পবিত্র হজের গুরুত্ব
(last modified Fri, 09 Aug 2019 12:14:01 GMT )
আগস্ট ০৯, ২০১৯ ১৮:১৪ Asia/Dhaka

পবিত্র হজ উপলক্ষে সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা ও মদিনায় সমবেত হয়েছেন লাখ লাখ মুসলমান, যারা আল্লাহর ঘর কাবাঘর দর্শনের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তাদের আশা পূরণ করায় এসব হাজিরা এখন আল্পুত ও অভিভূত। আসলে প্রত্যেক মুসলমানই পবিত্র হজ পালনের আকাঙ্খা হৃদয়ে লালন করেন। মুসলমানরা যে কাবাঘরের দিকে মুখ করে প্রতিদিন নামাজ আদায় করেন সেই ঘরকে সরাসরি সামনে রেখে আল্লাহতায়ালার কাছে নিজেকে সমর্পণ এবং নামাজ আদায়ের অনুভূতিই আলাদা।

আসলে হজে যাওয়ার মধ্যদিয়ে একজন মুসলমানের আজন্ম লালিত ইচ্ছা বাস্তব রূপ লাভ করে। তবে আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম পুরুষ ও নারীর ওপরই কেবল হজ ফরজ। হজ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আল ইমরানের ৯৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহতাআলা বলেছেন, ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেই সব মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে।’ ইসলামি পরিভাষায় হজ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে বিশেষ কিছু কর্ম সম্পাদন করা।

হজে গিয়ে একজন মুসলমানের মুখের অন্যতম ভাষা হয়ে দাঁড়ায় ‘লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক’ অর্থাৎ হে আল্লাহ আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি তোমার দরবারে হাজির। এভাবে একজন হাজি কাবা শরিফ তাওয়াফ, সাফা মারওয়া সাঈ এবং মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতের ময়দানে অবস্থানসহ অনান্য কার্যাদির মাধ্যমে হজ পালন করেন। সব মিলিয়ে হজ দুই অক্ষরের একটি ছোট শব্দ হলেও এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্ব-মুসলিমের পরম আবেগ-অনুভূতি ও ধর্মীয় বিশ্বাস। নাস্তিকতা ও অংশীবাদকে প্রত্যাখ্যান করে একত্ববাদের ঝান্ডা উড্ডীন রেখে আল্লাহর আরও নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে মুসলমানরা হজে যান। সেখানে তারা গোটা মুসলিম বিশ্ব বিশেষকরে সব মুসলমানের সম্মান-মর্যাদার কথা ভাবেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। মুসলমানেরা কেবল হজের নানা কার্যক্রমের বাহ্যিক দিকগুলো নিয়েই ভাবেন না, তারা এসবের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়েও চিন্তা করেন এবং সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব প্রত্যাশা করেন।

হজ একটি আদর্শ মুসলিম সমাজের প্রতীক। সব ধরনের বাহ্যিক ভেদাভেদ ভুলে মুসলমানরা এখানে সমবেত হন। এ সময় তারা পরস্পরের সুখ- দুঃখ, দুর্বলতা এবং সম্ভাবনার নানা দিক সম্পর্কে অবহিত হন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, আল্লাহর দেয়া প্রতিটি বিধানের মধ্যে রয়েছে ইহকালীন ও পারলৌকিক কল্যাণ। হজের বিধান দেয়া হয়েছে যাতে পূর্ব ও পশ্চিমের জনগণ আল্লাহর ঘরকে ঘিরে সমবেত হন এবং পরস্পরকে চিনতে পারেন। এছাড়াও আল্লাহ চান মুসলমানরা মহানবী (সা)'র নানা নিদর্শন ও বিষয় সম্পর্কে জানুক এবং এসব বিষয় মনে রাখুক। সামগ্রিকভাবে এই হজ হলো মানবীয় উন্নয়ন ও পূর্ণতায় পৌঁছার লক্ষ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের একটি সমৃদ্ধ অঙ্গন। এই অঙ্গন থেকে নিজেকে বিচিত্র ঐশী অলংকার দিয়ে সুসজ্জিত করে সেগুলোকে আপন দেশ এবং জাতির জন্যে উপহার হিসেবে নিয়ে যাবার সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে হজযাত্রীদের জন্যে।

আজ মুসলিম উম্মাহর জন্যে অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো এমন কিছু মানুষ যারা একনিষ্ঠ ঈমান ও আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেদের চিন্তা ও কাজকে পরিচালিত করে এবং যারা আত্মিক ও আধ্যাত্মিকতা চর্চার মাধ্যমে আত্মগঠন করার পাশাপাশি শত্রুদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এটাই বৃহৎ মুসলিম সমাজে দীর্ঘকাল ধরে বিদ্যমান বিচিত্র সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায়। চাই সেইসব সমস্যা ঈমানের দুর্বলতা থেকেই হয়ে থাকুক কিংবা শত্রুদের নিপীড়ন থেকেই হয়ে থাকুক। নিঃসন্দেহে বর্তমান যুগ মুসলমানদের পরিচয়, মুসলমানদের স্বরূপ খুঁজে পাওয়ার এবং ইসলামী জাগরণের যুগ। আজ বিচিত্র চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন মুসলিম দেশগুলোকে অবশ্যই এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে।

