ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৫৭): খায়বার অভিযান
আমরা আগেও বলেছি, ইরাকের গোলন্দাজ ইউনিট ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তৎকালীন দুই পরাশক্তি নিয়মিত বাগদাদকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করে যাচ্ছিল বলে এই দিক দিয়ে দেশটির শক্তি আরো বেড়ে যায়।
যখনই ইরাকি বাহিনী কোনো রণাঙ্গনে ইরানের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হতো, পরাশক্তিগুলো তাৎক্ষণিকভাবে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করে ইরাকের সে ক্ষতি পুষিয়ে দিত। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের পক্ষে পদাতিক বাহিনীর সৈন্যদের জন্য অতি সাধারণ মানের আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করাই দুরূহ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ইরানের শক্তিশালী দিক ছিল এদেশের বিপুল পরিমাণ সাহসী ও স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধা এবং রাত্রিকালীন যুদ্ধে ইরানের পারদর্শিতা। ইরাকি বাহিনী আগ্রাসন চালানোর পর সারাদেশে দলে দলে তরুণ ও যুবকের দল যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য নাম লেখাতে সেনা পোস্টগুলোতে ধরনা দিতে শুরু করে।
ফলে প্রধানত লোকবলের ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে ইরানের সেনা কমান্ডাররা পরবর্তী অভিযান পরিচালনা করার জন্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় হোর অঞ্চল বেছে নেন। সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় সমান উচ্চতায় অবস্থিত এই অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর জলাশয়। এসব জলাশয়ের বেশিরভাগ নলখাগড়া ও এ জাতীয় উদ্ভিদ ও লতাগুল্মে পরিপূর্ণ এবং এসব জলাশয়ের বেশিরভাগ অনাবাদী ভূমি। এসব জলাশয়ের ভেতর দিয়ে মানুষের যাতায়াত ছিল না বললেই চলে। কাজেই এই অঞ্চল দিয়ে ইরানি যোদ্ধারা ইরাকি সেনাদের ওপর হামলা চালাতে পারে- এমন ধারনা বাগদাদ কখনোই করেনি। এখানকার সীমান্তের ওপারেই দু’দেশের যৌথ জলাশয়ের মাঝখানে ছিল ইরাকের ‘উত্তর মাজনুন’ ও ‘দক্ষিণ মাজনুন’ নামের দু’টি তেলসমৃদ্ধ দ্বীপ। ইরানি কমান্ডাররা এই দু’টি দ্বীপ দখল করে ইরাকের বসরা ও আল-আম্মারা শহরের মধ্যবর্তী মহাসড়কের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরিকল্পনা করেন।
সে সময়ে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সমাপ্তি টানার জন্য তেহরানের সামনে দু’টি মৌলিক পরিকল্পনা ছিল। প্রথম পরিকল্পনা ছিল সাদ্দাম সরকারের পতন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় পরিকল্পনা ছিল বসরার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে আলোচনার টেবিলে বসে যুদ্ধের ইতি টানা। বসরা দখল করতে পারলে ইরাকের আগ্রাসনের ফলে যে ক্ষতি হয়েছিল তা যেমন পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হতো তেমনি আলোচনার টেবিলে বসরার ‘ট্রাম্পকার্ড’ ব্যবহার করে ইরাক সরকারকে আগ্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হতো।
ইরানের তৎকালীন পার্লামেন্ট স্পিকার ও যুদ্ধের কর্মকৌশল প্রণয়নের অন্যতম নীতিনির্ধারক আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি এ সময় ইরানের সেনা কমান্ডারদের উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে বলেন, যদি ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান চালিয়ে এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ শহর বা অঞ্চল দখল করা যায় যা ব্যবহার করে আমরা ইরাকের কাছ থেকে আমাদের অধিকার আদায় করে নিতে পারি, তাহলে সে অভিযান চালাতে হবে।

তিনি ইরানি সেনা কমান্ডারদের আরো বলেন, আপনারা যদি এই অভিযানে সফল হন এবং বসরা-আম্মারা মহাসড়ক দখল করতে পারেন তাহলে আমরা যুদ্ধ সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে পারব। আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির এ বক্তব্যে ইরানের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয় এবং এর সূত্র ধরে হোর অঞ্চলে ‘খায়বার’ নামক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়।
