সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-২০)
শিশুদের প্রকৃতি খুবই কোমল ও অপছন্দনীয় নানা স্বভাব থেকে মুক্ত। কোমলমতি শিশুদের আত্মা পবিত্র থাকে বলে সেখানে ধর্ম ও ধর্মীয় চিন্তাধারার বিকাশ ঘটানো বড়দের তুলনায় সহজ হয়।
অন্য কথায় শিশু কিশোরদের মনটা এমনই যে শৈশব ও কৈশোরে তাদের যা শেখানো হয় সেটাই পরবর্তীতে সারা জীবনের জন্য শক্ত ভিত বা গাঁথুনির কাজ করে। তাই এ সময়েই তাদেরকে করতে হবে নৈতিক, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সুশিক্ষাগুলোয় প্রশিক্ষিত। জীবনের সঠিক পথে চলার দিশা দেয়ার জন্য শৈশব ও কৈশোরই হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এ সময় তাদের মধ্যে অনুকরণ ও মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা খুব বেশি থাকে। তাই বাবা-মায়ের উচিত তার শিশু ও কিশোর সন্তানদের জন্য সুস্থ ও পবিত্র পরিবেশ গড়ে তোলা। তাদের জন্য গড়ে তুলতে হবে এমন পরিবেশ যেখানে থাকবে দয়া, মায়া ও ধৈর্যসহ পছন্দনীয় নানা গুণ। আসলে শিশু-কিশোরদের প্রতিপালন মানে কেবলই তাদের খাবার, পোশাক ও স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নয়, তাদের মধ্যে সৃষ্টিশীলতাসহ নানা ধরনের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো ও তাদের জন্য পছন্দনীয় নানা গুণ অর্জনের পথ খুলে দেয়াও জরুরি। আর এসব লক্ষ্য অর্জনে বাবা-মা ও অভিভাবক এবং শিক্ষকদের উচিত শিশু-কিশোরদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্নশীল হওয়া ও একই লক্ষ্যে পর্যাপ্ত মাত্রায় সময় দেয়া।
শিশু কিশোরদেরকে ধৈর্য ও ত্যাগের মনোভাব শেখানো খুবই জরুরি। সামাজিক অঙ্গনে তাদেরকে টিকে থাকতে হলে ইসলামের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষায় হতে হবে প্রশিক্ষিত ও অভ্যস্ত। ধৈর্য শিশু-কিশোরদেরকে অপেক্ষাকৃত বেশি প্রশান্ত ও দয়ালু করে তোলে। পবিত্র কুরআনে ধৈর্য শব্দটি ৭২ বার এসেছে। ধৈর্য মানুষের ব্যক্তিত্বকে এবং আত্মা ও সুপ্রবৃত্তিগুলোকে শক্তিশালী করে যা মুমিন হওয়ার জন্য জরুরি ও অপরিহার্য। নানা বিপদ ও প্রতিকূলতার মোকাবেলায় ধৈর্য মানুষকে সংগ্রামের ও দৃঢ়তার শক্তি যোগায়। সংযম ও খোদা-সচেতনতা মুমিনের বৈশিষ্ট্য। শিশু-কিশোররা জন্ম থেকেই ধৈর্যশীল হয় না, বরং তাদেরকে ধৈর্য ধরার প্রশিক্ষণ দিতে হয় ।
ধৈর্যশীলতার নানা কৌশল রপ্ত করতে পারলে জীবনে তারা বেশি সুস্থ থাকবে ও অধৈর্যশীলদের তুলনায় বেশি আনন্দ উপভোগ করবে। শিশু-কিশোরদের জীবন যে খুব মসৃণ ও ঝামেলাহীন তা নয়। বেশিরভাগ শিশুই স্কুল ও অভিভাবকদের পক্ষ থেকে মানসিক চাপের মধ্যে থাকে। শিক্ষকের দেয়া বাড়ির কাজ ও পরীক্ষার পড়া দ্রুত সম্পন্ন করা নিয়ে তারা দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকে। অনেক বাবা মা তার শিশু বা কিশোর সন্তানকে এটা বুঝিয়ে দেন যে- তোমাকে অন্য সবার চেয়ে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করতে হবে! কিংবা অতি উচ্চ প্রত্যাশা নিয়ে বলেন: তোমার সমবয়সী বা একই ক্লাসের অমুককে দেখেছ কত ভালো ফল করেছে! ফলে বাবা-মা ও স্কুল-শিক্ষকের প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতার আশঙ্কা নিয়ে এক ধরনের আতঙ্কে থাকে অনেক শিশু-কিশোর। এ জাতীয় নানা ধরনের চাপ বা বকা খাওয়ার আশঙ্কার মুখে অনেক সময় শিশু-কিশোররা অদ্ভুত ও অপরিণামদর্শী আচরণ করে বসে। তাই শিশু-কিশোরদেরকে ধৈর্যের প্রশিক্ষণ ও টেনশন নিয়ন্ত্রণের তালিম দেয়া খুবই জরুরি। শিশু-কিশোরদের খুব কম বয়সে স্কুলে পাঠানো যেমন ঠিক নয় আবার দেরিতে পাঠানোও ঠিক নয়। যথাসময়ে শিশুরা পড়াশুনা শুরু করলে তা সবার জন্যই হয় বেশি সহজ।