তবে এটাও সত্য, বর্তমান পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর ভরসা করে দৃঢ় ইমানের ভিত্তিতে স্থির সংকল্প ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাবার মাধ্যমে মুসলিম দেশ ও জাতিগুলো এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিজয় লাভ করতে পারে। এভাবে মুসলমান জাতি তাদের সম্মান ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে পারে। তবে যারা মুসলমানদের সম্মান-মর্যাদা, মুসলমানদের জাগরণকে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারে না, তারা তাদের সব শক্তি নিয়ে মাঠে এসেছে। তারা নিরাপত্তার সব সরঞ্জাম, মনস্তাত্ত্বিক, সামরিক, অর্থনৈতিক এবং প্রচারণাগত সব হাতিয়ার নিয়ে ময়দানে উপস্থিত হয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো মুসলমানদের নির্মূল করা এবং তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা। এমনকি মুসলমানদেরকে ব্যতিব্যস্ত রেখেও ইসলামের শত্রুরা তাদের স্বার্থ উদ্ধার করছে।  ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বর্তমান কঠিন পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে দু'টি উপায় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, পবিত্র হজের দু’টি বড় শিক্ষাও হচ্ছে এ দু’টি বিষয়। এগুলোপ হলো- এক. তৌহিদ বা একত্ববাদের ছায়াতলে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। দুই. শত্রুকে চেনা এবং তার চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা।

মুসলিম জাতি ও সংস্কৃতি গঠনে হযরত ইব্রাহিম (আ.), হযরত ইসমাঈল (আ.) ও বিবি হাজেরা (সা.আ.)'র অবদান অনস্বীকার্য। তাদের সংগ্রাম, তাদের কর্মতৎপরতা, তাদের অপরিসীম ত্যাগ ও কুরবানি গোটা মুসলিম জাতির জন্য আদর্শ। তাই হজের বিভিন্ন অনুষ্ঠান মূলত ইব্রাহিমী ঐতিহ্যের স্বারক। মুসলিম জাতির আদি পিতা ইব্রাহিমের সঙ্গে উম্মতে মুহাম্মাদীর সংযোগ স্থাপনের প্রতীকী মহড়া হজের অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানে সুদূর অতীত আর বর্তমান একাত্ম হয়ে যায়। একই ভাবে হজের সঙ্গে রয়েছে কুরবানি করার নিয়ম। এই কুরবানি শুধু নিছক পশু কুরবানিই নয়, এ হচ্ছে সত্যের জন্য, আল্লাহর জন্য, তার ধর্মের জন্য সবকিছু বিলিয়ে দেয়ার, সবকিছু কুরবানি করারই মহড়া। এর মাধ্যমে পরীক্ষা হয় বান্দা আল্লাহকে কতটা ভালবাসে, কতটা ভয় করে।

আমরা এর আগেও উল্লেখ করেছি যাদের আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য রয়েছে কেবল তাদের জন্যই হজ ফরজ করা হয়েছে। সাধারণত যারা আর্থিক ও শারীরিকভাবে বেশি সামর্থ্যবান তাদেরই নানা দিক থেকে বিচ্যুতির আশঙ্কা বেশি থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, ধনীরা যদি পরিশুদ্ধ মনের অধিকারী না হন তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রে অন্যায় ও অপকর্মের ক্ষেত্র তৈরি হয়। আর এ পরিস্থিতিতে সব মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হন। মনে রাখতে হবে, অর্থ-সম্পদসহ মানুষের সব কিছুই আল্লাহর দান। তা আর্থিক, জ্ঞানগত, মানসিক বা শারীরিক যাই হোক না কেন। আল্লাহ মানুষকে যা দিয়েছেন তার প্রত্যেকটির হিসাব দিতে হবে। এ কারণে হজ আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান মানুষের জন্য পরিশুদ্ধ হওয়ার একটি সুযোগ। পবিত্র হজ পালনের পর হাজিরা নিজেরা যেমন পরিশুদ্ধ হন তেমনি আপন পরিবার, সমাজ ও দেশে ফিরে অন্যদেরকেও পরিশুদ্ধ করার চেষ্টা করেন।  

যাদের হজে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে তারাসহ আমাদের সবার জন্যই এবারের হজ ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে-এ প্রত্যাশায় শেষ করছি আজকের আসর।  #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো.আবুসাঈদ/০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।