সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-৮)
মা হলেন সন্তানের প্রথম শিক্ষক। ইমাম খোমেনী (র) মাতৃত্বকে সবচেয়ে ভদ্র বা সভ্রান্ত পেশা বলে মনে করতেন এবং তিনি মায়ের কোলকে সবচেয়ে বড় স্কুল বলে উল্লেখ করতেন।
তিনি বলেছেন: 'সন্তানের শিক্ষা শুরু হয় মায়ের কোল থেকেই। মায়েদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সন্তানদেরকে সর্বোত্তম সুশিক্ষা দেয়া। বিশ্বের সবচেয়ে সভ্রান্ত ও অভিজাত পেশা হল সন্তানকে বড় করে তোলা ও তাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে সমাজের কাছে উপহার দেয়া।' সন্তানের সুশিক্ষার ক্ষেত্রে মায়ের প্রধান ও মৌলিক ভূমিকার কারণে ইসলাম সন্তানের প্রশিক্ষণ ও অধিকারের ক্ষেত্রে মায়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সন্তানের জন্য মায়ের স্নেহের চেয়ে বেশি প্রভাব রাখার মত কিছুই নেই। সন্তানের শিক্ষণে মায়ের ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। মায়ের আদর শিশুদের প্রধান মানসিক খাদ্য। সন্তানের স্নেহ-মমতা যোগাতে মায়ের চেয়ে স্নেহ-মমতার আর কোনো বড় উৎস নেই। মায়েদের এই দক্ষতা ও যোগ্যতা যথাযথভাবে কাজে লাগানো হলে তা পরিবারের বন্ধন সুদৃঢ় করার পাশাপাশি সন্তানদের সামাজিক সম্পর্ক গড়ার যোগ্যতা তৈরিতেও গঠনমূলক প্রভাব রাখবে।
কন্যাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ক্ষেত্রে মায়েদের রয়েছে বিশেষ ও ফলদায়ক যোগ্যতা। সন্তানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা ও তাদেরকে ব্যক্তিত্ব আর সম্মান সম্পর্কে সচেতন করার মত গুণগুলো বিকাশেও বিচক্ষণ ও দক্ষ মায়েদের ভূমিকাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃস্নেহ প্রশিক্ষণের চড়াই-উৎরাইগুলোকে সহজ করে দেয়। সন্তানদের অনুভূতিকে কোমল করতে বিশেষ করে ছেলে সন্তানের মনকে কোমল করতেও মায়ের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কখনও কখনও ছেলে সন্তানদের দুরন্তপনা ও সহিংস আচরণ মায়েদের প্রশান্ত ও সহজ কয়েকটি কথার প্রভাবেই প্রশান্ত হয়ে যায়। মায়েরা বেশি স্নেহ-প্রবণ হন বলে সন্তানদের অভিযোগ ও সমস্যার দিকে তারাই বেশি লক্ষ্য রাখেন এবং সংসারে তারা সন্তানদের কাছে গোপনীয় কথা সংরক্ষণের ব্যাপারে বেশি বিশ্বস্ত । বিশেষ করে কন্যাদের জন্য মায়েরা হন আদর্শ ও দিক-নির্দেশক। অবশ্য এক্ষেত্রে সাফল্যের শর্ত হল কন্যাদের সঙ্গে স্নেহময় সম্পর্ক গড়তে সক্ষম হওয়া।

শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করানো তার মধ্যে মায়ের গুণ বিকাশে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখে। সন্তানের জন্য মায়ের দুধের চেয়ে ভালো, পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্য-সম্মত আর কোনো খাবার নেই। যেসব সন্তান মায়ের দুধ পান করে তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার কৃত্রিম দুধ পানকারী শিশুদের তুলনায় ছয় গুণ কম বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে দেখা গেছে। মায়ের দুধ পুরোপুরি প্রাকৃতিক বলে কৃত্রিম কোনো উপায়ে তা তৈরি করা সম্ভব নয়।
আসলে শিশুর সুন্দর দেহ ও মন গড়ে তুলতে মায়ের দুধের বিকল্প নেই। আধুনিক বিজ্ঞানও এখন বলে মায়ের দুধে খাদ্যের উপাদানগুলো ছাড়াও রয়েছে এমন কিছু বিশেষ উপাদান যা নানা ধরনের জৈব-রাসায়নিক শক্তি যোগায় এবং নানা ধরনের জীবাণুর মোকাবেলায় প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। শিশুর শারীরিক বিকাশেও মায়ের দুধের রয়েছে সবচেয়ে কার্যকর কিছু উপাদান।