বিখ্যাত মার্কিন লেখক ও ইতিহাসবিদ উইল ডুরান্ট লিখেছেন: 'যদি সন্তানদের কাছ থেকে আদব ও শিষ্টাচার পেতে চাও তাহলে আগে নিজেকেই সুশীল ও সভ্য হতে হবে। সন্তানদের কাছ থেকে যদি পবিত্রতা ও সততা আশা কর তাহলে আগে নিজেকেই সৎ হতে হবে। অভিভাবকরা রাগের মুখে কড়া ও কর্কশ কথা বললে তা সন্তানদের স্মৃতিতে গেঁথে যায়। সন্তানরা সব কিছু যথাযথভাবে সম্পন্ন করবে বলে আশা করলে তার আগে নিজেরও তেমনই হওয়া উচিত।'
শিশু কিশোররা বড়দেরই অনুসরণ করে থাকে। অপছন্দনীয় যে কোনো পরিস্থিতিতে বাবা-মা যদি শিশুদের সামনেই ধৈর্যহীন হয়ে থাকেন তাহলে সেরকম পরিস্থিতিতে শিশু-কিশোররাও অনুরূপ আচরণ করবে। তাই শিশুদের ধৈর্য শেখানোর আগে বাবা-মাকেই এ বিষয়ে অগ্রণী হতে হবে।
শিশুদের মারমুখী ও অধৈর্যশীল আচরণের মুখেও বাবা-মা যদি শান্ত আচরণ করেন তাহলে তারা এ আচরণ থেকে ধৈর্যেরই শিক্ষা পাবে। চাইলেই যে সব কিছু প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্জন করা যায় না তা নানা ঘটনার মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের শেখাতে হয়। শিশু-কিশোররা কোনো কিছু পাওয়ার জন্য বা যা খুশি তা পাওয়ার জন্য বায়না ধরলেই তা তাদের দেয়া ঠিক নয় সব সময়। কখনও কোনো কোনো আবদার দেরিতে পূরণ করা উচিত। আপনি যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত তখন আপনার শিশু সন্তান যদি বলে: বাবা আমার খেলনার ব্যাটারিটা এখনই বদলে দাও-এক্ষেত্রে তাকে শান্তভাবে বোঝাবেন যে, দশ মিনিট অপেক্ষা কর, আগে আমাকে আমার এই জরুরি কাজটা শেষ করতে দাও। -এই তো একটু পরেই বা শিগগিরই বা এখনই ঠিক করে দিব – সময় সংক্রান্ত এমনসব কথার মধ্যে অনেক সময় শিশুরা কোনো পার্থক্য দেখতে পায় না। তাই তাকে ঘড়ির মাধ্যমে সময় সম্পর্কে যথাযথ ধারণা দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের ধৈর্য শেখানোর জন্য ফুল ও লতা-পাতা জাতীয় গাছ রোপণের কাজও দেয়া যেতে পারে যাতে তারা বুঝতে পারে যে অনেক ধৈর্য ধরে গাছপালার যত্ন নিতে হয়।
শব্দ দিয়ে অসমাপ্ত বাক্যের শূন্য স্থান পূরণের খেলাও ধৈর্য বাড়ানোর বা অপেক্ষার নীতি শেখানোর সহায়ক। শিশু কিশোরদের এটা বোঝাতে হবে যে তাড়াহুড়ো করে কিছু চাইলেই তা অর্জন করা যায় না। গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শিশু-কিশোর ধৈর্যশীল তারা পরীক্ষায় বেশি নম্বর পায়। যেসব শিশু কিশোর কম বয়সেই নৈতিক আচার-আচরণ সংক্রান্ত ভালো গুণগুলো রপ্ত করেছে তারা ভবিষ্যৎ জীবনে বেশি সুস্থ থাকে এবং অন্যদের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী ও অন্যদের চেয়ে তাদের সামাজিক সম্পর্কও বেশি শক্তিশালী হয়। এ ধরনের শিশু অন্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভালোভাবে টিকিয়ে রাখতে পারে এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনও বেশি সুখময় হয়।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/১৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।