রামেজান অভিযানের পর খায়বার ছিল ইরানের পক্ষ থেকে চালানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান। ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় খুজিস্তান প্রদেশ এবং ইরাকের বসরা শহরের উত্তর ও পূর্ব অংশে এই অভিযান চালানো হয়। ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অভিযানটি শুরু হয়। অভিযানে ইরানের ২০০ কমব্যাট ব্যাটেলিয়ন ও প্রায় ৫০০ গানবোট অংশ নেয়।
এই অভিযানের পরিকল্পনায় ৮০টি হেলিকপ্টারে করে ফ্রন্টে ছত্রীসেনা নামিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে ২৩টি হেলিকপ্টার কাজে লাগানো হয়। ইরাকি বাহিনীকে হতভম্ভ করে দিয়ে অভিযানটি পরিচালনা করার জন্য ইমাম খোমেনী (রহ.), প্রেসিডেন্ট ও শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সেনা কমান্ডার ছাড়া আর কাউকে আগে থেকে এই অভিযানের কথা জানানো হয়নি।
খায়বার অভিযানটি ছিল এর আগে চালানো অভিযানগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অভিযান শুরুর দুই মাস আগে থেকে আইআরজিসি’র সেনা ইউনিটগুলো জলাশয়ে বোট চালানোর প্রশিক্ষণ নিতে নেমে যায়। প্রতিটি ইউনিট ৫০ থেকে ১০০টি বোট সঙ্গে নিয়ে এই প্রশিক্ষণ চালাতে থাকে। সেইসঙ্গে ইরানের বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনীর পাইলটরা খুজিস্তান প্রদেশর ‘গাভখুনি’ জলাশয়ে রাতের বেলা উড্ডয়নের কসরত করতে শুরু করেন।
ইরানের হেলিকপ্টারগুলোর সমস্যা ছিল এই যে, এগুলো নাইট ভিশন ক্যামেরায় সজ্জিত ছিল না। ফলে পাইলটদেরকে রাতের বেলা বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে রাত্রিকালীন অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে হচ্ছিল।
এদিকে শুরু থেকেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে ইরাকি বাহিনী গোটা সীমান্ত জুড়ে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র মোতায়েন করে ইরানের জন্য যুদ্ধ করাকে দুঃসাধ্য কাজে পরিণত করেছিল। এ কারণে ইরান খায়বার অভিযান চালানোর জন্য জলাভূমিতে পূর্ণ একটি অঞ্চলকে বেছে নেয় যাতে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী তার গোলন্দাজ ও সাঁজোয়া ইউনিটগুলোকে সহজে সেখানে নিতে না পারে। ইরানি সেনা কমান্ডাররা নিজেদের পদাতিক বাহিনী দিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করার জন্য ‘হোরুল হোয়াইজা’ অঞ্চলকে বেছে নেন। ওদিকে ইরাকি বাহিনী খায়বার অভিযানের আগে জার্মানীর কাছ থেকে মাস্টার্ড গ্যাসের মতো কিছু ভয়ানক রাসায়নিক গ্যাস সংগ্রহ করেছিল। তারা এই অভিযানের শুরুতে ইরানের বিরুদ্ধে এই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে।
ইরাকের বসরা-আলআম্মারা মহাসড়ক দখল করে ইরাকি সেনাবাহিনীর তৃতীয় ও চতুর্থ ডিভিশনের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলা, দজলা নদীর পশ্চিম তীরে ইরানি যোদ্ধাদের মোতায়েন করা এবং ইরাকের বসরা প্রদেশে যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট খোলা ছিল খায়বার অভিযানের উদ্দেশ্য। পাশাপাশি ইরাকের তেলসমৃদ্ধ দুই দ্বীপ উত্তর মাজনুন ও দক্ষিণ মাজনুন দখল এবং দু’দেশের সীমান্তবর্তী বিশাল জলাশয় ‘হোরুল হোয়াইজার’ ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাকেও এ অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এসব লক্ষ্য অর্জিত হলে ইরাকের কাছ থেকে ইরানের দাবিগুলো আদায় করে অচিরেই যুদ্ধের সমাপ্তি টানা সম্ভব হতো।
যুদ্ধের সূচনাকারী হিসেবে ইরাকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার লক্ষ্যে তেলসমৃদ্ধ উত্তর ও দক্ষিণ মাজনুন দ্বীপ দখলের পরিকল্পনা করা হয়। খায়বার অভিযানের জন্য যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তার আয়তন ছিল এক হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটার। আর এই ভূখণ্ডের বেশিরভাগ জুড়ে ছিল নলখাগড়ায় ভরা জলাশয়। এই জলাশয়ের ইরাক অংশে ছিল ১৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দুই মাজনুন দ্বীপ। এই দুই দ্বীপে ৫০টি তেলকূপ ছিল। তেল উত্তোলন ও সরবরাহের স্বার্থে জলাশয়ের মধ্যে বাধ দিয়ে কৃত্রিমভাবে দ্বীপ দু’টি সৃষ্টি করেছিল ইরাক সরকার। #
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।