ঐতিহাসিক ঈদে গাদির: ইসলামী ঐক্য ও পরিপূর্ণতার প্রতীক
(last modified Wed, 29 Aug 2018 10:09:54 GMT )
আগস্ট ২৯, ২০১৮ ১৬:০৯ Asia/Dhaka

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম জাফর আস-সাদিক (আ.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, জুমা ( শুক্রবার), ঈদুল আযহা এবং ঈদুল ফিত্‌র ছাড়া মুসলমানদের আরও কোনো ঈদ বা উৎসবের দিন আছে কি ?  তিনি বললেন: হ্যাঁ, একটি ঈদ আছে যার মর্যাদা অন্য সব ঈদের চেয়েও বেশি।

প্রশ্ন করা হল: তাহলে তা কোন্ ঈদ? ইমাম বললেন,এটা হচ্ছে ঐ দিন যে দিন মহানবী (সা) হযরত আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ)-কে খিলাফতে অধিষ্ঠিত করেন এবং বলেন, আমি যার মওলা ও নেতা আলী তার মওলা ও নেতা (দ্র: মাফাতীহুল জিনান, পৃঃ ৫০২)।

এখন থেকে ১৪২৯ চন্দ্র-বছর আগে বিদায় হজের কয়েক দিন পর  বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) মহান আল্লাহর নির্দেশে আমিরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ) নিজের খলিফা বা প্রতিনিধি বলে ঘোষণা করেছিলেন। দিনটি ছিল ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ বা দশম হিজরির ১৮ জিলহজ।

বিদায় হজের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় ফেরার পথে গাদির-এ-খুম নামক স্থানে আল্লাহর নির্দেশে এক অভিষেক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হজরত আলীকে (আ) মুমিনদের নেতা বা মাওলা হিসেবে মনোনীত করেন। ওই ঐতিহাসিক ঘটনার ৮০ কিংবা ৮৪ দিন পর আল্লাহর রাসূল (সা.) আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। প্রিয়নবী (সা.) জীবনে মাত্র একবার হজ পালন করেছিলেন।

বিদায় হজ সমাপনের পর তিনি মদিনা অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন এহরামের পোশাক পরা অবস্থায়। সঙ্গে ছিল সোয়া লাখ সাহাবি। পথে ১৮ জিলহজ মদিনার নিকটবর্তী গাদির-এ-খুম নামক স্থানে উপস্থিত হলে পবিত্র কুরআনের শেষ আয়াতের আগের আয়াত নাজিল হয়।

সুরা মায়েদার ওই আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন: "হে রসূল,পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ দেখান না।" (সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াত)

আল্লাহর পক্ষ থেকে এই নির্দেশ নাজিল হওয়ার পর,রাসূলুল্লাহ (সা.) গাদির-এ-খুম নামক স্থানে আল্লাহর ওই ঘোষণাটি উম্মতকে জানিয়ে দেয়ার জন্য এক অভিষেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বারায়া ইবনে আজেব ও জায়েদ ইবনে আকরাম বর্ণনা করেন, ‘যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) গাদির-এ-খুম নামক এলাকায় এসে থামলেন, তখন সবাইকে একত্রিত করলেন, হজরত আলীর (আ) হাত ধরে উপরে তুললেন এবং জনতার উদ্দেশে বললেন, ‘তোমরা কি জান, আমি মুমিনদের নিজেদের প্রাণের চেয়েও বেশি আওলা (প্রিয়)?’ লোকেরা বললেন,‘হ্যাঁ ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)’। অতঃপর তিনি বললেন, হে আল্লাহ, আমি যার মাওলা এই আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ যে তাকে বন্ধু বানায় তুমিও তাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ কর, আর যে তার সঙ্গে শত্রু তা করে তুমিও তাকে শত্রু  হিসেবে গ্রহণ কর।

এরপর প্রভাবশালী সাহাবি ওমর ইবনে খাত্তাব হজরত আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, ‘ওহে আবু তালিবের সন্তান! প্রত্যেক মুমিন নর-নারীর মাওলা হিসেবে তুমি (রাত কাটিয়ে) সকাল করবে ও (দিন কাটিয়ে) সন্ধ্যা করবে। (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির, ৭ম খণ্ড, পৃঃ ৬১৬, ই.ফা.বা (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)। গাদির সংক্রান্ত এই হাদিসটি কমপক্ষে ১১০ জন সাহাবা, ৮৪ জন তাবেঈন, ২৫৫ জন ওলামা, ২৭ জন হাদিস সংগ্রাহক, ১৮ জন ধর্মতত্ত্ববিদ, ১১ জন ফিকাহবিদ, ইমাম ও ওলামার সূত্রে মুসনদে ইবনে হাম্বল, তিরমিযি, নাসাঈ, ইবনে মাযা,আবু দাউদ,তফসিরে কাশশাফ ইত্যাদি বিখ্যাত কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মোহাদ্দেস দেহলবীর ‘ইজালাতুল খাফা’ কিতাবও এ হাদিসের জন্য বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য।

