কেমন আছে সিরিয়ার ‘মরুর মুক্তা’ পালমিরা?
(last modified Wed, 21 Sep 2016 08:08:31 GMT )
সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৬ ১৪:০৮ Asia/Dhaka
  • পালমিরার থিয়েটার
    পালমিরার থিয়েটার

বেশ কয়েক মাস সন্ত্রাসীদের দখলে থাকার পর সিরিয়ার ‘মরুভূমির মুক্তা’ পালমিরা শহরে ফিরে এসেছে আবারও মুক্তির স্পন্দন ও স্বাধীনতার প্রাণ-প্রবাহ।

ওয়াহাবি-তাকফিরি গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএসআইএল-এর সন্ত্রাসীরা এখানকার ৪০০'রও বেশি স্থানীয় অধিবাসীকে করেছিল গণহত্যার শিকার। তাদের বেশিরভাগই ছিল নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। ঐতিহ্যবাহী এই প্রাচীন শহরের অনেক স্থাপনাই ধ্বংস করেছে বর্বর দায়েশ-সন্ত্রাসীরা।  সম্প্রতি এখানে দু'টি গণ-কবর আবিষ্কৃত হয়েছে।  একটি কবরে পাওয়া গেছে ৬৫ জনের লাশ। 
পালমিরায় যখন গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল বর্বর দায়েশ-সদস্যরা তখন জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফসহ বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সংস্থাই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। আর এখন এই সংস্থাগুলো পালমিরার প্রাচীন স্থাপনাগুলোর জন্য কেবল ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে।

পালমিরার প্রাচীন জনসমাবেশ কেন্দ্র ও বাজার 

পালমিরার প্রাচীন অ্যাম্ফিথিয়েটারকে গণহত্যার স্থান বা বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছিল দায়েশ সন্ত্রাসীরা।  তারা হত্যা করেছিল এই শহরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ ও শহরটির প্রাচীন স্থাপনাগুলোর সাবেক প্রধান খালেদ আল আসাদকে। দায়েশের সন্ত্রাসীরা পালমিরায়  দু-হাজার বছরের পুরনো কয়েকটি উপাসনালয় ধ্বংস করেছে। এ ছাড়াও তারা এখানে ‘নুসরাত’ নামের একটি প্রাচীন খিলান এবং টাওয়ার বা গম্বুজ-আকৃতির  কয়েকটি প্রাচীন কবরও ধ্বংস করে দেয়।  
সিরিয়ার ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার আগে দেশটির পর্যটন-শিল্প ছিল খুবই রমরমা। দেশটির জনশক্তির একটা বড় অংশ পর্যটন-শিল্প ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা শিল্পের তৎপরতায় জড়িত ছিল। যুদ্ধের আগে প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি পর্যটক পালমিরা ভ্রমণে আসতেন। কিন্তু গত কয়েক বছরের যুদ্ধের ফলে পর্যটন-শিল্প থেকে সিরিয়ার আয়ের পরিমাণ শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গেছে। এখন আর কোনো বিদেশী পর্যটকই সিরিয়া ভ্রমণে আসেন না। 

পালমিরার উদ্যান 

সিরিয়ার পালমিরা শহর ছাড়াও আরও অনেক শহরের বহু প্রাচীন ও ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসীদের হাতে। এই সন্ত্রাসীরা বেশ কয়েকবার বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র নাতনি ও ইমাম হুসাইন (আ)’র বোন হযরত জাইনাব (সা)’র পবিত্র মাজারে হামলা চালিয়েছে। ফলে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পবিত্র এ মাজার।এ ছাড়াও বিশ্বনবীর (সা) সম্মানিত সাহাবির মাজারসহ মুসলমানদের কাছে সম্মানিত অনেক স্থাপনা ধ্বংস করে দিয়েছে তাকফিরি সন্ত্রাসীরা। তাদের এ জাতীয় ধ্বংসাত্মক ধর্ম-বিদ্বেষী তৎপরতা এখনও অব্যাহত রয়েছে।  
 উল্লেখ্য, তাকফিরি-ওয়াহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ মহানবীর (সা) প্রখ্যাত সাহাবি হযরত ওয়াইস কারনির (রা) পবিত্র মাজারের মিনার ও কবরের চারপাশের লোহার জালির নির্মিত বেড়া ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা একই কাজ করেছে মহানবীর (সা) বিখ্যাত সাহাবি আম্মার ইবনে ইয়াসির ও উবাই ইবনে কাইস  নাখয়ি’র (রা)’র মাজারেও। এই তিন সম্মানিত সাহাবির মাজার তারা  গুড়িয়ে দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ।