গবেষণায় দেখা গেছে যেসব নবজাতক মায়ের দুধ পান করে তারা জীবনের প্রথম কয়েক মাসে অন্যদের তুলনায় খুব কম ফুসফুসের ও আন্ত্রিক সমস্যায় ভুগে। কোনো কোনো গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব শিশু মায়ের দুধ পান করে তারা দীর্ঘ-মেয়াদি নানা কল্যাণের অধিকারী হয়। যেমন, তারা অন্যদের তুলনায় বেশি বুদ্ধির অধিকারী হয় এবং তাদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার ও অ্যাজমা ও এক্সিমার আশঙ্কা কম থাকে।
মা যখন শিশুকে বুকের দুধ পান করান তখন তিনি স্নেহ ও ভালবাসাও পৌঁছে দেন সন্তানের কাছে। সন্তানকে বুকের দুধ পান করানোর সময় মা যদি কুরআন তিলাওয়াত করেন বা কোনো দোয়া পড়েন ও জিক্র্-এ মশগুল থাকেন তাহলে সেই সন্তান ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও বেশি অগ্রসর হবে। এভাবে শিশুর ভবিষ্যৎ আধ্যাত্মিক উন্নতি ও খোদামুখী চেতনার পথও প্রশস্ত হয়। এ ধরনের শিশু অন্য শিশুদের তুলনায় ভবিষ্যতে বেশি খোদাভীরু ও পরহিযগার হবে-এটাই স্বাভাবিক।
মায়ের বুকের দুধ পান শিশুর স্বাভাবিক ও অত্যন্ত জরুরি অধিকার। পবিত্র কুরআনে সুরা বাকারার ২৩৩ নম্বর আয়াত অনুযায়ী শিশুকে পরিপূর্ণ দুই বছর বুকের দুধ পান করানো মায়ের দায়িত্ব। এ সময় যদি শিশুর বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাও দেখা দেয় তাহলেও সন্তানের দেখাশোনার অধিকার ও তার অভিভাবকত্ব একমাত্র মায়ের জন্যই নির্ধারিত। যেহেতু এ সময়ে শিশুর মাতৃদুগ্ধ ও মাতৃস্নেহ দুইই জরুরি তাই পিতার অভিভাবকত্বের অধিকার থাকা সত্ত্বেও তাই এ অধিকার মায়ের ওপর ন্যস্ত হয়েছে এবং মা শিশুকে দুধ পান করানোর জন্য বাবার কাছ থেকে খরচ পাওয়ারও অধিকার রাখেন। মায়ের যে সন্তান-বাৎসল্য বা সন্তানের প্রতি মমত্ববোধ সে বিষয়টিকেও এখানে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ যে মা তার নবজাতক শিশুকে কোলে রেখে বড় করছেন তিনি শিশুকে ওই অসহায় অবস্থায় হাতছাড়া করতে চান না স্নেহের টানেই! তাই মাতৃদুগ্ধ পান যেমন শিশুর অধিকার তেমনি মায়ের অধিকার রক্ষাও বাবার দায়িত্ব।
মহানবী (সা) বলেছেন, কোনো দুধই শিশুর জন্য মায়ের দুধের চেয়ে উত্তম নয়। মহানবীর হাদিসে বলা হয়েছে, যে মা কোনো শিশুকে দুধ পান করাবে যতবারই শিশু তার বুকের দুধ পান করবে ততবারই মহান আল্লাহ সেই মাকে একজন দাস মুক্ত করার সাওয়াব দান করবেন। মা তার শিশুকে দুই বছর পর্যন্ত দুধ পান করানো সম্পন্ন করায় তার অতীতের সব গোনাহ মাফ হয়ে যায়। ইসলাম ধর্মে শিশুকে মায়ের দুধ পান করানোর ওপর এত বেশি গুরুত্ব দেয়ার কারণ কেবল দুধ পান করানোর বিষয়টাই নয়, একইসঙ্গে শিশুর প্রতি মাতৃস্নেহের বন্ধনও এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশু যখন মায়ের কোলে বা পাশে থাকে তখন মায়ের হৃদপিণ্ডের স্পন্দনের শব্দই শিশুকে প্রশান্ত রাখে এবং এ বিষয়টি শিশুর মানসিক অবস্থার জন্য খুবই জরুরি। মায়ের স্নেহে ও মাতৃস্তন্য পানে বড় হওয়া শিশু উত্তরকালে অন্যদের চেয়ে বেশি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়। অন্যদিকে মায়ের দুধ নানা ধরনের মারাত্মক রোগের মোকাবেলায় শিশুকে রক্ষা করে।
শিশুকে বুকের দুধ পান করানোর সময় মা বিশেষ আনন্দ পান এবং এর ফলে মা বিবেকের কাছে আর দায়বদ্ধতা অনুভব করেন না। এ সময় মা ও শিশুর মধ্যে যেন ভালবাসা আর কৃতজ্ঞতার বিনিময় হতে থাকে। শিশুর শরীরের জন্য যা যা দরকার তার সবই মহান আল্লাহ মায়ের দুধে দিয়েছেন। এ দুধ সব ধরনের বিপদ ও ঘাটতি থেকে মুক্ত এবং নজিরবিহীন। পরিপূর্ণ এ খাদ্যে রয়েছে প্রোটিন, চর্বি, নানা ধরনের ভিটামিন ও লবণ। এর তাপমাত্রাও শিশুর শরীরের উপযোগী এবং তা শিশুর ক্রোধ দূর করে। শিশু যে নয় মাস মায়ের গর্ভে ছিল সেই নয় মাস সে মায়ের হৃদপিণ্ডের শব্দের সঙ্গে পরিচিত থাকায় মায়ের দুধ পানের সময় ওই একই শব্দ শুনে সে খুব দ্রুত প্রশান্ত হয়ে পড়ে। শিশুর জন্য এই শব্দ সবচেয়ে প্রশান্তময় সঙ্গীত।
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।