পবিত্র কুরআনেও মহান আল্লাহ হজরত আলীকে (আ) মুমিনদের মাওলা হিসেবে ঘোষণা করছেন। যেমন সুরা মায়েদার ৫৫ নম্বর আয়াতে এসেছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের মাওলা (অভিভাবক), তাঁর রাসূল (সা.) তোমাদের মাওলা এবং যে ঈমান এনেছে, নামাজ কায়েম করে এবং জাকাত প্রদান করে রুকুকালীন অবস্থায়’। তফসিরকারকরা সবাই একমত যে,এই আয়াত হজরত আলীর (আ) শানে নাজিল হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সুরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে এসেছে,হে ঈমানদারগণ,তোমরা আল্লাহকে মান এবং রাসূলকে (সা.) মান এবং উলিল আমরকে মান। ‘উলিল আমর’ অর্থ এখানে আল্লাহ এবং রাসূল (সা.)-এর পক্ষ থেকে উম্মতকে পরিচালনা বা হুকুম প্রদানে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি। আল্লাহ এবং রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ মানা সব মুমিন নর-নারীর জন্য ফরজ।

আল্লাহর নির্দেশে রাসূল (সা.) গাদির-এ-খুম এলাকায় হজরত আলীকে(আ) ‘অসি’ তথা নিজের অবর্তমানে নিজের কাজ সমাধানের জন্য প্রতিনিধি বা  পবিত্র কুরআনের ভাষায় উম্মতের ‘উলিল আমর’ বা ‘মাওলা’রূপে নিযুক্তি দিয়ে যান। ইমাম ওয়াকেদির সূত্রে মহানবীর (সা) সাহাবি আবু সাঈদ খুদরি ও আবু হুরাইরার বর্ণনা-ভিত্তিক হাদিসে এসেছে, সূরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতটি হজরত আলী (আ)-এর শানে নাজিল হয়েছিল।

ইবনে কাসিরের বিদায়া ওয়ান নিহায়া বইয়ে বলা হয়েছে এভাবে হজরত আলীর (আ) প্রতিনিধিত্ব বা মওলাইয়্যাতের বাইয়াত শেষ হলে পবিত্র কুরআনের শেষ আয়াতটি নাজিল হয় যাতে বলা হয়েছে,‘আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীন থেকে নিরাশ হয়ে গেল, অতএব তাদের ভয় কর না। ভয় কর আমাকে আজ তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের দ্বীনের ওপর আমি রাজি হয়ে গেলাম। ’ এভাবে উম্মতে মুহাম্মদীর ধর্ম পরিপূর্ণ হওয়ার ঘোষণা এবং তাদের ওপর আল্লাহর নেয়ামত দান করার বিষয়টি সম্পূর্ণ হয়। তাই প্রিয়নবী (সা.) আল্লাহর দরবারে এ বলে প্রার্থনা করলেন,

'আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব দ্বীনকে কামেল করে দেয়ার ওপর এবং নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করে দেয়ার ওপর এবং আবু তালেব নন্দন আলীর বেলায়েতের জন্য সব প্রশংসা আল্লাহর।'

প্রিয়নবী (সা.) একদিন মসজিদে নববীতে সবার উদ্দেশে বললেন,‘নিশ্চয়ই এই ব্যক্তি হচ্ছে তোমাদের জন্য সিরাতুল মুস্তাকিম। সাহাবার বললেন,‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) ইনি কে’? প্রিয়নবী (সা.) বললেন ‘একটু অপেক্ষা কর’। এ সময় হজরত আলী (আ) রাসূল (সা.)-এর খেদমতে হাজির হলেন। প্রিয়নবী (সা.) আলীর কপালে চুমু খেয়ে লোকদের উদ্দেশে বললেন ‘ইন্না হাজা সিরাতি ’ অর্থাৎ নিশ্চয়ই সে আমার সিরাত বা পথ নির্দেশক। (সূত্র : দুররুল মনসুর,আল্লামা সিয়ুতি)।

প্রিয়নবী (সা.) হজরত আলীর শানে আরও বলেন,আমি জ্ঞানের নগর এবং আলী এই নগরের দরজা। বিশ্বনবী (সা) আরও বলেছেন,'আমি হলাম হিকমতের ঘর আর আলী হলেন তার দুয়ার। আমার পর আলী সব মুমিনদের অভিভাবক'।

উল্লেখ্য,গাদিরে খুমের ওই ঘটনার ২৫ বছর পর তৃতীয় খলিফা নিহত হলে মুসলমানদের ব্যাপক অনুরোধ ও পীড়াপীড়ির মুখে আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.) ১৮ই জিলহজ একান্ত অনীহা ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতা বা খলিফা হন। সামাজিক ন্যায়বিচার-ভিত্তিক আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফা হিসেবে প্রায় ৫ বছর শাসন করার পর এক ধর্মান্ধ খারেজির সন্ত্রাসী হামলায় আহত হয়ে একুশে রমজান তিনি শহীদ হন। হামলার সময় তিনি কুফার মসজিদে ফজরের নামাজ আদায় করছিলেন।

