হযরত ফাতিমা (সা.আ.)'র জন্মবার্ষিকী
হিজরি-পূর্ব আট সনের বিশে জমাদিউসসানি মানবজাতির জন্য এক অশেষ খুশির দিন। এ দিনে জন্ম নিয়েছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী এবং মহান আল্লাহ ও তাঁর অতি-ঘনিষ্ঠ শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা জাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা)।
বিশ্ব-ইতিহাসের সবচেয় বিপ্লবী নারী ও বেহেশতি নারীকুলের সম্রাজ্ঞী ফাতিমা (সা.আ.)'র পবিত্র জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি প্রাণঢালা মুবারক-বাদ। তাঁর ওপর, তাঁর পিতা এবং তাঁর পবিত্র বংশধরদের ওপর বর্ষিত হোক অনন্তকাল ধরে অসংখ্য সালাম আর দরুদ।
বিশ্বনবী (সা.) ও উম্মুল মু’মিনিন হযরত খাদিজা (সালামুল্লাহি আলাইহা)'র মাধ্যমে প্রশিক্ষিত হয়ে জ্ঞান আর মহত্ত্বের শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে উন্নীত হন এই মহীয়সী নারী। মানব জাতির সর্বকালের সেরা মহামানব তথা বিশ্বনবী (সা.)'র ওপর মুশরিকদের চাপিয়ে দেয়া নানা কষ্ট আর যন্ত্রণা লাঘবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন হযরত ফাতিমা (সা.আ.)। বাবার সেবায় জননীসুলভ অনন্য ভূমিকা রাখার জন্য তাকে বলা হত উম্মে আবিহা বা পিতার মা। বিশ্বনবী (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত ও বংশধারাও রক্ষিত হয়েছে এই মহামানবীর মাধ্যমে।
মহান আল্লাহর ইচ্ছায় হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে বা দ্বিতীয় হিজরিতে হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)'র সঙ্গে। আদর্শ কন্যা হিসেবে আলী (আ.)'র ঘরে এসে তিনি হন আদর্শ স্ত্রী ও মাতা। গড়ে তোলেন বেহেশতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হাসান, ইমাম হুসাইন (আ.) এবং জাইনাব (সা.আ.)'র মত মানব ইতিহাসের গৌরবময় অনন্য সম্পদ। বিয়ের দিন এক দরিদ্র নারী নবী-নন্দিনীর কাছে পোশাক সাহায্য হিসেবে চাইলে তিনি নিজের বিয়ের জন্য তৈরি নতুন পোশাকটি তাকে দান করে দেন। এর মাধ্যমে তিনি সর্বোত্তম ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করার ইসলামী শিক্ষাটি তুলে ধরেন ।
ফাতিমা (সা আ)র বিয়ের জন্য আলীর ঢালকে মোহরানা ধার্য করা হয়। এর মূল্য ছিল সর্বোচ্চ ৫০০ দিরহাম। অবশ্য ফাতিমা জাহরা বাবাকে অনুরোধ করেন যে, তার দেন-মোহরকে কিয়ামতের দিন রাসূেলর (সা) উম্মতের পাপী বান্দাহদের মুক্তির জন্য নির্ধারণ করা হোক। তাঁর এ আবেদন আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছে বলে ওহির ফেরেশতা জিবরাইল সুসংবাদ নিয়ে আসেন।
ফাতিমা জাহরা (সা.আ.) মুসলিম সমাজের বিচ্যুতি ঠেকানোর জন্য ও সত্যের জন্য সংগ্রামের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও আদর্শ দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। নারীমুক্তির আদর্শ হিসেবে এই মহামানবীর জন্মদিনটি ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পালিত হয় নারী ও মা দিবস হিসেবে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হযরত ফাতিমা (সা.) সম্পর্কে বলেছেন, ফাতিমা আমার দেহের অঙ্গ, চোখের জ্যোতি, অন্তরের ফল এবং আমার রূহস্বরূপ। সে হচ্ছে মানুষরূপী বেহেশতি হুর। প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ বুখারীতে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ফাতিমা আমার অংশ। যে কেউ তাকে অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো সে আমাকেই অসন্তুষ্ট ও ক্রোধান্বিত করলো। আবার হাদিসে এটাও বলা হয়েছে, যা কিছু ফাতিমাকে অসন্তুষ্ট করে তা সরাসরি আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট করে। হযরত ফাতিমা (সা.)'র উচ্চতর মর্যাদা উপলব্ধি করার জন্য কেবল এ হাদিসই যথেষ্ট।
