক্তি পারে না যথাসময়ে পরিকল্পিত তথ্যের প্রয়োগ ঘটাতে সেই শক্তি সব সময় জয়ী হতে পারে না।
যখন মহান আল্লাহকে বলা হয় আযিয তখন এর অর্থ হল তাঁর ইচ্ছাই সব কিছুর ওপর কর্তৃত্বশীল। দুনিয়ার সব পরাক্রান্ত ব্যক্তির সম্মানই নিরঙ্কুশ বা নিরেট নয়। তারা পরাজয় ও অবমাননার গ্লানিও বহন করে। কারণ কোনো সৃষ্টিই পুরোপুরি স্বাধীন নয়। বরং প্রত্যেক সৃষ্টি অন্য সৃষ্টির কর্তৃত্বাধীন। কোনো এক ব্যক্তি যদি সারা দুনিয়ার মানুষের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায়ও সক্ষম হয় তবুও তার এই কর্তৃত্বও চূড়ান্ত বা স্থায়ী নয়। সামান্য অসুখ বা করোনা ভাইরাস বা অক্সিজেনহীনতার কাছে ওই শক্তিধর ব্যক্তিও নতজানু হতে ও মৃত্যুর শিকার হতে পারে। একমাত্র মহান আল্লাহই হচ্ছেন এমন প্রবল পরাক্রান্ত বা প্রকৃত আযিয যার সত্ত্বার মধ্যে কোনো অবমাননা ও লাঞ্ছনার অস্তিত্বই থাকতে পারে না।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কার মুশরিকরা মহানবীকে নানাভাবে কষ্ট দিত। তারা মহানবীর (সা) সামনে নিজ নিজ মূর্তি ও দেবতার নামে বড়াই করত। তাদের দেয়া যন্ত্রণা ও উপহাস মহানবীকে দুঃখ দিত। তাই মহান আল্লাহ সান্ত্বনা হিসেবে সুরা ইউনুসের ৬৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ওদের কথায় আপনি ব্যথা অনুভব করবেন না। কারণ সম্মান ও পরাক্রমের মালিক একমাত্র আল্লাহই। অন্য কথায় মহান আল্লাহ অপরাজেয়।
পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে প্রকৃত সম্মান ও পরিপূর্ণ সম্মান একমাত্র মহান আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত। তদ্রূপ সত্য ও মিথ্যার লড়াইয়ে এবং খোদায়ি শক্তি ও শয়তানি শক্তির লড়াইয়ে সম্মান কেবল সত্যের পক্ষ তথা খোদায়ী পক্ষের জন্যই নির্ধারিত ও অবধারিত।

আযিয বলতে এমন কাউকে বোঝায় যিনি নজিরবিহীন ও যার কোনো সমকক্ষ নেই। আবার দুর্লভ দামী বস্তুকেও আযিয বলা হয়। তাই মহান আল্লাহই হলেন সবচেয়ে বড় আযিয। আযিয শব্দটি মহান আল্লাহর অন্য নামের সঙ্গে আরও বেশি অর্থবহ হয়ে ওঠে। যেমন হামিদের পর যদি আযিয শব্দটি আসে তাহলে এর অর্থ হয় মহান আল্লাহ মহান ও গৌরবময় এবং প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। যুন্তিক্বাম শব্দটির পর যদি আযিয শব্দটি আসে তবে তার অর্থ হল মহান আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিশালী ও জালিমদের কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী। আযিয মহান আল্লাহর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, সম্মান ও মহত্ত্বকে তুলে ধরে যার মধ্যে নেই বিন্দু মাত্র পরাজয় ও অবমাননা। আর এসব বিষয় মহান আল্লাহর সমকক্ষ না থাকার অনিবার্যতা তুলে ধরে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন যে সম্মান চায় সে জেনে রাখুক নিশ্চয়ই সমস্ত সম্মান কেবলই আল্লাহর। সব সম্মানের উৎস তিনিই। মহান আল্লাহর ইচ্ছা বা অনুমতি ছাড়া কেউ বিন্দুমাত্র সম্মানের অধিকারী হতে পারে না।
মহান আল্লাহর সঙ্গে যার সম্পর্ক বা ঘনিষ্ঠতা নেই সে ইজ্জত বা সম্মান পেতে পারে না। কারণ মহান আল্লাহই হচ্ছেন অশেষ সম্মানের মালিক ও উৎস। সুরা মুনাফিক্বুনের ৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, প্রকৃত সম্মান কেবল আল্লাহর ও তাঁর রাসুলের ও মুমিনদের।
খোদায়ি সম্মানের বিপরীতে এক ধরনের সম্মান দেখা যায় যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে সম্মান বলে মনে হলেও বাহ্যিক চাকচিক্যের মতই বাস্তবে অন্তসারশূন্য। যেমন, পদ, সম্পদ, খ্যাতি এসবকে গুরুত্ব দিয়ে অনেক মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় এবং এইসব ক্ষণস্থায়ী বিষয়কে আকড়ে ধরে আযিয বা প্রতিপত্তিশীল ও পরাক্রান্ত হতে চায়। সুরা নিসার ১৩৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: ওরা মুমিন মুসলমানদের বর্জন করে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নেয় এবং তাদেরই কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে, অথচ যাবতীয় সম্মান কেবল আল্লাহরই জন্য।
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রসহ কোনো ক্ষেত্রেই আমরা যেন সম্মানের আশায় ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করি। কারণ তারা স্বার্থের আশায় বন্ধুত্ব করলেও স্বার্থ আদায় হওয়া মাত্র সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুকেও ত্যাগ করে এবং শয়তানি স্বার্থ বা ক্ষমতা লাভের আশায় তারা অন্য পথে অগ্রসর হয়।
মহানবীর বক্তব্য অনুযায়ী মানুষের সম্মান রয়েছে কেবল মহান আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যেই। পাপ বর্জন করা ছাড়া সম্মান অর্জন করা সম্ভব নয়।
আমরা যদি মহান আল্লাহর আযিয নামের রঙে রঞ্জিত হতে চাই তাহলে মহানবীর হাদিস অনুযায়ী আন্তরিক চিত্তে আল্লাহর দাসত্ব করতে হবে আমাদেরকে। আর এ জন্য দরকার ঈমান ও সৎকর্ম এবং পাপ-বর্জন। পবিত্র কথা ও উপযুক্ত কাজ মহান আল্লাহর নৈকট্য এনে দেয়। যারা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সম্মান অর্জনে সচেষ্ট তারা আল্লাহর শাস্তি পাবে ও তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে। ইসলামের যথাযথ বা সঠিক বিশ্বাস ও আল্লাহর প্রকৃত বা আন্তরিক দাসত্ব করা ছাড়া প্রকৃত সম্মান অর্জন সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ যেন আমাদের অন্তরকে আল্লাহ ও তার প্রিয় বিষয় ছাড়া অন্য সব কিছু থেকে পবিত্র রাখেন এবং আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিদের বন্ধু হওয়ার সুযোগ দেন। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।