সমান দূরত্বের সারিবদ্ধ স্তম্ভ (পালমিরার ধ্বংসস্তুপ) 

এ ছাড়াও দামেস্কে কথিত ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সেনারা ইসলামের প্রাথমিক যুগের প্রখ্যাত মুসলমান ও হযরত আলী (আ)’র বিশিষ্ট সঙ্গী হুজর বিন উদাই (রা)’র পবিত্র মাজারও ধ্বংস করেছে। 
সিরিয়ার ওপর চাপিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস শুরুর প্রথম দিকেই নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এই হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে সিরিয়া আলকায়দার সহযোগী সন্ত্রাসীদের পর্যটনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটেনের একদল নাগরিকও ভ্রমণের নামে সিরিয়ায় এসে সন্ত্রাসী তৎপরতায় যোগ দিচ্ছিল এবং এ ধরনের ভ্রমণ গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তাকে অতীতের চেয়েও হুমকিগ্রস্ত করে তোলে।

সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা সিরিয়া ও ইরাকে ইসলামের নামেই এইসব সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে আসছে। অথচ বাস্তবতা হল তারা ধর্ম ও মানবতা সম্পর্কে কোনা জ্ঞানই রাখে না। তাদের নানা ধরনের পাশবিক নৃশংসতা এবং অন্য ধর্মের উপাসনালয় বা স্থাপনা ও অনুসারীদের ওপর তাদের ধ্বংসাত্মক আক্রোশই এর প্রমাণ। অথচ ইসলাম অন্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলে। আসলে তারা নানা ধর্মের ও গোত্র বা জাতির মধ্যে বিভেদ আর সংঘাত সৃষ্টি করতে চায় এবং তারা কখনও কখনও এই লক্ষ্য পূরণে কিছুটা সফলও হয়েছে। 

 বায়াল উপাসনালয়। ২০১৫ সালে তাকফিরি-ওয়াহাবি গোষ্ঠী দায়েশের সন্ত্রাসীরা ধ্বংস করে দেয় এই স্থাপনা

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ককে বলা হয় ‘ইতিহাসের দরজা’। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন শহরগুলোর অন্যতম এই শহরের বয়স ৮ থেকে ১০ হাজার বছর। এখানে সব সময়ই জন-বসতি ছিল। তাই দামেস্ককে ‘বিশ্বের প্রথম রাজধানী’ বলেও উল্লেখ করা হয়। প্রাচ্যের সভ্যতার অন্যতম প্রধান ও প্রাচীনতম প্রাণকেন্দ্র ছিল এই শহর। এখানে উত্থান ও পতন ঘটেছে অনেক রাজবংশ আর সাম্রাজ্যের। এখানে এসেছেন অনেক নবী এবং বড় মনীষী।  

৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে দামেস্ক হয়েছিল মুসলিম বিশ্বের রাজধানী ও উমাইয়া রাজবংশের প্রধান-কেন্দ্র।  
সিরিয়া পূর্বাঞ্চলে হোমস প্রদেশে রয়েছে ঐতিহাসিক তাদমুর বা পালমিরা শহর। হেলেনিয় ও বাইজান্টাইন শাসনামলে এই শহরটি ছিল সভ্যতার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। প্রাচীন স্থাপত্য-কলা ও সুরম্য ভবনের চোখ-ধাঁধানো নানা নিদর্শনে ভরপুর এই শহরটি। 

পালমিরার 'বিজয়' নামের খিলান। (২০১৫ সালে তাকফিরি-ওয়াহাবি গোষ্ঠী আইএসআইএল তথা দায়েশের সন্ত্রাসীদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত)

পালমিরার অধিবাসীদের অনেকেই ছিলেন আর্মেনিয় ও আরব। ইহুদিরাও এখানে থেকেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে। নানা সংস্কৃতির সম্মিলন ঘটেছে এ শহরে। বিশেষ করে এ শহরে গ্রিক, পারসিক ও পালমেরিয় সংস্কৃতির নিদর্শন দেখা যায়। ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শনের গুরুত্বের কারণে এ শহরকে বলা হয় ‘মরুভূমির মুক্তা’। ইউনেস্কো এই শহরকে বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। 
পালমিরার ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষগুলোর একটা বড় অংশই খ্রিস্টিয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের।  এখানকার স্থাপত্য-শৈলীতে রয়েছে গ্রিক ও রোমানদের নানা কৌশলের ব্যবহার। এ ছাড়াও রয়েছে স্থানীয় ও  প্রাচীন ইরানি কৌশলের প্রয়োগ। পালমিরায় রয়েছে এক হাজারটি স্তম্ভ এবং ৫০০’রও বেশি কবরের এক বিশাল গোরস্তান। 
পালমিরার ভিত্তি গড়ে তুলেছিল ইরানের আশকানিয় বা পার্থিয়ান শাসকরা। রোমান হামলার কারণে পালমিরা প্রাচীন ইরান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রোমানদের পর পালমিরার শাসক হন সিরিয়ার রানী জেনোবিয়া। সোনালী রংয়ের স্তম্ভগুলো এখানে গড়ে তুলেছিল এক কাব্যময় পরিবেশ। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে পালমিরা ছিল এশিয়া ও ইউরোপের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য জংশন। খ্রিস্টিয় ২৭৪ সালে রোমানরা ধ্বংস করে দেয় এই শহর। 