হাদিসে এটাও এসেছে যে যা আল্লাহর রাসূল (সা.)কে অসন্তুষ্ট করে তা আল্লাহকেও অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ করে। বিশ্বনবী (সা.)'র আহলে বাইত (আ.)'র সদস্য হযরত ফাতিমা যে নিষ্পাপ ছিলেন তাও এসব বর্ণনা থেকে স্পষ্ট।
হযরত ফাতিমা জাহরা (সা.) ছিলেন নারী ও পুরুষ তথা গোটা মানব জাতির জন্য অসাধারণ ত্যাগ, বিশ্বস্ততা, অন্যায়ের ব্যাপারে আপোষহীনতা, সততা, দানশীলতা, ধৈর্য, চারিত্রিক পবিত্রতা, লজ্জাশীলতা ও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টিসহ অনেক মহৎ গুণের আদর্শ। আর এ জন্যেই তাঁর উপাধি ছিল আস-সিদ্দিক্বা বা সত্য-নিষ্ঠ, আল-মুবারাকাহ বা বরকত-প্রাপ্ত, আত-ত্বাহিরা বা পবিত্র, আল-মারজিয়া বা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, বাতুল বা শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে অতুলনীয় আদর্শ, আয যাকিয়া বা সতী, মুহাদ্দিসাহ বা হাদিসের বর্ণনাকারী, সাইয়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন বা নারীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, খাতুনে জান্নাত বা বেহেশতি নারীদের নেত্রী, আয জাহরা বা দ্যুতিময় ইত্যাদি।
হযরত ফাতিমা খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। মশক দিয়ে পানি উত্তোলনের ফলে তাঁর শরীরে দাগ পড়ে গিয়েছিল। তিনি যাঁতার মাধ্যমে এত পরিমাণ আটা তৈরি করতেন যে, তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। আর তিনি সেই আটা দিয়ে রুটি তৈরি করে মদীনার দরিদ্র ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করতেন। হযরত ফাতিমা কাপড়ে তালি লাগিয়ে সেই কাপড় পরিধান করতেন। পার্থিব কোন বস্তুই তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারত না। আর এজন্যই রাসূল (সা.) তাঁকে ‘বাতুল’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
রাসূল (সা) আলী (আ)-কে বলেন, ‘জান, কেনো আমার কন্যার নাম ফাতিমা রাখা হয়েছে? আলী (আ) আরজ করেন, বলুন, হে রাসূল (সা)! তিনি বলেন, এ জন্য যে সে এবং তাঁর অনুসারীদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ দেয়া হয়েছে।’
হযরত ফাতিমা যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতেন তখন তাঁর জ্যোতি আকাশের ফেরেশতা ও অন্যান্যদের দিকে ছড়িয়ে পড়ত। আর এ কারণে তাঁকে জাহরা উপাধি দেয়া হয়।
হযরত ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক যুগে যখন নারীর জন্মকে আরবরা কলঙ্ক বলে মনে করতো। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও নারীরা ছিল অবহেলিত ও উপেক্ষিত এবং এমনকি মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। আরবরা কেবল পুত্র সন্তানকেই নিজের বংশধর বলে বিবেচনা করত। বিশ্বনবী (সা.)'র কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় মক্কার মুশরিক আরবরা তাঁকে নির্বংশ বা আবতার বলে উপহাস করত। কিন্তু মহান আল্লাহ এসব উপহাসের জবাব দিয়েছেন সূরা কাওসারে। এ সূরায় হযরত ফাতিমা (সা. আ.)-কে কাওসার বা প্রাচুর্য বলে উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ এবং কাফেররাই নির্বংশ হবে বলে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বাস্তবেও হয়েছে তাই। এভাবে ফাতিমা (সা.) হয়েছেন নারীর মর্যাদার প্রতীক।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র ওফাতের পর খুব বেশি দিন বাঁচেন নি হযরত ফাতিমা (সা.)। পিতার আদর্শ তথা ইসলামের শিক্ষা ম্লান ও বিকৃত হয়ে পড়ার নানা অশুভ লক্ষণও তাঁকে গভীরভাবে ব্যথিত করে তুলেছিল। অনেকেই মনে করেন শত্রুতার প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমা (সা)-কে দাফন করা হয়েছিল গভীর রাতে গোপনীয়ভাবে অতি গোপন স্থানে যা আজো গোপন রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত গোপন থাকবে।