গাদির দিবসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হল ইমামত। আর এই ইমামাত ইসলামী শাসন-ব্যবস্থার আইন ও নীতি-নির্ধারক এবং নেতৃত্বদানকারীর ভূমিকা পালন করে।  গাদির দিবসে ইসলামী সমাজের জন্য এই ইমামত বা নেতৃত্বই নির্ধারণ করা হয়েছিল যা মেনে নেয়া ছিল সবার জন্যই ফরজ। গাদিরের ঘটনার পরই নাজিল হয়েছিল সুরা মায়েদার প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াত। যেমন,এ সুরার তৃতীয় আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, ‘যারা কাফির তারা আজ তোমাদের ধর্মের পথে বাধা সৃষ্টির ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে।’ –তাহলে এই দিনে কী এমন বিষয় ইসলামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যা শত্রুকে নিরাশ করেছে? ইসলামের ব্যাপারে কাফিরদের নিরাশ হওয়ার বিষয়টি নামাজ সম্পর্কে বলা হয়নি,জাকাত ও জিহাদ এবং এমনকি হজ সম্পর্কেও বলা হয়নি। বরং এখানে ইসলামী সমাজের নেতৃত্ব তথা ইমামতের দিকেই ইশারা করা হয়েছে। 

গাদিরের ঘটনা ছিল রাসূল-পরবর্তী মুসলিম সমাজে ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আইনি-ভিত্তি। আর এ থেকে বোঝা যায় বিশ্বনবীর (সা) পর ইসলামী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার মডেল হল ইমামত ও বেলায়াত বা অভিভাবকত্ব। রাজতান্ত্রিক,ব্যক্তিতান্ত্রিক ও অভিজাততন্ত্র-ভিত্তিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থাকে ইসলাম অনুমোদন দেয় না। 

ঈদে গাদির দিবসে শাসন-ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণের পাশাপাশি হযরত আলী (আ)-কে ইমামতের মডেল হিসেবেও তুলে ধরা হয়েছে। আর হযরত আলী (আ)’র আলোকোজ্জ্বল ও পবিত্র ব্যক্তিত্বকে বিন্দুমাত্রও বিকৃত করার সাধ্য কারো নেই। আলী (আ)’র নজিরবিহীন আধ্যাত্মিক নানা বৈশিষ্ট্য,গভীর ঈমান ও আন্তরিকতাকে পুরোপুরি বা ভালোভাবে উপলব্ধি করা খুবই কঠিন,কিন্তু এ মহাপুরুষের উচ্চতর মানবীয় গুণগুলোকে বোঝা ও অনুসরণ করা সম্ভব।

সাহসিকতা,দয়া,আত্মত্যাগ ও ক্ষমাশীলতা ছিল আলী (আ)’র কয়েকটি মানবীয় গুণ। মানুষের প্রিয় ও সম্মানসূচক সব গুণের সমাবেশ ঘটেছিল হযরত আলীর মধ্যে।  তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যাকে শিয়া ও সুন্নি সবাইই সম্মান করে এবং এমনকি কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না- এমন ব্যক্তিরাও  হযরত আলীর (আ) মহত গুণগুলোর বিষয়ে জানার পর বিনয়াবনত চিত্তে তাঁর প্রশংসা করতে বাধ্য হন।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মতে আমীরুল মু’মিনিন হযরত আলী (আ) ন্যায়বিচার, দুনিয়া-বিমুখতা, সর্বোত্তম পরিচালনা, দায়িত্ব পালনে দ্রুতগতি-সম্পন্ন হওয়া এবং সমাজকে খোদাভীতি ও ন্যায়বিচারের পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে ছিলেন নির্ভীক। এটা ঠিক যে আলী (আ)’র মত পরিপূর্ণ গুণগুলোর অধিকারী হওয়া অসম্ভব, কিন্তু সাধ্য ও ঈমান অনুযায়ী মানবতার এই উচ্চ-শিখরের  অনুসরণ করার চেষ্টা চালাতে হবে।

আসলে হযরত আলীর নানা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার পাশাপাশি তাঁর আদর্শকে জীবনের সব ক্ষেত্রে অনুসরণ করার মধ্যেই রয়েছে মুসলিম উম্মাহর সার্বিক মুক্তি ও সৌভাগ্যের দিশা। ঈদের গাদির পালন করা তখনই সার্থক হবে যখন আমরা জীবনের সব ক্ষেত্রে আলী (আ)-কে অনুসরণের মাধ্যমে বিশ্বনবীর (সা) আদর্শকেই অনুসরণ করতে পারব। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্বনবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের আদর্শ অনুসরণ করা ছাড়া প্রকৃত মুসলমান হওয়া ও মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব নয়। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/২৯

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