পালমিরার দিয়োক্লিতিয়ান ক্যাম্প 

গত বছরের ২৩ আগস্ট বিস্ফোরক ব্যবহার করে এই শহরের 'বায়াল' নামের উপাসনালয়টি ধ্বংস করে দেয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ। এ উপাসনালয় ছিল খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের।  
পালমিরায় রয়েছে খনিজ পানির কয়েকটি আধার। এর অ্যাম্ফিথিয়েটারটি গ্রীক-রোমান স্টাইলে নির্মিত হয়েছে। এখানে অনুষ্ঠিত হত প্রাচ্যের নানা নাটকের অভিনয় । কখনও কখনও এখানে অনুষ্ঠিত হত হিংস্র প্রাণীদের লড়াই। আর এ অংশটিতেই বহু নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে দায়েশ। পালমিরার ‘বিজয়’ নামের খিলানটি প্রায় দুই হাজার বছরের পুরনো। দায়েশ এই স্থাপনাটিও ধ্বংস করে ফেলে ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর। 

উত্তর পালমিরার পার্বত্য অঞ্চল 

দায়েশ বা আইএসআইএল যে কেবল প্রাচীন স্থাপনাগুলোই ধ্বংস করছে তা নয় তারা অনেক ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিককেও হত্যা করেছে। এভাবে তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে তারা ছয়টি ঐতিহাসিক ভাস্কর্য ধ্বংস করে দেয়। সিরিয়ার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিভাগের পরিচালক আবদুল করিম এই ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে সিংহের আকৃতিবিশিষ্ট একটি বিখ্যাত ভাস্কর্যকে রক্ষার জন্য তার ওপর ধাতব আবরণ ও বালির বস্তা লাগিয়েছিলেন। কিন্তু দায়েশের সন্ত্রাসীরা সেসব সরিয়ে এই ভাস্কর্যটি ধ্বংস করে দেয়। আবদুল করিম দায়েশের এই পদক্ষেপকে পালমিরার প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি সবচেয়ে বড় অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন।  

পালমিরার সৌধ উপত্যকা। টাওয়ার আকৃতির কয়েকটি প্রাচীন সৌধ দেখা যাচ্ছে (২০১০)

অবশেষে চলতি বছরের ২৭ মার্চ সিরিয় সেনাদের হাতে মুক্ত হয় পালমিরা। পেতে রাখা বোমা ও মাইন এবং সন্ত্রাসীদের উপস্থিতি থেকে এই শহরকে পুরোপুরি মুক্ত করার অভিযানও শুরু করা হয়েছে। কিন্তু নতুন নানা ছবি থেকে দেখা যায় ‘মরুভূমির মুক্তা’ নামে খ্যাত এই শহরের সেই ঔজ্জ্বল্য ও জৌলুস অনেকাংশেই ম্লান হয়ে গেছে। 

দায়েশ বা আইএসআইএল-এর এক সন্ত্রাসী ধ্বংস করছে পালমিরার একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন

পালমিরায় দায়েশের ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাটের হাত থেকে মূল্যবান নিদর্শনগুলোকে রক্ষার জন্য সেখানকার জাদুঘরের অনেক নিদর্শন সরিয়ে রাখা হয়েছিল বলে জানা গেছে। তা সত্ত্বেও অনেক মূল্যবান নিদর্শন দায়েশের সন্ত্রাসীদের হাতে চুরি বা পাচার হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। তাই পালমিরার পরিপূর্ণ পুনর্গঠন হয়তো আর কখনও সম্ভব হবে না। #

পালমিরা পুনর্দখলের পর সিরিয়ার সরকারি সেনাদের আনন্দ প্রকাশ 

পালমিরার আরও ছবি দেখুন এই প্রবন্ধেরই ছবি-গ্যালারিতে। #

পার্সটুডে/মু.আ. হুসাইন/২১
 

ট্যাগ