হযরত ফাতিমা (সা.)'র সান্নিধ্য ও সেবা না পেলে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)'র জীবনও পুরোপুরি বিকশিত ও পরিপূর্ণতা লাভ করতো না। তাঁরা ছিলেন একে-অপরের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। আলী (আ) না থাকলে ফাতিমা (সা)-কে বিয়ে করার যোগ্য আর কাউকে পাওয়া যেত না বলে ইসলামী বর্ণনা রয়েছে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) হযরত ফাতিমা (সাঃ)-কে মানুষের আকৃতিতে ফেরেশতা বলেও প্রশংসা করেছেন। তিনি বলতেন, আমি যখনই বেহেশতের সুবাস পেতে চাইতাম তখনই কন্যা ফাতেমার ঘ্রাণ নেই। রাসূল (সাঃ) একবার প্রাণপ্রিয় কন্যাকে বলেছিলেন, হে ফাতেমা! আল্লাহ তোমাকে নির্বাচিত করেছেন, তোমাকে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সজ্জিত করেছেন এবং তোমাকে বিশ্বের নারীকুলের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।
ফাতিমা সিদ্দিকা (সা. আ.) নিজের মৃত্যু কবে হবে এবং তাঁর দুই প্রিয় সন্তান হাসান ও হুসাইন (আ.) কিভাবে মারা যাবেন সেই তথ্যসহ ভবিষ্যৎ ইতিহাসের অনেক খবর রাখতেন। হুসাইন (আ.)'র হত্যাকারীদের অভিশাপ দিয়ে গেছেন তিনি। ফাদাক ও মানাজিল শীর্ষক তাঁর ভাষণ এই মহামানবীর অতুল জ্ঞান, খোদাভীরুতা এবং দূরদর্শিতাকেই তুলে ধরে।
রাসূল (সা.)'র মৃত্যুর পর পিতার বিয়োগ-ব্যথায় কাতর ফাতিমাকে(সা. আ.) সান্ত্বনা দিতে আসতেন স্বয়ং জিবরাইল (আ.)। 'মাসহাফই ফাতিমা' নামে খ্যাত গ্রন্থটির সমস্ত তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে জিবরাইল ফেরেশতার সঙ্গে ফাতিমা (সা. আ.)'র কথোপকথনের মাধ্যমে যা লিখে গেছেন হযরত আলী (আ.)। এভাবে ঐশী পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছেন বলেই নবী-নন্দিনীকে বলা হত মুহাদ্দিসা।
হযরত ফাতিমা এবং তাঁর সন্তানরা ক্ষুধার্ত থাকা অবস্থায় ক্ষুধার্ত আল্লাহর রাসূলকে অগ্রাধিকার দিতেন। অর্থাৎ নিজেদের খাবার তাঁরা রাসুলের জন্য উৎসর্গ করতেন। নিজেরা তিন দিন অভুক্ত থেকে দরিদ্রদের জন্য ইফতারির খাবার দান করায় হযরত ফাতিমা, হাসান, হুসাইন এবং আলী (আ)’র আত্মত্যাগের প্রশংসায় পবিত্র কুরআনের সুরা ইনসান বা দাহিরের ১৭ টি আয়াত নাজিল হয়েছে।
হযরত ইমাম হাসান মুজতাবা (আঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, একবার শুক্রবার রাতে দেখলাম মা ফাতিমা (সাঃ) এবাদতে মগ্ন। একটানা রুকু ও আর সেজদায় থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে উঠলো। আমি শুনতে পেলাম তিনি মুমিন নারী ও পুরুষের জন্য অনেক দোয়া করছেন, কিন্তু নিজের জন্য কোনো দোয়াই করলেন না। আমি প্রশ্ন করলাম, মা, আপনি কেন নিজের জন্য দোয়া করলেন না, যেভাবে অন্যরা দোয়া করে থাকে? তিনি জবাবে বললেন, হে আমার পুত্র! আগে প্রতিবেশীর কথা ভাবতে হবে, এরপর নিজের ঘরের কথা ... ।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগী করা ছাড়াও প্রায়ই রোজা রাখা ও গরীব-দুঃখীকে অসাধারণ মাত্রায় দান-খয়রাত করা ছিল হযরত ফাতিমা (সাঃ)'র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। হযরত ফাতিমা (সাঃ) বলেছেন, আল্লাহর সেবায় মশগুল হয়ে যে সন্তুষ্টি পাই তা আমাকে অন্য সব সন্তুষ্টি বা আনন্দ থেকে বিরত রাখে এবং সব সময় মহান আল্লাহর সুন্দর দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ রাখার প্রার্থনা ছাড়া আমার অন্য কোনো প্রত্যাশা নেই।
বিশ্বনবী (সা.) ও তাঁর পবিত্র বংশধর ও বিশেষ করে ফাতিমা (সা)’র প্রতি অশেষ দরুদ ও সালাম পাঠানোর পাশাপাশি সবাইকে আবারও মুবারকবাদ জানাচ্ছি আজকের এই আনন্দের দিনে। হযরত ফাতিমা জাহরা (সা. আ.)’র একটি বক্তব্য তুলে ধরে শেষ করবো আজকের এই আলোচনা। তিনি বলেছেন, নারীদের জন্য সর্বোত্তম বিষয় হচ্ছে, তারা যেন কোনো অচেনা পুরুষকে না দেখে এবং কোনো অচেনা পুরুষও তাদের না দেখে। #
রেডিও তেহরান/ আমির হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।